Published : 31 Aug 2021, 03:44 PM
একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের গোড়াতে দাঁড়িয়ে আজ থেকে চল্লিশ বছরের মতো আগের সময়টার দিকে পেছন ফিরে তাকালে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। পৃথিবী অচল আজ যেসব জিনিসের উপস্থিতি ছাড়া –- ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ইমেইল, ইউটিউব, শয়ে শয়ে টিভি চ্যানেল, ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, নেটফ্লিক্স তথা ওটিপি – এসব বিহনে আমরা (এদেশে) যে জীবন যাপন করতাম, তা আর যা-ই হোক, খুব অনুপাদেয়, অনুপভোগ্য ছিল না। সে-সময় শিক্ষিত সাক্ষর মানুষের, বিশেষত তরুণদের, বিনোদন বা অবকাশ যাপনের যে গুটিকতেক উপাদান ছিল তার একটি ছিল বই-পুস্তক। আর সেই গ্রন্থ জগতের একটি প্রজাপতি খচিত নক্ষত্র 'সেবা' প্রকাশনী। আরো প্রায় দেড় দশক আগে তার যাত্রালগ্নেই কাজী আনোয়ার হোসেন বা কাজীদা নামে কিংবদন্তীতুল্য পরিচিতি লাভ করা মানুষটির দক্ষ নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছিল যে, তাদের বই ' প্রিয় বই, অবসরের সঙ্গী'। যদিও, সেই প্রজাপতির এক ভিন্ন ধরনের 'নির্বন্ধের' কারণে লোকজন প্রায়ই তাদের অবসর পেরিয়ে কাজের কথা তো বটেই, এমনকি নাওয়া-খাওয়ার কথা অব্দি ভুলে যেতো (এবং আজ, প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরেও যে সেই 'সঙ্গী'কে পেয়ে সব কিছু ভুলে যায় না তা হলফ ক'রে বলা মুশকিল)। কলমের জোরে এন্তার পাঠকের কাজ-ভোলানো সম্মোহন সৃষ্টিকারী কয়েকজন মানুষের একজন ছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগে গত ২৮ শে আগস্ট, প্রায় ৭৫ বছর বয়েসে — একটু অকালেই বলবো — তিনি প্রয়াত হলেন ।
তখন ক্যাডেট কলেজে পড়ি। একদিন দুপুর বেলা, মধ্যাহ্ন ভোজনের পর, লক্ষ্মী ছেলের মতো বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকার যে বাধ্যতামূলক ঘণ্টাখানেক সময়ের নাম 'কোয়ায়েট আওয়ার' বা 'সুনসান প্রহর', তারই মধ্যে একটা জরুরি কাজে রুম ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে ঘরের বাইরে এসেছি, এমন সময় দেখি হাউসের দোতালার সিঁড়ি বেয়ে হাতাকাটা সাদা গেন্জি আর সাদা শর্টস পরে গট গট ক'রে নেমে এলেন বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র এক ভাই, হাতে 'সেবা'-র একটা ঝকমকে বই দোলাতে দোলাতে, এবং সেই অমূল্য রত্নটির অধিকারী হওয়ার সৌভাগ্যে আত্মপ্রসাদের প্রসন্ন হাসি নিয়ে তিনি আমার পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় এক ঝলক দেখতে পেলাম বইটির নান্দনিক কোলাজ শোভিত প্রচ্ছদে 'গড ফাদার' নামটি। শেখ আবদুল হাকিম অনূদিত কোনো বইয়ের সঙ্গে কি সেটাই আমার প্রথম দেখা? বলতে পারবো না। স্মৃতি সহায়তা করছে না। তবে, এক অর্থে তা না-ও হতে পারে। তার কারণ হলো, রোমেনা আফাজের সৃষ্টি 'দস্যু বনহুর' এবং তারপর কাজী আনোয়ার হোসেনের 'কুয়াশা', এই দুই সিরিযের তখন অব্দি প্রকাশিত (প্রায়) সব বই পড়া শেষ ক'রে 'মাসুদ রানা'-র বৃহত্তর ও অপেক্ষাকৃত জটিল কিন্তু আরো উপভোগ্য জগতে পা দিয়েছি সেই 'অপরিণত' বয়েসেই। শেষোক্ত দুটি সিরিযের অনেকগুলো বইয়েরই যে নেপথ্য লেখক বা গোস্ট রাইটার শেখ আবদুল হাকিম সেকথা যদিও আরো অনেক পরে জানবো, কিন্তু আমারই অজান্তে তাঁর লেখনীর সঙ্গে তো বকলমে পরিচয় তাহলে ঘটেই গিয়েছিল মেলা আগে।
সে যাই হোক, পরে তাঁর স্বনামে বের হওয়া মূলত 'গড ফাদার', 'দড়াবাজ স্পাই', 'আততায়ী', 'কামিনী', ইত্যাদি প'ড়েই তাঁর ভক্ত হওয়া, তাঁর গদ্যে প্রভাবিত হওয়া। যদিও কবুল করতে দ্বিধা নেই, স্বনামে লেখা তাঁর খুব বেশি বই পড়া হয়নি। আর লেখার সূত্রে 'সেবা' তথা 'রহস্য পত্রিকা' সংশ্লিষ্টতা খানিকটা থাকার পরেও তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কম। প্রথম দেখা ১৯৮৬ সালের শেষ দিকে, যখন "রহস্য পত্রিকা"র জন্য মার্কিন রহস্য কাহিনীকার জ্যাক রিচি-র (১৯২২ – ১৯৮৩) একটি বড় গল্প রূপান্তর বা অ্যাডাপ্ট ক'রে লেখাটি সশরীরে 'সেবা' প্রকাশনীতে নিয়ে যাই, বেশ সংকোচ নিয়ে। তাঁর সঙ্গে সৌজন্যমূলক কিছু কথা হয়েছিল সেদিন। কুড়ি বছর ছুঁই ছুঁই তরুণের সঙ্গে তিনি স্বভাবসুলভ আন্তরিকভাবেই কথা বলেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কয়েক মাস পরে ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় 'জেগে তাই তো ভাবি' শিরোনামে 'সম্পূ্র্ণ রহস্যোপন্যাস' হিসেবে ছাপা হওয়া সেই লেখাটিই দিয়েই সেবার সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের সূচনা।
কথাটা সর্বজনবিদিত: সাহিত্যের তথাকথিত 'প্রধান বা মূল ধারা'-য় রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা-থ্রিলার-হরর-সায়েন্স ফিকশন তথা সেসবের স্রষ্টারা ব্রাত্য। সেই কারণে, শেখ আবদুল হাকিমসহ অনেকেই সাহিত্যের সুশীল সমাজে প্রকাশ্যে আলোচিত হন না (যদিও, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এসব "ব্রাত্যজনের" লেখা প'ড়েই শৈশবে সুশীল সমাজের বা 'মূলধারা'-র সাহিত্যিকদের অনেকেরই সাহিত্যপ্রেমের সূত্রপাত)। এবং এদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানেই তাঁরা কোনো সাহিত্য পুরস্কার তো দূরের কথা 'অনারেবল মেনশন'টি থেকেও বঞ্চিত হন। মৃত্যুর পরে তাদের মুখটি দেখার সৌভাগ্য হয় না তাঁর পাঠকদের, কারণ তাঁদের প্রতি "শেষ" শ্রদ্ধা জানাবার জন্য তাঁদের মরদেহ শহীদ মিনার, বাংলা একাডেমি বা সেরকম কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ নেই। অথচ গোয়েন্দা, রহস্য কাহিনীর ভক্ত-কে নয়? দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো দার্শনিক, হোর্হে লুইস বোর্হেসের মতো সাহিত্যক যে গোয়েন্দা কাহিনীর ভক্ত ছিলেন তা অনেকেই জানেন। এবং ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে তিনি তাঁর চাইতে দেড় দশকের ছোট বন্ধু আদলফো বিয়ই কাসারেসের সঙ্গে মিলে ইংরজি থেকে অনূদিত বেশ কিছু গোয়েন্দা কাহিনীর সংকলন 'দ্য সেভেন্থ সার্কল' ("El séptimo círculo") প্রকাশ করেন। বলা যায়, এই প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আর্হেন্তিনার সাহিত্য জগতে এই ঘরানার সাহিত্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাহিত্যে ১৯৭৫ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইতালীয় সাহিত্যিক ইউজেনিও মনতালে নাকি একবার বলেছিলেন, "আমি তো কেবল গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ি।" কথাটা পরিহাসের ছলে বলা হয়েছিল, অনুমান করা যায়, কিন্তু সাহিত্যের এই ঘরানার প্রতি যে তাঁর অনুরাগ ছিল সেকথাও বুঝে নিতে আমাদের কষ্ট হয় না। তবে, কোট আনকোট মৌলিক সাহিত্যের কথাই যদি বলি, সেখানেও কি তিনি তাঁর জাত চেনাননি? কাজী আনোয়ার হোসেনের মতো মানুষের চিত্ত বিচলিত করার মতো "অপরিণত পাপ" তো তিনি মাত্র বাইশ বছরেই রচনা করেছিলেন।
শেখ আবদুল হাকিমকে কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, এমন কয়েকজনকে কয়েকবার অনুরোধ করেছিলাম ভদ্রলোকের একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে রাখতে, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে, এবং সম্ভব হলে আমিও সেই আলাপে উপস্থিত থাকতে রাজি ছিলাম, একথা জানতে যে বিশেষভাবে, কী ক'রে, কত দিনে রপ্ত করলেন তিনি এমন সচ্ছন্দ, মনোগ্রাহী, স্মার্ট অনুবাদ ও অ্যাডাপ্টেশনের কৃৎকৌশল। কারা ছিলেন তাঁর পাঠ তালিকায়; কে বা কাঁরা ছিলেন ছিলেন তাঁর মেন্টর, গুরুস্থানীয়, অনুপ্রেরণা। একটি নাম সহজেই অনুমেয়, আর সেটি কাজী আনোয়ার হোসেন; তাঁর সুচারু সম্পাদনা ও তত্ত্বাবধান যে শেখ আবদুল হাকিমকে অনুবাদে অ্যাডাপ্টেশনে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল তা সহজেই অনুমেয়। কেমন ছিল এই দুই সাহিত্যিকের পেশাগত সম্পর্কের রসায়ন (যা, আপনারা জানেন, সাম্প্রতিক সময়ে আবিল হয়ে উঠেছিল); অন্যদের সঙ্গেই বা তা কেমন ছিল, এসব অনেক কিছুই হয়ত উঠে আসতে পারতো সেই কথোপকথনে। শেখ আবদুল হাকিমের প্রচারবিমুখতা, অসুস্থতা এবং আরো দু'একটি কারণে এমন একটি আলাপচারিতা ঘটে উঠতে পারেনি। তাঁর মৃত্যুতে সে সম্ভাবনা চিরতরে তিরোহিত হলো।
তবে, একথা জোর দিয়ে বলতে পারি, শেখ আবদুল হাকিম তাঁর রেখে যাওয়া অজস্র কাজের মধ্যে দিয়ে পাঠকের কাছে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন। বর্তমান সময়ে বাংলা গোয়েন্দা ও থ্রিলার সাহিত্যের জগতে কেউ কেউ যে নিজস্ব কাহিনী নিয়ে সাড়া জাগিয়েছেন তাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, অনেক কিছু শিখেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি যে অগ্রগণ্য তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।