ফিলিপ লারকিন: আধুনিকতার মুখচ্ছবি

আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা, বেদনা ও প্রতিশ্রুতির টানাপড়েন সমসাময়িকদের মধ্যে লারকিনের মতো আর কেউ ধরতে পারেননি কবিতায়।

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 2 Dec 2022, 08:24 AM
Updated : 2 Dec 2022, 08:24 AM

শতবর্ষ আগে জন্ম তাঁর। প্রয়াণ ৬৩ বছর বয়সে। নাতিদীর্ঘ জীবনে রচনা করেছেন চারটি কাব্যগ্রন্থ, দুটো উপন্যাস আর খানকতক প্রবন্ধ। সীমিত এই সাহিত্যভাণ্ডার ফিলিপ লারকিনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে। কী আছে লারকিনের দীর্ঘস্থায়ী এ কবিখ্যাতির পেছনে? ২ ডিসেম্বর, ফিলিপ লারকিনের ৩৭তম প্রয়াণ দিবসকে সামনে রেখে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন মোস্তাক শরীফ

“এমন কোনো ইংরেজ কবি কি আছেন যিনি ফিলিপ লারকিনের চেয়ে একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন, অ-কবিসুলভ জীবন যাপন করেছেন?” ফিলিপ লারকিনের কাব্যপ্রতিভার মূল্যায়ন করতে গিয়ে একটি লেখায় এমন মন্তব্য করেছিলেন ক্যাথা পলিট। স্পষ্টতই, প্রশ্নটির উত্তর সম্বন্ধে অন্তত পলিট নিজে ছিলেন নিঃসংশয়। ফিলিপ লারকিনের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বেশিরভাগ মানুষেরও তাই মনে হবে। বিয়েশাদি করেননি, পূর্ব ইংল্যান্ডের হাল শহরে কাটিয়েছেন জীবনের সিংহভাগ। মধ্য পঞ্চাশে পৌঁছা অব্দি স্থায়ী কোনো ঠিকানা ছিল না। কবিতা পাঠের আসর, বক্তৃতার মঞ্চ, সাহিত্যসভা--সবকিছুকে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। ভিনদেশী সাহিত্যে আগ্রহী ছিলেন না। লন্ডনকে অপছন্দ করতেন, জীবনে বিদেশ ভ্রমণ করেননি। একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘জীবনকে যদ্দূর সম্ভব সহজসরল করার চেষ্টাতেই জীবন কেটেছে আমার। সারাদিন কাজ, বাড়ি ফিরে রান্না, খাওয়া, বাসনকোসন ধোয়া, টেলিফোন করা, লেখালেখি করা, একটু মদ গেলা এবং টেলিভিশন দেখা, এটাই আমি।’ ভালোবাসতেন জ্যাজ সঙ্গীত। ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় নিয়মিত রিভিউ লিখতেন জ্যাজ সঙ্গীতের ওপর। বন্ধুবান্ধব ছিল হাতে গোনা, টুকটাক রঙ্গরসিকতা করতেন, তবে মোটা দাগে পানাপুকুরের মতো নিস্তরঙ্গ এক জীবন। প্রেম, অভিমান, সংসারের জটিল ঘূর্ণাবর্ত, কিছুরই অস্তিত্ব নেই জীবনে। কেবল আছে কিছু কবিতা। সে কবিতার সুষমা আর শক্তি এমন, লারকিনের মৃত্যুর বছরবিশেক পর ইংল্যান্ডের পোয়েট্রি বুক সোসাইটি-র এক জরিপে বিগত পঞ্চাশ বছরের সেরা ইংরেজ কবির খেতাব জেতেন তিনি। ২০০৮ সালে দ্য টাইমস পত্রিকা লারকিনকে অভিহিত করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের সেরা সাহিত্যিক হিসেবে।

ফিলিপ আর্থার লারকিনের জন্ম ১৯২২ সালের ৯ আগস্ট, ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি শহরে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হবার পর পেশা বেছে নেন গ্রন্থাগারিকের। গোটা কর্মজীবনই কাটিয়েছেন এ পেশায়। প্রথমে স্রপশায়ার ও লেইস্টারে, পরে বেলফাস্টের কুইন্স কলেজে এবং সবশেষে হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক হিসেবে। জীবনের শেষ ত্রিশ বছর কাটিয়েছেন হালে। শহরটি সম্বন্ধে লারকিনের ভাষ্য, ‘একটি প্রান্তিক শহর এটি। প্রান্তবাসী জীবন আমার নিজেরও পছন্দ।’ জীবদ্দশায় চারটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন: দ্য নর্থ শিপ (১৯৪৫), দ্য লেস ডিসিভড (১৯৫৫), দ্য উইটসান ওয়েডিং (১৯৬৪) ও হাই উইন্ডোজ (১৯৭৪)। লিখেছেন দুটো উপন্যাস: জিল (১৯৪৬) ও আ গার্ল ইন উইন্টার (১৯৪৭)। কিছু পুস্তক সমালোচনা, প্রবন্ধ আর জ্যাজ সঙ্গীতের পর্যালোচনা-এ নিয়েই তাঁর রচনাসম্ভার।

প্রাত্যহিক জীবনের টানাপড়েন আর দ্বন্দ্বময় জীবনবাস্তবতাই লারকিনের কবিতার মূল উপজীব্য। অ্যালান ব্রাউনজন লিখেছেন, ‘গত পঁচিশ বছরের হিসাব কষতে বসলে, অন্য যেকোনো কবির চেয়ে কারিগরি দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে মেধাবী আর নান্দনিকতার বিচারে সবচেয়ে মনোহর কবিতা লিখেছেন ফিলিপ লারকিন। হৃদয়ে প্রবল অস্বস্তি জাগানো আবার একইসঙ্গে সম্মোহনী ক্ষমতাসম্পন্ন কবিতাগুলো লিখেছেন অনায়াস পারঙ্গমতায়।’ কথ্য ভাষার দক্ষ ব্যবহার, ব্যজস্তুতি আর প্রত্যক্ষবচন--এ সবের মাধ্যমেই ব্যক্তিমানুষের জীবনাভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ‘গীতিধর্মিতা আর নৈরাশ্যের এক তীক্ষ্ণ মিশ্রণ’--লারকিনের কবিতাশৈলীকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন জাঁ হার্টলি। প্রথম দিকের কবিতায় টি এস এলিয়ট, ইয়েটস আর ডব্লিউ এইচ অডেনের প্রভাব স্পষ্ট। পঞ্চাশের দশকে পড়তে থাকে টমাস হার্ডির প্রভাব। এককভাবে তাঁর কবিতায় হার্ডিই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন। সাধারণ মানুষ আর তাদের প্রাত্যহিকের জীবনাভিজ্ঞতাকে এক ধরনের নিরাসক্ত তবে সহানুভূতিপ্রবণ দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস দেখা যায় তাঁর কবিতায়। রূপক ও চিত্রকল্প, উপমা-উৎপ্রেক্ষার সমাহারে কবিতাকে ভারাক্রান্ত করার পক্ষপাতী নন তিনি। ফিলিপ লারকিনের কবিতাশৈলীর কয়েকটি নমুনা:

“ভেবেছিলাম ভুলে গেছি, এমন কত কিছু ফিরে আসে

বিধুর যন্ত্রণা নিয়ে-

কারো কাছে পাঠানো সেইসব চিঠির মতো,

ঠিকানা ছেড়ে যে চলে গেছে বহুদিন আগে।”

“নেই আর সেই ইংল্যান্ড

সেই ছায়া, তৃণপ্রান্তর, রাস্তা

পৌরভবন, গির্জায় নকশীকরা বক্তৃতামঞ্চ।

আছে কিছু বই, থাকবে, গ্যালারিতে।

আমাদের জন্য থাকবে কেবল

চুন-বালি-সিমেন্টের মিশ্রণ আর গাড়ির টায়ার।”

“কী বিষন্ন এই গৃহ

যেভাবে রেখে গেছি আছে সেভাবেই

শেষ গৃহবাসীর স্বাচ্ছন্দ্যের মোড়কে ঢাকা

যেন চায়, আবার ফিরে আসুক সে।”

“শব্দ নয়, দীর্ঘ জানালার ভাবনারা আসে

আসে সূর্যকে অনুধাবনকারী সেই শার্সি

তার ওপারে গভীর নীল বাতাস।

কিছুই দেখায় না সে, কোথাও নেই, শেষও নেই তার।”

“বাইরে বাতাসের ঝাপটা

নিয়ে আসে সান্ধ্য-বৃষ্টিকে। আরো একবার

নির্বিরোধী নিস্তব্ধতা

তার বিশাল হাতের তালুতে আশ্রয় দেয় আমায়,

এবং এক সমুদ্রপুষ্প বা সাধারণ শামুকের মতো

প্রগাঢ় সতর্কতায়, ভাঁজ খুলি, নির্গত হই

এই আমি।”

জেমস জয়েসের ইউলিসিস, টি. এস. এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড আর ভার্জিনিয়া উলফের জ্যাকব’স রুম যে বছর প্রকাশিত হয় সেই একই বছর জন্ম নেয়া ফিলিপ লারকিনের কাছে ‘আধুনিকতা’ প্রত্যয়টি ধরা দিয়েছিল ভিন্ন এক অনুভূতি নিয়ে। এ আধুনিকতা মফস্বলী, কিছুটা আমলাতান্ত্রিক, আত্মমগ্ন, ভোগবাদী, স্মৃতিকাতর এক ইংরেজ আধুনিকতা। রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম, ভাড়া কক্ষ আর অ্যাম্বুলেন্সের মতো সাদামাটা পটভূমির মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন সেইসব অপরিণত অনুভূতি, তাঁর কলমে যেগুলো হয়ে উঠেছিল উপযুক্ত ও অনিবার্য। আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা, বেদনা ও প্রতিশ্রুতির টানাপড়েন সমসাময়িকদের মধ্যে লারকিনের মতো আর কেউ ধরতে পারেননি কবিতায়। ‘অপরাহ্নে’ শিরোনামে তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি যিনিই পড়েছেন তিনি কখনো ভুলতে পারবেন না সন্তানের দোলনা ঠেলা তরুণ সেই দম্পতিকে। ভুলতে পারবেন না কবিতাটির শেষের পংক্তিগুলো: ‘ক্রমশ প্রগাঢ় হচ্ছে তাদের সৌন্দর্য, কিছু একটা ঠেলে দিচ্ছে তাদের, নিজেদের জীবনের প্রান্তের দিকে।’

 লারকিনের কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে নিয়তিবাদ আর মৃত্যু। মানবজীবনের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন কবিতায় ও কথাসাহিত্যে। চেষ্টা করেছেন তুলির ঋজু টানে রূঢ় বাস্তবতার ছবি আঁকার। জীবনে কঠিন আর তিক্ত সময় পাড়ি দিয়েছেন, যার প্রতিফলন ঘটেছে অনেক কবিতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের অধিকাংশ কবির মতো জীবনের অর্থহীনতার বন্দনা করেছেন তিনিও। কবিতায় পরিব্যাপ্ত বিষাদময়তার কারণে অনেকে ভুল বুঝেছে তাঁকে। ভেবেছে নেতিবাচকতা ছড়ানো ছাড়া কবিতায় আর কিছু করেননি তিনি। ধারণাটি ভুল। জীবনের ইতিবাচকতারও উদযাপন করেছেন লারকিন, যদিও নিজের অননুকরণীয় নির্মোহ ভঙ্গিতে।

 ১৯৭৪ সালে হাই উইন্ডোজ প্রকাশিত হবার পর কবিতা লেখা একেবারে কমিয়ে দিয়েছিলেন। জীবনের শেষ দশ বছর লেখালেখি থেকে বলতে গেলে দূরেই ছিলেন। ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজকবির পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয় তাঁকে। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন লারকিন। সারাজীবন ভিড় এড়িয়ে চলা মানুষটি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভিড়ের একজন হতে চাননি। তাঁর প্রয়াণের পর স্পেকটেটর পত্রিকায় এ এন উইলসন লিখেছিলেন আসল কথাটি, ‘তুলনামূলকভাবে কম কবিতা লিখেও কবি হিসেবে লারকিনের যে প্রতিষ্ঠা তার কারণ সম্ভবত আমাদের মন ও মেজাজকে নির্ভুলভাবে ধারণ করতে পেরেছিলেন তিনি। আমাদের মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা প্রবলতম ভয়কে প্রকাশের জন্য খুঁজে পেয়েছিলেন উপযুক্ত কণ্ঠস্বর।’ এ কারণেই মৃত্যুর এত বছর পরও আধুনিক কবিতার পাঠকদের কাছে লারকিনের আবেদন এতটুকু ম্লান হয়নি।