বাঙালির ইতিহাস নেই– বঙ্কিমচন্দ্রের এই আক্ষেপ আজও মিথ্যে নয়।
Published : 17 Jun 2024, 07:12 PM
এ কথা সবার জানা যে, গত শতাব্দীর ভারত ভাগের সঙ্গে বাংলা ভাগ হয়ে মুসলমানপ্রধান পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে এবং হিন্দুপ্রধান পশ্চিম বাংলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে এই দুই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে পরিবর্তন ঘটে তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলা সাহিত্যে অনেক রূপান্তর দেখা দিয়েছে। বাংলা দুই ভাগ হবার আগের আবহমান বাংলাসাহিত্যের একটা অখণ্ড ভাবলোক হয়তো আমাদের কল্পনায় ছিল, কিন্তু দুই বাংলার মানুষের মানসগঠনে দুই অংশের সমাজপ্রকৃতির ভিন্নতার প্রভাব ছিল সুদূর অতীত কাল থকেই। ‘বাংলার কাব্য’ বইয়ে এই ভিন্নতার স্বভাবকে চমৎকারভাবে চিহ্নিত করেছিলেন হুমায়ুন কবির। তিনি বলেছিলেন, ‘শালবন আর কাঁকর ছড়ানো পথের প্রান্তর পেরোনো দিগন্তে দৃষ্টিসীমার বাইরে মিলিয়ে যাওয়া, শীর্ণ জলধারার গভীর রেখা কেটে চলা দীর্ঘ সংখ্যাহীন শ্রোতস্বিনীর প্রবাহ, বাতাসের তীব্রতার আভাস কিংবা তপ্ত রৌদ্রালোকে মুর্ছাহত ধরণী পশ্চিম-বাঙলার মানুষের অন্তরকে উদাস করে তোলে।’ তিনি যথার্থই মনে করেছিলেন, 'পশ্চিম-বাঙলার প্রকৃতি তাই বাঙালীর কবিমানসকে যে রূপ দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে লোকাতীত রহস্যের আভাস। অনির্বচনীয়ের আস্বাদে অন্তর সেখানে উন্মুখ ও প্রত্যাশী, জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম ও প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণ।’
অন্যদিকে তাঁর পর্যবেক্ষণে, পূর্ব বাঙলার নিসর্গ মানুষের হৃদয়কে ভাবুক করলেও উদাসী করেনি। দিগন্তপ্রসারিত প্রান্তরের অভাব সেখানে না থাকলেও এখানকার 'প্রান্তরে রয়েছে অহোরাত্র জীবনের চঞ্চল লীলা।’ তাঁর উপলব্ধিতে ধরা পড়েছে 'পদ্মা-যমুনা-মেঘনার অবিরাম স্রোতোধারায়’ একদিকে 'নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস’ ডেকে আনে। 'প্রকৃতির বিপুল শক্তি নিয়তই উদ্যত হয়ে’ থাকে, 'কখন আঘাত করবে তার ঠিকানা নেই।’ পূর্ব-বঙ্গের অধিবাসী হিশেবে তিনি লক্ষ করেন, 'কূলে কূলে জল ভরে ওঠে, সোনার ধানে পৃথিবী ঐশ্বর্য্যময়ী, আর সেই জীবন ও মরণের অনন্ত দোলার মধ্যে সংগ্রামশীল’ এখানকার মানুষ। তিনি অনুভব করেন, ‘প্রকৃতির ঔদার্য্য, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের সংহত শক্তি ভোলবার অবসর সে পায় না! তাঁর মননে ধরা পড়ে, 'চরের মানুষ নদীর সাথে লড়াই করে, জলের ঐশ্বর্য্যকে লুটে জীবনের উপাদান আনে। তাই লোকাতীতের মহত্ত্ব হৃদয়কে সেখানে স্পর্শ করে, কিন্তু মনের দিগন্তকে প্রসারিত করেই তার পরিসমাপ্তি। প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণের সেখানে অবকাশ’ নেই !
হুমায়ুন কবির যখন এ-কথা বলছেন তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত বাংলাদেশের কথা ভাবতে পারেনি। কিন্তু কিছুকাল পরেই বাংলার মুসলমানের আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের মধ্যে মুক্তির পথ খুঁজে পেলে খণ্ডিত বাঙলার পূর্ব-ভাগের পাকিস্তানের অংশে পরিণত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। দ্বিজাতিতত্ত্বের যে শর্তটি বাঙলার মুসলমানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে পারেনি। কারণ মুসলমানিত্বের আবরণের অন্তরালে প্রকৃতপক্ষে বাঙলার কৃষিনির্ভর মুসলমান সমাজের ইহজাগতিক আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দিতে পারেনি পাকিস্তান রাষ্ট্র। গত শতাব্দীর বিশের দশকে এই সমাজে মননশীলতার যে যাত্রা শুরু তা পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিশীলতার দিকেও তাদের এগিয়ে দেয়। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে কবিতা ও কথাসাহিত্যে যে নানামুখী উদ্ভাসন হয় এর প্রকৃত প্রেরণা ইহজাগতিক, যদিও বাঙালির মুসলমানিত্ব এর সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই বিবেচনা থেকেই বলা যায়, বাংলাদেশের সাহিত্যসৃষ্টির সূচনা ছিল প্রধানত বাঙালি মুসলমানের ইহজাগতিক আকাঙ্ক্ষার উজ্জীবনের চিহ্ন। পাকিস্তান আন্দোলন কৃষিনির্ভর বাঙালি মুসলমানের ইহজাগতিক আকাঙ্ক্ষার উজ্জীবনের প্রতিক্রিয়া হিশেবে মধ্যবিত্তে উত্তরণের একটি উত্তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এরই হাত ধরে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলাসাহিত্যের আধুনিকবাদের অনুসরণে ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যের ভুবনে আধুনিকবাদের চর্চা শুরু হয়। এটা সম্ভব হতে পারার কারণ ততদিনে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় ঢাকায় দ্রুত নগর সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। বাড়তে থাকে গ্রাম ও শহরের ব্যাবধান। সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটতে শুরু করে ব্যক্তির সার্বিকতায়। সাহিত্যের নবধারা সূচিত হয় এরই প্রভাবে।
নগর গড়ে ওঠার আগে মানুষের জীবনযাপনের আনন্দবেদনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের মাধ্যম ছিল সাহিত্য। নাগরিক সাহিত্যেও গ্রামজীবনের সৌন্দর্যের অপস্রিয়মাণতা ও নগরজীবনের অনিবার্যতার দ্বন্দ্ব পরিস্ফুটিত হতে থাকে। নতুন নতুন জীবিকার উদ্ভব হলে জনজীবনে যেমন নাগরিক বৈচিত্র্য বাড়তে থাকে সাহিত্যেও তেমনি পরিলক্ষিত হতে থাকে এর ছাপ। বিশেষ করে কথাসাহিত্য সমৃদ্ধ হতে থাকে এর মধ্য দিয়ে। যদিও নগরের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক জীবনের প্রতিফলন দেখার তৃষ্ণা মেটানোর মতো সাহিত্যের নিদর্শন ছিল এখানে কম। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সস্তা কথাসাহিত্যের প্রতাপ ছিল প্রায় দুই যুগ। এর মধ্যেই জেগে উঠতে থাকে আমাদের সাহিত্যও। কথাসাহিত্যের চেয়ে কবিতার প্রাচুর্য চোখে পড়ে বেশি। পশ্চিমবঙ্গের অনুসরণে স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। ফলস্বরূপ নাট্যসাহিত্যেরও চর্চা চলে। এমনো বলা হতে থাকে যে, বাংলাদেশের থিয়েটার শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে সমৃদ্ধ। নাটকের দলগুলোর সংগঠিত সক্রিয়তায় ব্যাপারটি বেশি দৃশ্যমান হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনামলে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন থাকা সত্ত্বেও নাটকের দলগুলো নানা প্রতীক ও রূপকের আড়ালে স্বৈরাচার বিরোধী বক্তব্যে, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবল্যে অপস্রিয়মাণ গ্রামীণ সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের জনজীবনে দীর্ঘকালীন সামরিক শাসনের প্রভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা কবিতার ওপরও প্রভাব ফেলে। আধুনিকবাদিতা, লেকায়তিকতা ও প্রাকৃতিকতায় বাংলাদেশের কবিতার আধুনিক রূপ পশ্চিমবঙ্গের কবিতার চেয়ে হয়ে উঠতে থাকে ভিন্ন ধরনের সজীবতায় উজ্জ্বল। ছোটগল্পের রূপকল্পেও দেখা দেয় বৈচিত্র্য। কবিতা বা উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের পাঠকপ্রিয়তা খানিক কম মনে হতে পারে। কিন্তু রূপকল্পের স্বতন্ত্র্যে ও বিষয়বৈচিত্র্যে ছোটগল্পও বাংলাদেশের সাহিত্যে বিশিষ্টতা অর্জন করে; নানা নিরীক্ষায় হতে থাকে উজ্জ্বল। এই বৈচিত্র্যের তাগিদ থেকেই বের হতে থাকে একের পর এক সংকলন। বিশেষ করে দশকওয়ারী সংকলন প্রকাশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় উদ্যোগই চোখে পড়ে। সৃজনশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক যুক্তসংরূপের নাম ব্যক্তিগত প্রবন্ধ বা রচনাসাহিত্য। এই ক্ষেত্রেও আমাদের সাহিত্য ব্যাপক না হলেও একেবারে নিঃস্ব নয়!
আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বলার আছে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবের কথা। গল্প কবিতা নাটক বা উপন্যাস—প্রতিটি সৃজনশীল শিল্পসংরূপই মুক্তিযুদ্ধপ্রভাবিত হয়ে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকাল বা উত্তর কাল বাংলাদেশের সাহিত্যমানস গড়ে দেয়ায় পটভূমিতে এমন প্রবল প্রভাব রেখেছে যে তা আলাদাভাবে উল্লেখ করবার বিষয়। যদিও একটা হতাশাও প্রায়শই ধ্বনিত হয় যে জাতীয় জীবনের এত বড় একটি ঘটনার অভিঘাত যতটা মহৎ হয়ে উঠবার কথা আমাদের সাহিত্যে ততটা মহৎ হতে পারে নি। অবশ্য কালীক দূরত্ব না ঘটলে এই সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করা যাবে না। অনেকেই মনে করেন নেই নেই করে আমাদের সাহিত্য মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাতে অনেকটাই পরিণতি অর্জন করেছে। আমাদের সৃষ্টিশীল সাহিত্যের ইতিহাসচেতনাই যুদ্ধোত্তর সামরিক-গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর স্বাধীনতা- চেতনার বিরোধী শক্তিকে মোকাবেলা করেছে।
সাধারণত সৃষ্টিশীল ও মননশীল সাহিত্যের আসরে শিশুসাহিত্যের সামগ্রিক অবস্থার মূল্যায়ন করা হয় না। ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণে আনন্দময় ও প্রগতিশীল মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করেছে আমাদের শিশুসাহিত্যে। বাঙলার আবহমান লোকসাহিত্য থেকে ছড়া, রূপকথা ও লোককথা বারবার পুনর্কথিত ও নবায়িত হয়েছে। কিশোরদের মনে আলো দিয়েছে চিরায়ত পৌরাণিক সাহিত্যের পুনর্কথিত রূপ। এ ছাড়াও বিচিত্র বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে শিশুসাহিত্যেও। লেখা হয়েছে প্রচুর জীবনীগ্রন্থ। শিশুসাহিত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলোতে রয়েছে জাতিগঠনের আকাঙ্ক্ষা। বিশ্বায়নের প্রভাবে প্রযুক্তিক বিপ্লবের অভিঘাতে সাম্প্রতিক কালে শিশুসাহিত্য খানিকটা দিকভ্রান্ত হলেও এর উৎকর্ষের আকাঙ্ক্ষা নিঃশেষিত হয়ে যায় নি। শিশুসাহিত্যের গল্প-উপন্যাসের বিভাগ নিয়ে খুব উচ্চাশা করা না গেলেও তা একেবারে হতাশ হবার মতো নয়!
স্বাধীনতাপূর্বকালে কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা অর্জনকারী লেখক যেখানে প্রায় ছিলেনই না সেখানে স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ-রকম লেখক পাওয়া গেল বেশ কয়েকজন। নগরমানসী পাঠকের কথাসাহিত্যতৃষ্ণা মেটাবার দায় তারাই মোচন করেছেন। কিশোরপাঠ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ-রকম লেখক খুব বেশি পাওয়া যায় নি। কয়েকজন প্রতিভাবান ও অতিপ্রজ ছড়ালেখককে পাওয়া গেছে আমাদের শিশুসাহিত্যে। যদিও ছড়ার বই প্রকাশের ক্ষেত্রে ছোটদের বয়সের বিবেচনা করা হয়েছে কমই! ছড়ামাত্রই যেমন ছোটদের নয় তেমনি বড়দের আসরে তার মর্যাদাও হয়েছে কম; অথচ প্রাচুর্যের দেখা মিলেছে ছড়ার ক্ষেত্রে যথেষ্টই। আবার এই হতাশাও ব্যক্ত হতে দেখা যায় যে, নতুন বিশ্বব্যবস্থার বাস্তবতায় বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের পরস্পরসম্বন্ধসূচকের দিক থেকে নবীন সুর লক্ষযোগ্য হচ্ছে খুবই কম! বাঙালির ইতিহাস নেই– বঙ্কিমচন্দ্রের এই আক্ষেপ আজও মিথ্যে নয়। জাতীয় রাজনীতির নানা ঘোরপ্যাঁচে বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক সত্যকে প্রায়শই বিস্মৃত হতে হয়েছে। কিন্তু তার পরেও বাংলাদেশের মানুষের অগ্রযাত্রার চিহ্নকেই ধরে আছে আমাদের মননশীল সাহিত্য। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলেছে বাংলাদেশের গবেষকদের হাতেই! তাদের উদ্যমেই সন্ধান মিলেছে অনেক প্রত্নজিজ্ঞাসার। অনেক দুর্বলতার মধ্যেও আত্মজিজ্ঞাসায় ঋদ্ধ আমাদের প্রবন্ধ-গবেষণার কথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। অথবা হয়তো বলা যাবে আমাদের সাহিত্যের প্রবন্ধ-গবেষণার শাখাটি আত্মজিজ্ঞাসায় ও আবিষ্কারের নেশায় সমৃদ্ধতর। সাহিত্যের এই অংশের ভূগোলটিই সবচেয়ে বিস্তৃত। দর্শন ও বিজ্ঞানের চর্চায়ও এই শাখাটি অগ্রসরমাণ।
কারিগরি সুবিধার প্রণোদনায় সর্বক্ষেত্রেই প্রকাশনার সংখ্যা বিপুল হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে গুণগত গড় মান নিয়ে। এই প্রশ্নটি অনুবাদ-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রকট। স্বাধীনতাপূর্ব কালে চিরায়তের দিকে ছিল আমাদের অনুবাদসাহিত্যের নির্দেশনা। স্বাধীনতা-উত্তর কালে তা বিস্তরিত হয়েছে সাম্প্রতিকতার দিকে। মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও বিগত দেড়-দুই যুগ ধরে সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যের নিদর্শন বাংলায় অনূদিত হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বেশ কয়েক বছর ইংরেজিভাষার চর্চা একেবারে কমে গেলেও সাম্প্রতিককালে ইংরেজি চর্চা বেড়েছে। যোগাযোগে উন্নতির প্রভাবে ইংরেজি ভাষার সাহিত্য এখন অনেকটাই সহজলভ্য। আবার এ-কথাও সত্য যে শিক্ষাব্যবস্থার বৈগুণ্যে দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ উন্নত ইংরেজি জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য এখনও অনুবাদই ভরসা! আবার আমাদের সাহিত্যিক উন্নতির স্বার্থেও উন্নত অনুবাদের চর্চা অব্যাহত রাখা জরুরি এই সচেতনতাও আমাদের কোনো কোনো অনুবাদকের রয়েছে। সাতচল্লিশ-উত্তর কাল থেকে ইহজাগতিকতায় আমাদের সমাজে যে জাগরণ শুরু হয়েছিল তার ফল দেখা গেল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে। প্রচুরসংখ্যক কর্মিষ্ঠ মানুষের আত্মজীবনী স্মৃতিকথায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে আমাদের গদ্যসাহিত্য। এই সাহিত্য যত না শৈল্পিকতাপ্রয়াসী তারচেয়ে বেশি জীবনসন্ধানী ।
এই রচনার শুরুতে হুমায়ুন কবিরের দোহাই দিয়ে বাংলাসাহিত্যের যে রূপকল্প উপস্থাপন করা হয়েছে বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাবে তা আর কতদূর অস্তিত্বশীল থাকবে তা এক বিরাট প্রশ্ন। আমাদের সংস্কৃতির মৌলিক অনুষঙ্গগুলো বিশ্বয়নপ্রভাবে যেমন বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাতে আমাদের সাহিত্যচর্চার গতিমুখ কোন দিকে যাবে সেই প্রশ্ন বড় না হয়ে পারে না। তবে প্রশ্ন করতে পারি, আমাদের নিজস্বতাগুলোর বিলীন হওয়া যদি অনিবার্যই হয় তাহলে আমাদের সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য গড়ে তোলা হবে কোন ভিত্তির ওপরে? একবিশ্বের বৈচিত্র্যহীনতার মধ্যে কি তাহলে আমাদের সাহিত্যকে বিলীনই হয়ে পড়তে হবে? নাকি আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে এই পরিবর্তন। সুতরাং সঙ্গত কারণেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই প্রশ্নগুলোকে নিয়ে কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে তার ওপরে নির্ভর করবে আমাদের সাহিত্যেরও ভবিষ্যৎ। বিশ্বায়নপ্রভাবিত বিশ্ব ক্রমশ যেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে তার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের ভবিষ্যতের সাহিত্যিকদেরকেও; তাদের আহ্বান জানাতে হবে আমাদের ভবিষ্যতের রেনেসাঁসকে।