ভাগ্যিস! আজ যখনই খুলি তাঁর ওই গদ্য, আতঙ্কিত ট্রয়বাসীর মতো দেখি সেই অকুতোভয় আকিল্লিসকে।
Published : 12 Nov 2024, 08:25 AM
কুরুক্ষেত্র
বেঁচে থাকতে হলে জীবনে উদ্দীপনার জোগান প্রতিনিয়ত দরকার, যে-উদ্দীপনা পৌঁছে দেবে সঙ্ঘর্ষময় রণক্ষেত্রে। তার জন্যে চাই যোগ্যতম শত্রু। পুরোনো শত্রু হীনবল হয়ে পড়লে অথবা নিজেকে ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী করে তুলতে পারলে প্রয়োজন এমন এক বলশালী প্রতিপক্ষ, যাকে কঠিন হলেও পরাজিত করা খুবই সম্ভব। সেখানেই যুদ্ধের আনন্দ।
অর্জুন, এ-কথা কি তুমিও বিশ্বাস করো না?
(২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
চয়নদা
আশ্বিনের দুপুর। পিয়ার্সন হাসপাতালকে বাঁয়ে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলাম গলিপথে। পাড়াটির নাম সেবাপল্লি। দু-দিকে ঘন গাছপালা, লতাকুঞ্জে ঢাকা ছোটো-ছোটো বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সামনে বিনম্র গেট। যাঁকে খোঁজার উদ্দেশে ঘুরছিলাম দুপুর থেকে, তাঁর কোনো হদিস মিলল না শেষ পর্যন্ত। তার বদলে গলির দু-পাশে চোখে পড়ল একের পর এক নিঝুম গেট। সেইসব গেটের কোনোটায় ছোটো হরফে লেখা— মুকুল দে, নীচে ‘চিত্রলেখা’। একটা গেটে আজও জ্বলজ্বল করতে দেখলাম লীলা রায়ের নামটি। ঠিক তার নীচে অন্নদাশঙ্কর রায়। কিছুতেই যখন খুঁজে পাচ্ছি না, সামনে এল পরিচ্ছন্ন একটি বাড়ি। গেটে লেখা— সুশীলরঞ্জন ভঞ্জচৌধুরী।
অথচ, অমর্ত্য সেনের সহপাঠী, যিনি শান্তিনিকেতনে চয়নদা নামে পরিচিত, তাঁর হদিশই কেউ দিতে পারলেন না। যেন মানুষটি নিরুদ্দেশ। এমন নিরুদ্দিষ্ট কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষকেও তো খুঁজে পাওয়া যায়। পেয়েও যাব একদিন-না-একদিন।
(১৪ অক্টোবর ২০১৮)
অঘটন
পৌলোমী সেনগুপ্ত আর নেই। তাঁর জীবদ্দশায় কখনো আলাপ হয়নি। গত বইমেলায় কৃত্তিবাসের কবিতাপাঠ অনুষ্ঠানে প্রথম তাঁকে দেখি। সঞ্চালকের ঘোষণায় জানতে পারি, ইনিই পৌলোমী। দ্বিতীয়বারও কৃত্তিবাসের অনুষ্ঠানে। বাংলা আকাদেমিতে। সেবার ছিলেন সকন্যা। চেনার জন্যে আর ঘোষকের দরকার পড়েনি সেবার।
তাঁর মুদ্রিত অক্ষরও আমার পড়া হয়নি। অনুষ্ঠানে শুনেছি দুটি মাত্র কবিতা।
এটা স্বীকারোক্তি নয়। ঘটনার বিবরণ মাত্র। আমরা-যে পরস্পরকে জানার আগ্রহবোধ করিনি, এটাও ঘটনা মাত্র।
কিন্তু আজ মৃত্যুর সামনে দাঁড়ালে এসব ঘটনা তুচ্ছ হয়ে যায়। চরাচর জুড়ে একটাই ছবি কুয়াশার মতো টাঙানো থাকে-- যেভাবেই হোক না কেন, মেরুদূরত্বে থাকলেও, আমরা ছিলাম একই পরিবারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সদস্য।
(১৮ অক্টোবর ২০১৮)
শব্দ
না চাইতেই অবিরাম কিছু-না-কিছু পেতে থাকি। কোথাও ছিটেফোঁটা ভালোবাসা, আচমকা অপমান, হয়তো-বা শ্রদ্ধার ভাঙানি, অকারণ একটু স্নেহ, টুকরো ঘৃণা, মনের কোণে সন্দেহের ছিট। প্রশ্রয়? তা-ও জোটে বইকী।
তবু কিছুতেই জোটে না অন্তরে তোলপাড় খাওয়া, নিশ্চুপ, অমরাবতী শব্দগুলি!
(৯ নভেম্বর ২০১৮)
সন্দীপন কথামৃত
প্রখ্যাত এক সঙ্গীতশিল্পী এসেছেন আজকাল দপ্তরে। কালচারাল এডিটর শৌনক লাহিড়ী সাড়ম্বরে জানাল-- সন্দীপনদা, ইনি অমুক।
কাজ করছিলাম একই টেবিলে মুখোমুখি। একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই শিল্পীকে দেখলেন ঠান্ডা চোখে। তারপর শৌনকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলেন। যেন ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন। শেষে বলেছিলেন, আর একটু লাগবে।
শুনে অপ্রস্তত শৌনক শিল্পীর পুরো নাম ফের আওড়ায়। সন্দীপনদার ফের নিস্পৃহ উত্তর-- বললাম যে, আর একটু লাগবে!
(২৫ নভেম্বর ২০১৮)
বিরল সন্ধ্যে
আজকের সন্ধ্যেটি এ জীবনের গুটিকয়েক বিরল সন্ধ্যের একটি।
২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ছিল আদম সম্মাননা জ্ঞাপনের দিন। অসুস্থ, তাই আজীবন কবিতাযাপনের জন্য সেই সম্মান নিতে রোটারি সদনে পৌঁছতে পারেননি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। এদিকে কবির হাতে সম্মান তুলে দিতে মঞ্চে উপস্থিত স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ। কী করা যায়? শঙ্খ ঘোষের সিদ্ধান্ত ছিল, উনি অসুস্থ পার্থপ্রতিমের বাড়ি যাবেন কবির হাতে পুরস্কার তুলে দিতে। আজ ছিল সেই দিন।
৮৮ বছরের কবি সম্মান জানাতে এলেন সিঁথি মোড়ে, ৭০ বছরের অসুস্থ কবির বাড়িতে।
এই অসাধারণ ঘটনা চাক্ষুষ করলাম আমরা মাত্র চারপাঁচজন।
(৩০ মার্চ ২০১৯)
নাতনি-দাদান সংবাদ-১
চোখের জল না, নোনতা-নোনতা।
কী করে জানলে?
খেয়ে দেখেছি তো!
নোনতা? কী করে হয়?
আরে, চোখের ভেতর জলমাসি আছে না, সে-ই তো নুন মিশিয়ে দেয়!
(১৩ এপ্রিল ২০১৯)
জন্মদিন
রাত অনেক হয়েছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সাড়ে পাঁচ বছরের নাতনি জড়িয়ে ধরে সুর করে গেয়ে গেছে--
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ...
গান শেষ হওয়ার পরও অনেকক্ষণ ছোট্ট দু-হাতে ধরেই ছিল জড়িয়ে। যখন ছাড়িয়ে কোলে তুলি, তার চোখ ছলছলে। জল? বিস্মিত আমি ভেবে পাই না, শিশুমনের কোন দুটি তারা থেকে অশ্রুর এই আলো!
এখন সে ঘুমের দেশে। এইমাত্র মেয়ে এসে হাতে তুলে দিল সুদৃশ্য এক মোড়ক। হলুদ রিবনে বাঁধা। সাড়ে পাঁচ বছরের নাতনির অপটু হাতের লেখা 'Happy Birth-- দাদান।' 'day' সে লেখেনি।
পছন্দ হয়েছে তো? পাশে দাঁড়িয়ে মেয়ে বারবার জানতে চাইছে। গলায় কুণ্ঠা। আমি নির্বাক। তাকিয়ে আছি কলমের প্যাকেটের দিকে। ভাবছি: এই মেয়ে, এই নাতনি-- এদের যোগ্য কি আমি? তাদের এই উপহারের?
(১ জুলাই ২০১৯)
অঙ্ক
মৃত্যু থেকে মৃত্যুকে বাদ দিলে বিয়োগফল কী থাকে?
মৃত্যু।
(২৭ জুলাই ২০১৯)
রথ চলে গেলে
'রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড় খাইতেছিল-- কাঁদিতে কাঁদিতে উঠিতেছিল। আবার কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড় খাইতেছিল। দুই গণ্ড বিলম্বী ঘন কৃষ্ণ অলকাবলী বহিয়া, কবরী বহিয়া, বৃষ্টির জল পড়িয়া ভাসিয়া যাইতেছিল। তথাপি রাধারাণী সেই এক পয়সার বনফুলের মালা বুকে করিয়া রাখিয়াছিল-- ফেলে নাই।'
--- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়
(৬ অগাস্ট ২০১৯)
শক্তি ও তাঁর পরবর্তী কবিরা
সব চেয়ে কম পঠিত বাংলা বই কোনটা? এটা ধাঁধার প্রশ্ন। বরং সরাসরি বলতে পারা যায়— শামশের আনোয়ারের শক্তি ও তাঁর পরবর্তী কবিরা –নামের অতি-পরিশ্রমসাধ্য রচনাকর্মটি আদৌ পড়াই হয়নি। অবশ্য উড়ো গুজব একটা আছে-যে, বাঙালি এখনো লেখাপড়াটা করে। সেটা গুজবই। কথাটার তথ্যগুণ হারিয়েছে। এমনকী, যুক্তির প্রহরী-নামের আরেকটি নিষ্ঠুরভাবে অপঠিত এবং দীর্ঘ এক প্রবন্ধে শামশেরদা হালফিল বাঙালির লেখাপড়া নিয়েও সন্দিহান।
শক্তি ও তাঁর পরবর্তী কবিরা-য় কী লিখতে চেয়েছিলেন শামশের আনোয়ার?
কবিতার কথা বইয়ের নিবন্ধাবলিতে জীবনানন্দ দাশ তাঁর সমসাময়িক কবিতাপ্রবাহগুলির প্রসঙ্গ এনেছেন। কিন্তু, আমরা যদি সেই অববাহিকায় জীবনানন্দের ভ্রমণ-প্রচেষ্টা মন দিয়ে দেখি, তাহলে এমন এক সুদক্ষ সাঁতারুকে দেখব, যিনি জলের গভীরতার দিকে দৃকপাত না-করে শুধু দক্ষতার গুণে সমস্ত প্রবাহ অতিক্রম করে যাচ্ছেন। সহস্রষ্টাদের বিচলিত না-করে তাঁর কাব্যবোধের পতাকা-সংবলিত স্টিমারটি তরতরিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছে।
শামশের আনোয়ার পদাতিক। তিনি সমস্ত শরীর নানাবিধ অস্ত্রে সুসজ্জিত করে তাঁর উদ্দিষ্ট কবিতাক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু। পরের কবিকুল তাঁরই সমবয়সী। ষাটের দশক। পরের দশক সত্তর, যাঁদের অনেকেই তাঁর বন্ধু। রক্তকরবী-তে প্রথম কিস্তি বেরোবার পর একদিন তাঁর বাড়ি গেছি। দরজা সরু করে খুলল। সেই ফাঁকে যতটুকু ধরে— শামশেরদার মুখ। তার বেশি খুলল না। খুলল গলা— তুমি তো তোমার বইপত্র দিলে না? আমার গদ্যটা কি ভালো লাগেনি? এরপর যেদিন আসবে, বইপত্র নিয়ে এসো।
দরজা বন্ধ হল, যা কোনোদিন হয়নি।
ভাগ্যিস! আজ যখনই খুলি তাঁর ওই গদ্য, আতঙ্কিত ট্রয়বাসীর মতো দেখি সেই অকুতোভয় আকিল্লিসকে।
দীর্ঘ লেখাটি তাঁর সমসাময়িক কবিবন্ধুরা পড়েননি (কেউই পড়েননি)। ভাগ্যিস তাঁরা পড়েননি!
(১৯ অগাস্ট ২০১৯)
পবন
হাতে চকচকে ছুরি। জিনস আর কী-একটা জামা। একমাথা ঝাঁকড়া চুলের নীচে দু-কানে দুল। বাগানের ঘাসের উপর উবু হয়ে বসে ছেলেটি আমাদের সবার জন্যে মাছ কুটছে। পবন দাস বাউল। আমাদের মানে কার কার?
তখন বাবলিদি সঙ্গীত ভবনে। বাবলি সাহা। অসামান্য গাইয়ে হয়েও গানটা যিনি গাইলেন না। থাকতেন বুদ্ধদেব বসুর ‘স্বাগত বিদায়’ বাড়ির আউট হাউসে। মাঝে মাঝে সিউড়ি থেকে আসতেন প্রভাতদা (সাহা)। প্রায় আবাল্য বন্ধু-কবি। আমিও কখনো গিয়ে থেকেছি।
আউট হাউসে ছিল দুটো ঘর। সেখানে গেলে একটায় আমি। অন্যটায় প্রভাতদা-বাবলিদি। একবার রাতে আমাকে বলা হল, থাকতে হবে ‘স্বাগত বিদায়’-এর বেডরুমে। কেন? উমাদি, উমা বসু, প্রসিদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা, কলকাতা থেকে এসেছেন সঙ্গীত ভবনে এক্সটার্নাল হয়ে। তিনি থাকবেন ওই ঘরে। কিন্তু উমাদির প্রচণ্ড ভূতের ভয়। একা থাকতে পারবেন না। ফলে বলির পাঁঠা আমি!
সেবার কেন্দুলির মেলা-ফেরত আমরা বড়ো একটা দল। কবিরুল ইসলাম, কালীকৃষ্ণ গুহ, ভিক্টর ভৌমিক, আমি। এসে দেখি, পবন। সেটা ১৯৮৭ সাল কি? হবে হয়তো।
সে কী হুল্লোড়! পবন মানেই কাঁধে দোতারা। বিকেল হওয়ার অপেক্ষা না-করে আমরা বেরিয়ে পড়ি। শান্তিনিকেতনের এ-রাস্তা ও-রাস্তা ঘুরে ঘুরে পবনের দোতারা যাচ্ছে। আমরা কোথায় যেন গেলাম। সেখানে পথের ধারে হাড়িয়ার দোকান। গোল হয়ে বসা গেল।
সেখান থেকে বেরিয়ে কোপাইয়ের তীরে। সূর্য নেমে যাচ্ছে। গোধূলিবেলা। পাশে শীতের ক্ষীণ স্রোত। হঠাৎ উঠে এক পাক ঘুরে পবন দোতারায় ঝঙ্কার তুলল— ‘কেকা রবে ময়ূর ডাকে এইদিকে কি ওইদিকে,/ বৃন্দাবনের পথ দেখাবি কে।’ সে কী নাচ! তার দোতারা মাঝে মাঝে সরোদ হয়ে উঠতে চাইত।
সেদিন মোবাইল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে ইউটিউবে আচমকা দেখলাম সেই ফেলে-আসা পবনকে।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট ২০১৫। বিরাট, আলোকিত মঞ্চ। তার মাঝে একমাথা সাদা চুল। চোখে চশমা। হাতে দোতারা। পাশে খঞ্জনী, কবেকার মিমলু। সামনে আদিগন্ত দর্শক-শ্রোতা। পবন গাইছে— ‘চঞ্চল মন আমার শোনে না কথা।’
পবন ছিল বীরভূমের কিশোর বাউলটি। বাড়ি-বাড়ি মাধুকরী করে চাল-আলু যা পেত, দিনান্তে ফুটিয়ে খেত। এ হেন পবন একবছর কেন্দুলির মেলায় হঠাৎ বলে বসল— এক্ষুনি বোলপুর যেতে হবে। কেন? আজব কথা, নাকি জল ফুরিয়ে গেছে! সেই প্রথম তার পাশে দেখি ভিন-জগতের মিমলুকে। কোলে ফুটফুটে বাচ্চা। সেও সাড়ে-তিন দশক হয়ে গেল।
(২ সেপ্টেম্বর ২০১৯)
তিরনা
৩০ অগাস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর।
আমরা যে জায়গাটিকে চেরাপুঞ্জি নামে বিখ্যাত করেছি, তার প্রকৃত নাম সোহরা। সেখান থেকে এগারো মাইল দুর্গম পথে।
স্বর্গের ঠিক পাশটিতে...
(১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯)
নাতনি-দাদান সংবাদ-২
মাথাটা ঘামাতে হয়।
কেন? মাথা ঘামালে কী হয়?
মাথা ঘামালেই তো বুদ্ধি বেরিয়ে আসে।
আর বুদ্ধি বেরোলে কী হবে?
বুদ্ধি বেরোলেই তো বুঝতে পারবে, কেন তোমার মাথার সব চুল সাদা হল। কেনই-বা তুমি দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছ।
(১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯০)
শ্যামলদা
লেখকের মৃত্যু আছে, লেখার নেই।
আভা নামের এক চরিত্র ছিল তাঁর ‘কুবেরের বিষয়-আশয়’ উপন্যাসে। মেদনমল্লের দুর্গ, তার নির্জন ধ্বংসাবশেষে আভাকে গলা টিপে মেরে ফেলার পর কুবেরের হাতের গাঁটগুলোতে কালো ছোপ পড়তে শুরু করে।
একদিন অনেক রাতে প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে হঠাৎ চোখে পড়ল শ্যামলদার হাতের আঙুল। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের। সামনের লোকটা সত্যিই শ্যামলদা তো, নাকি কুবের? চেপে ধরি। কালো ছোপের দিকে তাঁর হুইস্কি-ভেজা চোখ। মৃদু হেসে উড়িয়ে দেন— ‘ছাড় না!’
কচুরিপানার জাঙ্গাল থেকে দূরে বাংলাভাষার নিজস্ব আর টলটলে কালো জল। তাঁকে প্রণাম।
(২৫ সেপ্টেবর ২০১৯)
নিরাপত্তারক্ষী
ফাঁকা রাস্তা। একটা সরলরেখা যেন। দুদিকে গাছপালার সারি। শেষ সন্ধ্যে। এখন শুধু পাশে দাঁড়ানো সারবন্দি গুঁড়িগুলো দেখা যায়। থামের মতো। বাধ্য। কর্তব্যপরায়ণ। উপরের ডাল, পল্লবিত শাখা বা সন্নিবদ্ধ পাতা-- সব অন্ধকারে।
আচমকা— ‘যাচ্ছেন?’
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন উদ্যানের দারোয়ান। রোগা, ন্যুব্জ, মলিন শার্ট-প্যান্টের প্রৌঢ়। ডিউটি সেরে বাড়ির পথে।
--হ্যাঁ। চললেন?
একটু থেমে অযাচিত উত্তর এল— ‘হ্যাঁ। শরীরটা ভালো নেই।‘
বলার স্বরে অসুস্থতা স্পষ্ট। থমকে যেতেই হয়। কখনো তেমন কিছু কথা হয়নি। তবু এই খবরটা কেন দিলেন! ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। উনি কি নির্ধারিত সময়ের আগে বেরিয়েছেন? উদ্যানের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা ভেবে একটু গাওনা গেয়ে রাখলেন? মনে হল না। তাঁর কথার ভঙ্গিতে মনে হল—কোনো একজনকে কথাটা তাঁর বলা দরকার। দুস্থ, দরকারি চিকিৎসা করা হয়ে উঠছে না ভেতরে কোথায় যে কী হচ্ছে! সেই আশঙ্কা কাজ করছে। সহমর্মী কাউকে নয়, নিতান্তই একজন জীবিত মানুষকে বলা।
আশ্চর্য!
(২ অক্টোবর ২০১৯)
কাফকা
কাফকার ডায়েরিতে একদিনের সংক্ষিপ্ততম এন্ট্রি...
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ, ২ অগাস্ট
জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে-- বিকেলে সাঁতার কাটলাম।
(৩ অক্টোবর ২০১৯)
একটি উক্তি
"Our heads are round, so our thoughts can change direction."
-- Francis picabia
(১০ অক্টোবর ২০১৯)
ছুটিতে বাড়িতে
এবার বাড়ি এলাম লক্ষ্মী পুজোর পর। বিজয়া প্রায় বাসি হতে শুরু করেছে।
আজ তরুণ এসেছিল। আমাদের যজমানি ভাণ্ডারী (নাপিত) প্রয়াত উমাপদর ছেলে। অল্প বয়সেই চেহারায় বুড়োটে ছাপ পড়ে গেছে। পুজোর পর দেখা করতে আসতেই হয়।
দোরগোড়ায় থেবড়ে বসে মিষ্টিমুখ করতে করতে একটা জামার মূল্য সে আশা করছিল। বলতে লজ্জা হচ্ছে, আমি পারিনি। হাতে একশো টাকার নোট ধরিয়ে বলি-- এ বছরের মতো এটাই নে।
যজমানি প্রথা কবে উঠে গেছে। আমরাও গ্রামে থাকি না বহুদিন। তবু এসব ঠুনকো অজুহাতে শত বছরের প্রথাকে টলিয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্য একটা নামমাত্র নোট পেয়েও তরুণ খুশি। বলে গেল, কখন আছে, কখন নেই। দিনকাল খারাপ। এই তো সেদিন, পাশের বাঁশড়া গ্রামের কোন চাষার ঘরের ছোটো ছেলে গলায় শাবল চেপে নিজের মাকে খতম করেছে। তারপর দড়ি দিয়ে সিলিঙে ঝুলিয়ে দিয়ে চেঁচিয়েছে-- হায়, হায়! আমার কী হবে গো। আমার মা-টো গলায় দড়ি দিয়েছে গো।
জানেন তো তাপাইপুরের নারান মোড়লকে। কী ভালো লোক ছিল। পট করে মরে গেল। কামাতে গেলেই কাকিমা খেয়ে যেতে বলতেন। সেদিন তালের ফুলুরি খাওয়ার জন্যে হিরিঝিরি। দাওয়ায় বসে খাচ্ছি, মোড়ল বাড়ির ওদিকে যেতে গিয়ে উঠোনে দড়াম করে পড়ে গেল। অত ভারী শরীর। একা তুলতে পারব না জেনেও ছুটে গেলাম। ওমা, মরে গেইছে! কাকিমা হতভম্ব। কী অবস্থা বলুন তো?
রাজ্যের খবর দিয়ে তরুণ বিদায় নিল।
গতকাল এসেছিল অচিন আর প্রমথ। পুজোর পর পেন্নাম করতে। ওরাও বহুদিন চাষ করছে। ষাট ছুঁই ছুঁই অচিন জানাল-- পেন্নাম করার মানুষ দিনদিন কমে আসছে। কিন্তু বচ্ছরকার ক্ষণ, আশীর্বাদ না পেলে চলবে কী করে!
মিষ্টিমুখ করানোর পর দুজনের হাতে দুশো করে নগদ। পেন্নামি। নিতে চায় না, তবু হাতে গুঁজে দিতেই হয়।
সামান্য। কিন্তু এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাপদাদাদের আচার, স্মৃতি। জড়িয়ে আছে পারস্পরিক আনন্দ।
এ তো শুধুই মাতৃপূজা নয়। এ তো শত শত বছরের সম্পর্কের পুজো! না হলে কেন আমাদের আরেক চাষি কানাইয়ের খোঁজ নিচ্ছিল আমার মেয়ে?
অচিন জানায়-- বাবাকে নিয়ে কয়েক দিন ধরেই সে হাসপাতালে।
কানাইয়ের সঙ্গে এবার দেখা হল না। মেয়ে বলল-- ওর টাকাটা অচিনকাকার হাতে দিলে হয় না?
সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে অচিনের উত্তর-- টাকা লয় মা, আশীর্বাদ!
(১৯ অক্টোবর ২০১৯)
(ক্রমশ)