Published : 30 Aug 2023, 10:35 PM
শেভালের 'সেন্স অব দ্য নাইট' শীর্ষক শিল্পকর্মটির কথা হয়তো অনেকেরই জানা। অন্যদের মতো এটি আমারও খুব পছন্দের একটি শিল্পকর্ম। এই চিত্রকর্মটি বুঝতে হলে 'অ্যাবসার্ডিজম ও সুররিয়ালিজম' সম্বন্ধে একটু স্বচ্ছ ধারণা রেখে এগোতে হবে। আর অ্যাবসার্ডিজম-এর সংজ্ঞা নিয়ে যেহেতু বিতর্ক রয়েছে তাই পুরোপুরি বিষয়গত মূল্যায়ন কিংবা উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগে না গিয়ে বিশেষ পরিস্থিতি, ব্যক্তি এবং জীবনের পর্যায়গুলোর মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখাই সমীচীন মনে করছি। এতে শ্যাম, কুল উভয়ই রক্ষা হবে। শিল্প-সাহিত্যে অযৌক্তিক কিংবা অর্থহীন বাস্তবতা একটি পরস্পরবিরোধী প্রত্যয় যেখানে জীবনকে আরও উচ্চকিতভাবে দেখবার জন্যে, উপলব্ধি করবার জন্যে শুধু একটি বাস্তবতাই নয় একাধিক বাস্তবতা যুক্ত করা হয়। যেমনটি আমরা আলবের ক্যামু (১৯১৩-১৯৬০) অথবা সোরেন কিয়ের্কেগার্দের (১৮১৩-১৮৫৫) লেখায় পেয়ে থাকি। অ্যাবসার্ডিজম দাবি করে গোটা বিশ্বই অযৌক্তিক এবং অর্থহীন; আর অর্থ খোঁজার প্রাণান্ত চেষ্টা মানুষকে বিশ্বের সাথে দ্বন্দ্বের দিকে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, অবচেতনের গহ্বর থেকে উঠে আসা বাস্তবের অধিক বাস্তব আপাত অবাস্তবই সুরিয়ালিজম। মিখাইল শেভালের 'সেন্স অব দ্য নাইট' বা 'রাত্রির অনুভব' আমাদের বেশকিছু আপাত অর্থহীন অথচ গূঢ় অর্থবহ এক বাস্তবতার দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে আমরা নানাবিধ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে থাকি। এই চিত্রকর্মের শুরুতে আমরা দেখতে পাই বড় বড় খিলান কাঠামো যা সাধারণত শক্তি এবং সামর্থের প্রতীক। খিলান মূলত একটি পুরুষ মোটিফ। পৌরাণিক কাহিনীতে এটি সময় এবং স্থানের মধ্যবর্তী দুয়ারকে নির্দেশ করে, যার মধ্য দিয়ে নিমিষেই অন্য জগতে প্রবেশ করা যায়। কিছু সংস্কৃতিতে পুনর্নবীকরণের প্রতীক হিসেবেও খিলান ব্যবহৃত হয়, যা উত্তরণের একটি আচারকে প্রতিনিধিত্ব করে; যেখানে কেউ নূতনকে আলিঙ্গন করবার জন্য পুরনোকে পিছনে ফেলে আসে। এছাড়াও খিলান আত্মা এবং মনকে উচ্চ আদর্শের দিকে উন্নীত করবার জন্য মোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়; যা সার্বজনীন সত্যের অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে।
খিলানযুক্ত জানালার বাইরে অভিনব নীলাকাশ। যা গভীরতা, স্থিতিশীলতা, প্রজ্ঞা, বিশ্বাস, সত্য ও মুক্তিকে প্রকৃতির সঙ্গে জুড়ে দেয়। ঘরের ভেতরে টেবিলে লেখার সরঞ্জাম, চায়ের কাপ, ফুলদানি। পাশেই শামাদানে রাখা আছে তিনটি মোম। প্রশ্ন জাগে মোম তিনটি কী নিছক সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য রাখা হয়েছে? নাকি এর গূঢ় অর্থ রয়েছে। বস্তুত আমরা যেভাবে শিল্পকে দেখি, বুঝি এবং ব্যাখ্যা করি এতে প্রতীকবাদ একটি বড় ভূমিকা পালন করে। দর্শকরা শিল্পকর্মে যে প্রতীকী আইকন দেখতে পান সেগুলো শিল্পীর ইচ্ছেকৃত হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। তবে মোমবাতি সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ পেইন্টিং-এর একটি ফিক্সচার হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই শিল্পে এটিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পঞ্চদশ শতাব্দীতে মোমবাতি প্রায়শই খ্রিস্টান ঘরানার চিত্রকর্মে ব্যবহৃত হতো এবং মোমবাতির প্রতীকী অর্থ সেই সময়ের পরে বিভিন্ন থিমের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে। মোমবাতি শিল্পীদের জন্য একটি অনন্য হাতিয়ার ছিল, এখনও রয়েছে কারণ প্রতীক হিসেবে এর অর্থ এবং তাৎপর্য চিত্রের প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে, ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে ডাচ ঘরানার বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী গেরিট ডাউয়ের (১৬১৩-১৬৭৫) 'এসট্রোনমার বাই ক্যান্ডেল লাইট' আর্টওয়ার্কটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। অনন্য এই অঙ্কনশৈলীতে গাঢ় তৈলচিত্রের ওপর আলোর উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে একটি মোমবাতি। পরবর্তীতে আরও অনেক ডাচ পেইন্টার তাদের বিখ্যাত চিত্রকর্মে মোমবাতিকে অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি আধুনিক সময়ে একটি মোমবাতি নিরাপত্তা, উষ্ণতা এবং আশার প্রতিনিধিত্ব করে। প্রেম ও প্রজ্ঞার চিরন্তন প্রকৃতিতে মোমবাতি বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে এবং ধরে নেয়া হয় যা কখনোই নিভে যাবে না।
এরপর আমরা দেখি সোনালি চুলের একজন নারী, রেশমের তৈরি রাতের পোশাক পরে ছোট্ট একটি পাখিকে অনুসরণ করে উড়ে যাচ্ছেন। আর তাকে অনুসরণ করে উড়ে যাচ্ছে ত্রিকালজ্ঞ পেঁচা ও একটি মাছ। শূন্যে ভেসে যাচ্ছে সবুজ পাতারাও। সাদা রেশমি পোশাক আনন্দ, সুখ, বিশুদ্ধতার পাশাপাশি নূতন আধ্যাত্মিক চেতনার মেটাফোর। এখানে অনুসন্ধানী ত্রিকালজ্ঞ পেঁচা অভ্যন্তরীণ জ্ঞান, পরিবর্তন, রূপান্তর, স্বজ্ঞাত বিকাশ, সৌভাগ্য এবং স্ব-বাস্তবতার প্রতীক।
উড়ন্ত মাছ এটাই নির্দেশ করে যে সৌভাগ্য নারীটিকে ঘিরে রয়েছে। আর সঙ্গত কারণেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে উড়ন্ত মাছটি কি অ্যাকুরিয়াম ভেঙে বের হয়ে এসেছে?
উড়ে যাওয়া সবুজ পাতা বস্তুত কোনো মানুষকে তার নিজস্ব জগতে ছেড়ে দেওয়ার গুণের কথা মনে করিয়ে দেয়। বুদ্ধের মতাদর্শ অনুসারে আমরা যাকে বলি 'Letting Go'। অযাচিত আসক্তি পেছনে ফেলে বেঁচে থাকার সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করবার প্রতীক বোধিবৃক্ষের এই সবুজ পাতা।
এই আর্টওয়ার্কটি পুরোপুরি পরাবাস্তব স্বপ্ন কিংবা অবচেতন থেকে উদ্ভূত হয়নি। এটি কল্পনার একটি খেলা, যেখানে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর সন্নিবেশ ঘটিয়ে ঐকতাননির্ভর একটি চিত্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। যারা রাত্রি জাগেন তারা বুঝতে পারবেন গভীর রাতে প্রকৃতিতে এক ধরনের ঐকতান সৃষ্টি হয়। জীবনানন্দ (১৮৯৯-১৯৫৪) তাঁর কবিতায় বলেছিলেন 'এক একটা দুপুরে এক একটা জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন'। সেভাবে বলতে গেলে শেভালের 'সেন্স অব দ্য নাইট' একটা রাতে একটা জীবন অতিবাহিত করবার মতন চিত্রকর্ম। রাত্রির মায়ায় ভাস্বর এক মানচিত্র। তবে এই লুকোনো ইঙ্গিত বোঝার জন্য তীক্ষ্ণ ও সংবেদনশীল দৃষ্টি প্রয়োজন।
এক্ষণে অবসর মিলল শেভালের ব্যক্তি জীবন নিয়ে দু'চারটি কথা বলবার। ওপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে এটুকু স্পষ্ট যে, শেভাল অ্যাবসার্ডিস্ট ঘরানার একজন সমসাময়িক চিত্রকর।
তিনি 'শেভাল ফাইন আর্ট ইনকর্পোরেটেড'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে বসবাস করছেন। তাঁর পেইন্টিংস আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন গ্যালারিতে নিয়মিতভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। মিখাইল শেভাল দক্ষিণ রাশিয়ার একটি ছোট্ট শহর কোটেলনিকোভোতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৬ সালে। শিল্পবোদ্ধা পরিবারে বেড়ে ওঠার সুবাদে শৈশব থেকেই আঁকার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। শেভালের বাবা এবং দাদা একজন পেশাদার শিল্পী ও ভাস্কর দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। এঁদের তত্ত্বাবধানে মাত্র তিন বছর বয়েসে শেভাল বেশকিছু জটিল চিত্রকর্ম এঁকে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন।
১৯৮০ সালে শেভাল পরিবার জার্মানিতে চলে যায় আর এই নতুন পরিবেশ শেভালের শিল্পীসত্তার ওপর এক দুর্দান্ত ছাপ ফেলে। সেসময় ছবি আঁকার পাশাপাশি গান এবং কবিতা লিখে সময় কাটান শেভাল। একটি 'রক এন রোল' ব্যান্ডেও বাজিয়েছিলেন কিছুদিন। ১৯৮৬ সালে তুর্কমেনিস্তানের বলকানাবাতে চলে আসেন এবং ১৯৯২ সালে আশগাবাত স্কুল অব ফাইন আর্টস থেকে স্নাতক হন। প্রাচ্য দর্শন ও মধ্য এশিয়ার চরিত্রগুলো শুষে নিয়ে একজন স্বাধীন পেশাদার শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই সময়ে শেভাল আশগাবাত এবং বলকানাবাতের বেশ কয়েকটি থিয়েটার এবং প্রকাশনা সংস্থার সাথেও যুক্ত ছিলেন। মঞ্চ নাটকের সেট, কস্টিউমস এবং সুভেনির তৈরি করেছেন নিজের হাতে।
১৯৯০ সালে শেভাল তুর্কমেনিস্তানের স্টেট মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস-এ প্রথম ব্যক্তিগত প্রদর্শনী করেন, এটি তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা স্থানীয় শিল্পী-সাহিত্যিক-সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। ১৯৯৩ সালে শেভাল মস্কোতে ফিরে আসেন এবং বিখ্যাত পাবলিশিং হাউস প্ল্যানেটাসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থায় একজন স্বাধীন শিল্পী ও চিত্রকর হিসেবে কাজ করেন।
১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে অভিবাসনের মাধ্যমে শেভাল তাৎপর্যপূর্ণ একটি নূতন জীবন শুরু করেন। তিনি নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দর্শন এবং দৃষ্টি নিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে মনোনিবেশ করেন যা তাকে যৌবনে অনুপ্রাণিত করেছিল। শেভালের নামযশ চারিদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার পর ১৯৯৮ সালে নিউইয়র্কের মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন ন্যাশনাল আর্টস ক্লাবের সদস্য হন। ২০০২ সালে পান সোসাইটি ফর আর্ট অব ইমাজিনেশনের সদস্যপদ। এছাড়াও শেভাল ২০০৪ সালে 'লুলাবিস' এবং ২০০৭ সালে 'নেচার অব অ্যাবসার্ডিটি' নামে দুটি আর্ট অ্যালবাম প্রকাশ করেন।