Published : 28 Jun 2021, 02:35 PM
চিত্রকর্ম: এস এম সুলতান
১
২৩ জুন ১৭৫৭ সালে
কোন দেশে কোন দিনমণি
কোন কুঞ্জের আড়ালে
অস্তমিত হয়েছিলো
কোন মহাকালে?
জানা আছে জানা নেই
ঘটনায় পরম্পরায়,
অনন্তকালের বাঁকে সব স্মৃতি
আর ইতিহাস যায় মুছে যায়;
ঘটনারা মাথা কোটে,
খণ্ডজীবিতের বুকে শুধু তড়পায়।
মনে পড়ে,
সেই কবে সুদূর অতীতে
নমরূদ কিংবা ফেরাউন,
পূর্ণআনুগত্যহীনতার
অভিযোগ এনে কত ভ্রূণ
আর সত্যস্বর মানুষকে খুন
করেছিলো বিনাদোষে!
রুদ্ররোষে
ক্ষমতাপূজারী যারা
স্বৈরতন্ত্রী শাসক শাদ্দাদ,
মহাকালে ঘূর্ণিপাকে
মহূর্তেই পড়েছিলো বাদ;
মানবমমতা ছাড়া
সভ্যতার হয় না আবাদ।
ক্ষমতার দ্বন্দ্বে যারা
বারবার ঘুরপাক খায়,
তারা কোনদিন সদাচারী
মমতার দেখা নাহি পায়,
খড়বিচালির মত তারা
সময়ের আবর্তে হারায়।
না সিরাজ না মোহাম্মদী বেগ,
কোনদিন ব্যক্তি কেউ নয়,
কে যে পক্ষে কে বিপক্ষে
তা-ও শেষ কথা নয়;
বোধগম্য নয় কোন্ স্বার্থে
মীরজাফর বা ঘসেটি বেগম
আমিত্বের পরিচয় ভুলে গিয়ে
পরাজয় করেছে হজম;
আত্মহননের গ্লানি কেন
মেনেছিলো পলাশী স্বয়ং,
কেন আম্রকুঞ্জে অন্তর্হিত
এ-বাংলার সূর্যাস্তের রং?
কোনোকালে দায়ী নয় জনগণ,
দায়ী শুধু গদীলোভী ক্ষমতান্ধ গং,
আর শাসকের শোষকের
আত্মপর অলীক অহং।
নাকি সকলে নিমিত্ত মাত্র,
সকলে দর্শক?
নাকি সকলেই অসহায়
কাল-ক্রীড়নক?
কেননা চক্রান্ত যারা করে
তারা মেরুদণ্ডহীন,
অন্যের অধীন যারা,
তারা কোনদিন হয়নি স্বাধীন,
দেশে দেশে কালে কালে
স্বেচ্ছা-উদ্বাস্তুরা পরিচয়হীন;
দেশহীন জাতিহীন
গোত্রহীন ভিটেবাড়িহীন
তারা সব স্বার্থান্বেষী,
ভূগোলের ভুলসৃষ্টি,
জন্মান্ধ জারজ;
তমসার ছায়া তারা,
প্রেতাত্মার গর্ভজাত
সহিংস আত্মজ;
উদিত হয় না তারা, উদয়ের
আগে শুধু নিজে অস্ত যায়,
পরিচয়হীন আঁধারের যাত্রী
তারা, স্বেচ্ছা-ছলনার নায়।
২
অনন্ত উদিত শুধু স্বাধীনতা,
যায় না সে অস্ত কোনদিন,
চলমান ঘূর্ণ্যমান, কোনকালে
নাই তার উদয়াস্ত ঋণ;
আপন অক্ষের ভারে ব্রহ্মাণ্ডের
অক্ষে অক্ষে সতত সচল;
মানুষের দূরবীণ সম্পূর্ণ দেখে না,
মধ্যপথে সহসা অচল;
মাইল মাইল পার হয়ে থেমে যায়
গতিমান তার দৃষ্টিভার;
কেবল আকার দেখে, দেখে না সে
কোনোকালে কোনো নিরাকার।
আকারে ও নিরাকারে
স্বাধীনতা চির সূ্র্যোদয়;
একদিকে অস্ত গিয়ে অন্য
দিকে নিয়মিত উদিত সে হয়;
অস্তহীন অন্তহীন সত্যোদয়,
অনন্তেও হয় না বিলয়।
যে চোখ তাকায় তাকে
সে-ই শুধু অস্তমিত হয়,
দৃষ্টি যার বৃত্তাবদ্ধ,
শক্তি যার সীমাহীন নয়।
অপূর্ণতা দোষে দোষী,
দৃষ্টি যার নয় সর্বভেদী,
সে-ও কিন্তু প্রায়-অন্ধ,
দৃষ্টি তার নয় অন্তর্ভেদী।
তেমন দৃষ্টিতে যারা দেখে,
সেই দেখা অর্ধ দেখা বটে,
দেখে যা তা সত্য নয়,
সত্য বটে প্রকৃত যা ঘটে।
প্রকৃত প্রকৃতি দেখে,
অন্য কেউ দেখে শুধু কিছু,
প্রকৃতির চোখে চোখ রেখে
সব দ্রষ্টা চোখ করে নিচু।
পলাশীতে কি ঘটেছে
আদ্যোপান্ত আমরা দেখিনি,
পরাজয়ে বিজয়ের
সূচনাও আমরা শিখিনি।
প্রাচ্যের দর্শনসত্যে
প্রতীচ্যের প্রকৃষ্ট বিজ্ঞান,
বণিক শাসক এসে দিয়ে
গেছে সারা পৃথিবীর জ্ঞান।
জনযুূদ্ধ আনে জয়,
পরাজয় সত্য নয়,
জয় সত্য মুক্ত মানবের;
মু্ক্তবিশ্ব কেবল মুক্তিযোদ্ধার,
কোনোকালে নয় দানবের।
মানবতা সমতা মমতা
প্রত্যাসন্ন যদি দেশে দেশে,
প্রাণে প্রাণে প্রাণসাম্য,
প্রাণী যদি প্রাণে প্রাণে মেশে।
পলাশী, পলাশী!
পরাজয়ে জয় হয়ে
বেজে ওঠে বাঁশি
যখন যেখানে;
ক্ষীয়মাণ সভ্যতার
ভস্মস্তূপও সেখানে
নব এক সভ্যতার
বার্তা বয়ে আনে।
পলাশী, পলাশী
আবার বাজাও তুমি
পূর্ব আর পশ্চিমের
উদয়ের অনস্তের
জোড়া প্রাণবাঁশি
জোড়া প্রাণবাঁশি।
৩
কালে কালে
২৩ জুন ১৯৪৯ সালে
বুড়িগঙ্গা তীরে
পুনরায় পলাশীর সূর্য এলো
রোজগার্ডেনের বুকে ফিরে,
পুরনো ঢাকার বুকে দেখা দিলো
শতাব্দীর জোড়া অন্ধকার চিরে;
মাঝখানে বয়ে গেছে খণ্ডকাল,
একশ বিরানব্বই মানব-বছর;
অবাক তাকায় শুধু বুড়িগঙ্গা,
চন্দ্রতারা, গঙ্গাপদ্মাচর —
মহাকাশে মহাকর্ষ কিছু তার
রাখে কি খবর?!
ঘরে ঘরে মীরজাফরেরা,
যারা মিলেছিলো আত্মপর,
ভিনদেশি দস্যু বেনিয়ার সাথে
তারাও উধাও হলো কখন যে
কোন দিকে কোন অমারাতে
খেয়াল করিনি আমি, তুমি
কিংবা সবুজের পলিসিক্ত ভূমি;
আমরা দেখেছি শুধু তিতুমীর,
সূর্যসেন, মুক্তিযোদ্ধা রুমী, —
সিপাহী বিদ্রোহ থেকে জনে জনে
জনযুদ্ধ, জনতার নির্বিকল্প রায়,
দেখেছি ঘাতক আর হানাদার
বেনিয়া ও লুটেরার নিঃশর্ত বিদায়;
উপমহাদেশ থেকে যেতে যেতে
বেনিয়ারা পুঁতে গেছে ধর্মের বিভেদ;
বাঙালি অভয়বাদী, বুঝে নেয়
খুব দ্রুত নজরুলের সুন্দর-অভেদ;
সত্য সর্বত্র বিরাজমান
কোরান পুরাণ ত্রিপটক উপনিষদ
বাইবেল থেকে জিন্দাবেস্তা সর্ববেদ;
চিত্রকর্ম: এস এম সুলতান
এ পথেই আলো মেলে
রোজগার্ডেনের বুকে কুপি জ্বেলে
জাতিবাঙালির ধ্রুব ভাষিক উদয়;
অনন্তর এ বঙ্গ বদ্বীপ জুড়ে
বাঙালির বুকে মুখে
জয় বাংলা, বাংলার জয়,
বঙ্গজননীর সব ভূমিসন্তানের জয়;
ঘাতকেরা সবাই উধাও
সময় সৈকত থেকে,
এ বাংলার ভূমিজল থেকে,
পরাজয় মেনে নিয়ে বিষধর
সাপেদের মতো এঁকেবেঁকে
তারা খু্ঁজে নেয় নিজের কবর।
বীরেরা দাঁড়িয়ে থাকে, রাত্রিদিনমান;
কারাবাসে কোনোকালে হারায় না তারা;
বাঙালি বীরের জাতি, সুঠাম সটান,
তারা জাতিপিতা মুজিবের খাড়া শিরদাঁড়া।
রোজগার্ডেনের বুকে গতায়ু সন্তাপ;
ফুটে আছে থোকা থোকা মানবগোলাপ;
ভাসানী, শামসুল হক, সোহরাওয়ার্দী থেকে
বিদ্রোহী মুজিব; তারা দেখে বিষধর সাপ
পেঁচিয়ে ধরেছে যারা সোনার বাংলাকে,
সবাই বহিরাগত, ভিনদেশি তারা;
ধর্মের লেবাস পরে গণবাঙালির
জন্যে যারা বানিয়েছে অধর্মের কারা;
স্বীকার করে না তারা বাঙালির
মাতৃভাষা, মাঠঘাট, পাঠ ও লেবাস;
বহিরাগত যারা তারা গোত্রদম্ভে ভাবে
রাজা নিজেদের, আর বাঙালিরা
যেন জন্মপ্রজা, শুধু হুকুমের দাস!।
হায়, জানে না পড়তে তারা নিয়তিকে খাস!
এভাবে বিভেদ বাড়ে দিনে দিনে বাঙালির
সঙ্গে দখলকারের, গৃহস্থের সঙ্গে ভিনদেশির;
বাঙালি অজেয় জাতি, অনন্ত অপরাজেয়,
চিরসমুন্নত শির, বুকে তার হাড় দধীচির।
অনন্তর বজ্রে বজ্রে বাজে বাঁশি,
মুখে তার অগ্নিহাসি শত্রুনাশী,
যুদ্ধে-যুদ্ধে নটরাজ নাচে ঘূর্ণিশিব;
ভাঙরে ভাঙরে কারা,
দাড়া শিরদাঁড়া করে খাড়া,
যুদ্ধে-যুদ্ধে শিব অজেয় মুজিব।
চিত্রকর্ম: শাহাবুদ্দিন আহমেদ
অনন্তর
মুজিব আমার নেতা,
মুজিব তোমার নেতা,
মুজিব তো জাতিপিতা
বীর বাঙালির;
বাঙালি বিদ্রোহী জাতি,
মানুষে মানুষে জ্ঞাতি,
চিরদিন সমুন্নত
মুক্ত বাঙালির শির।
রোজগার্ডেনের বুকে
সেই থেকে শুরু হলো
বাঙালির অস্তিত্বের
বিজয়ী লড়াই;
বাঙালি অজেয় জাতি,
গণযুদ্ধে জনযুদ্ধে
কোনোকালে বাঙালির
আর কোনো পরাজয় নাই
আর কোনো পরাজয় নাই
আর কোনো পরাজয় নাই।
২৪-২৮.০৬.২০২১