বই বিপণনে অনলাইন পদ্ধতিতে প্রসার ঘটেছে করোনার কারণে

অলাত এহ্সান
Published : 7 Feb 2021, 07:21 AM
Updated : 7 Feb 2021, 07:21 AM

বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে ছিল বাংলা ভাষার অধিকার। এই অধিকারের জন্য শহীদ হয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানেরা। তাদের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসকে নানান অনুষ্ঠান ও মেলায় রাঙিয়ে তোলা। মাসব্যাপী বইমেলা তারই এক অনন্য রূপ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক আ্ত্মপরিচয়েরও এক প্রকাশ যেখানে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলন ঘটে। কিন্তু কোভিড ১৯-এর কারণে এবারের বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে না হয়ে, জনগণের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মার্চের ১৮ তারিখে শুরু হতে যাচ্ছে। শত শত প্রকাশকের অংশগ্রহণে মুখরিত বইমেলা আমাদের মন ও মননের এক নান্দনিক অভিব্যক্তি। গত কয়েক বছর ধরে কম করে হলেও প্রতি বছর চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। গতবছর প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ হাজারের মতো নতুন বই। কিন্তু বাংলা একাডেমির মতে এর সবটাই মানসম্পন্ন নয়। বড় জোর সাড়ে সাত শ' বইকে তারা মানসম্পন্ন বই বলে মনে করেন। প্রতি বছরই মেলায় বইয়ের বিক্রি বাড়লেও লেখকরা তাদের রয়ালটি ঠিকমত পাচ্ছেন কিনা, তার কোনো বিধিবদ্ধ রূপ আদৌ আছে কিনা তা অনেক লেখকেরই জানা নেই্। বই উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে– এই বিষয়টিও বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকদের একটি প্রধান কৌতূহল। করোনা ভাইরাস প্রকাশনাশিল্পকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পক্ষে তরুণ গল্পকার অলাত এহসান এসব কৌতূহল ও প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশকদের। প্রতি পর্বে মোট পাঁচজন প্রকাশকের অভিমত প্রকাশিত হবে গোটা ফেব্রুয়ারি মাসে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব। এতে অংশগ্রহণ করেছে অনন্যা, কথাপ্রকাশ, সংবেদ, দ্যু প্রকাশন এবং জয়তী। বি.স

…………………….
স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বই ক্রয় করলে এর বিকাশ ঘটবে বলে আমি বিশ্বাস করি
মো. মনিরুল হক, প্রকাশক, অনন্যা
…………………….


বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
মনিরুল হক: করোনায় ব্যাপক প্রভাব পরেছে এই পুস্তক ব্যবসায়। কারণ, দেশের স্কুল কলেজ বন্ধ এখন পর্যন্ত এবং দেশ-বিদেশের সমস্ত বইমেলা বন্ধ। যদিও মধ্যমার্চে দেশে বইমেলা হওয়া কথা আছে।

বিডিনিউজ: বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে অনন্যা কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
মনিরুল হক: এখন ডিজিটাল যুগ, তাই আমাদের বেশিরভাগ বই এর প্রচারণা আমরা বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে করে থাকি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী কি এসব মেনে চলছে?
মনিরুল হক: আমরা প্রথমেই চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেই এবং আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি মেনেই আমরা বই প্রকাশ করি। প্রতি বছর লেখকদের যথাযথ পাওনা পরিশোধ করে থাকি।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। অনন্যা এটা কিভাবে করছে?
মনিরুল হক: আমাদের বইয়ের বাজারটা অনেক ছোট, তাই আমাদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে সম্পাদনা করে বই প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। আমাদের নিজস্ব একটি প্যানেল থেকেই যাচাই-বাছাই করে বইগুলো প্রকাশ করা হয়।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনাশিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
মনিরুল হক: আসলে আমাদের দেশে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বই ক্রয় করলে এর বিকাশ ঘটবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
মনিরুল হক: এই মনোভাবের সাথে আমি একমত নই। আমরা সারা বছরই বই প্রকাশ ও বিপণন করার চেষ্টা করি। ফেব্রুয়ারি মেলা একটি বড় উৎসব, সেখানে কিছুটা বই বেশি বিক্রি হয় এবং লেখক-পাঠক সবাই নতুন বই এর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।

বিডিনিউজ: অনন্যা বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে?
মনিরুল হক: আমরা চেষ্টা করি গুণগত মান যাচাই বাছাই করে সব ধরণের বই প্রকাশ করতে।

বিডিনিউজ: এ বছর কী কী বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে অনন্যা?
মনিরুল হক: আমরা বরাবরের মত এ বছরও গল্প, উপন্যাস, বিজ্ঞান, কবিতাসহ আরও অনেক ধরণের বই প্রকাশ করেছি।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
মনিরুল হক: আমরাও ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুনতাসির মামুনের 'বঙ্গবন্ধুর জীবন'।

বিডিনিউজ: বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
মনিরুল হক: আমরা সবসময়য়েই নবীন লেখকদের বই প্রকাশ করে থাকি। আমরা প্রতি বছরই অসংখ্য নবীন লেখকদের লেখার পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করে থাকি এবং এর থেকেই যাচাই বাছাই করে, যারা ভাল লিখছেন এবং সম্ভাবনাময়, তাদের লেখা প্রকাশ এবং প্রচার করে থাকি।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
মনিরুল হক: অবশ্যই। আমাদের তরুণ লেখকদের বিকাশ ঘটাতে হবে। এর জন্য তাদের প্রচুর লিখতে হবে, যেখানেই তারা সুযোগ পায় না কেন।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, মনিরুল ভাই, সময় দেয়ার জন্য।
মনিরুল হক: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

…………………….
প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিলে মেধা বিকাশে ও মননশীল পাঠক তৈরিতে প্রকাশনা শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে
মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, প্রকাশক, কথাপ্রকাশ
…………………….


বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
জসিম উদ্দিন: করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তাই পুস্তক ব্যবসার উপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। প্রথমত ভাইরাসজনিত কারণে সবকিছু চলছে সীমিত পরিসরে। কয়েকমাস বইবিপণিগুলো বন্ধ ছিল। ফলে বই বিক্রির পরিমাণ ছিল শূন্যের কোঠায়। বর্তমানে সীমিত পরিসরে সবকিছু চালু হলেও অর্থনৈতিক মন্দায় বই বিক্রির পরিমাণও সেভাবে বাড়েনি। ফলে পুস্তক ব্যবসায় করোনার প্রভাব রয়েছে প্রবলভাবে এবং এটি খুব দ্রুতই কেটে যাবে— এমনটি ভাবারও উপযুক্ত কারণ আমরা দেখছি না।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপণনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপণন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে কথাপ্রকাশ কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
জসিম উদ্দিন: এক্ষেত্রে আমি মনে করি বই বিপণনে অনলাইন পদ্ধতিতে প্রসার ঘটেছে করোনা পরিস্থিতির কারণে। সশরীরে কোনো ক্রেতা বইবিপণি থেকে বই কিনতে না পারলেও অনলাইন থেকে সহজেই বই কিনতে পারছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ঘর থেকে বের হতে না পারা বা বর্তমান সময়ে সীমিত পরিসরে বের হতে পারলেও অনলাইনে সহজেই বই কেনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই কথাপ্রকাশ ও সারাদেশে বই বাজারজাতকরণের পাশাপাশি অনলাইনে প্রচার ও বই বিপণনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।

বিডিনিউজ: কাঁটাবন এলাকাসহ ঢাকার নানান স্থানে কয়েকটি বইয়ের আউটলেট উঠে গেছে। এটা কি শুধুই করোনার কারণ বলবেন, না কি সারা বছর মানুষের যে পাঠ স্বল্পতা, তারই ঘনীভূত প্রভাব বলবেন? কারণ এতদিনের ব্যবসায় সাময়িক দুর্যোগেও কি দাঁড়িয়ে থাকার কোনো সঞ্চয় দেয়নি— এই প্রশ্ন সামনেই আসে।
জসিম উদ্দিন: ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সারাদেশে বইয়ের পাঠক কম নয়। ফলে করোনা পরিস্থিতিতে সে পরিমাণ বইবিপণি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়নি। শুধু কাঁটাবন এবং আজিজ মার্কেট দিয়েই সারাদেশের বই বিক্রির দুর্যোগের কথা তুলে ধরা ঠিক হবে না। কথাপ্রকাশ এই সময়েও আশাবাদী এবং ক্রেতা বা পাঠকের জন্য বিভাগীয় শহরে আমরা কথাপ্রকাশ-এর আউটলেট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা ওঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী এসব কতটা মেনে চলছে?
জসিম উদ্দিন: চাইলেই কোনো লেখক কথাপ্রকাশ থেকে বই প্রকাশ করতে পারে না। কথাপ্রকাশের নিজস্ব সম্পাদনা পরিষদ রয়েছে। মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপি বাছাই প্রক্রিয়ায় সম্পাদনার মাধ্যমে বই প্রকাশ করে থাকে। লেখকের সঙ্গে চুক্তিসহ সকল ধরনের আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক বই প্রকাশ এবং লেখককে তার রয়্যালটি প্রদান করা কথাপ্রকাশের নীতির একটি অংশ।

বিডিনিউজ: কথাপ্রকাশ ইতিমধ্যে সহস্রাকি বই প্রকাশ করেছে। শুরু থেকে মননশীল ও মানসম্মত বই প্রকাশের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে আসছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেন?
জসিম উদ্দিন: এককথায়, বলতে গেলে কথাপ্রকাশ যে সমস্ত বই প্রকাশ করে তা পুরো দৃষ্টিটা থাকে একটি পরিবারে যে বয়সেরই পাঠক বইটি কিনুক বইটি যেন পুরো পরিবারের জন্যই কাজে লাগে। অর্থাৎ আমি বুঝাতে চেয়েছি কথাপ্রকাশের বই মানেই পরিবারের সবার জন্য বই।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপণনের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
জসিম উদ্দিন: বইমেলায় যেহেতু বিপুল সংখ্যক পাঠক ও ক্রেতা এবং লেখকদের সম্মিলন ঘটে সেহেতু বইমেলাকে ঘিরে বিপণন পরিকল্পনা হতেই পারে। তবে বইয়ের গুণগত মান ঠিক রাখা এবং সারাবছরই বই প্রকাশ এবং বিপণনে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারক যদি বই কেনার ক্ষেত্র বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া তবে তা প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ ঘটাবে। আমরা সারাবছরই বই প্রকাশ করি বিধায় আমাদের মান ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে। আমরা যদি শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশ করতাম তবে এর সঠিক মান নির্ধারণ করতে পারতাম না।

বিডিনিউজ: মননশীল প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে প্রকাশকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে কথা সামনে আসে। প্রকাশনায় সেন্সরের ব্যাপারও আছে। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে?
জসিম উদ্দিন: মননশীল কথাটি যদি অপ্রাসঙ্গিক এবং রাষ্ট্রবিরোধী হয় সেটি না বলাই ভালো। কিন্তু যদি বই-প্রেমিদের এবং প্রকাশনা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে মননশীল কথার প্রয়োজন বোধ করি সেক্ষেত্রে আমি এটাকে সমর্থন জানাই।

বিডিনিউজ:
একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরনের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে। যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞানবিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। তো, এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকা রাখতে পারে?
জসিম উদ্দিন: প্রকাশকের উচিত বই প্রকাশের পূর্বে বইয়ের বিষয় নির্ধারণ করা এবং সে বিষয়ে পাঠককের কতটুকু উপকারে আসবে এবং জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বইটি কতটুকু ভূমিকা রাখবে এসকল বিবেচনা করে বইটি প্রকাশ করা। এছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবেই এমনকিছু গবেষণার বই এখনও প্রকাশ হয়নি যা বিভিন্ন সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া উচিত বলে মনে করি।

বিডিনিউজ: কথাপ্রকাশ এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
জসিম উদ্দিন: কথাপ্রকাশ অন্যান্য বছরের মতো গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গবেষণাসহ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে এক বিশাল আয়োজনে ২৫টি বই প্রকাশ করবে। যা বইমেলাতে প্রদর্শিত হবে।

বিডিনিউজ: প্রতি বছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?

জসিম উদ্দিন: এলাকাভিত্তিক যারা বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেন এবং বই পড়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাদেরকে খুঁজে বের করি এবং তাদের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে সেটা সম্পাদনা করে প্রকাশের উদ্যোগ নিই।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন? প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
জসিম উদ্দিন: আমরা প্রকাশকরা প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিলেও সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত লিখিতভাবে প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে সরকার একাডেমিক (প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত) বইয়ের প্রতি যথেষ্ট নজর রাখছেন। অথচ মেধা বিকাশে এবং মননশীল জগৎ তৈরিতে এর বাহিরে যে একটা বিশাল প্রকাশনার গুরুত্ব রয়েছে এই বিষয়টির প্রতি সরকার এখনও ভালোভাবে নজর দিতে পারেননি। আমার মতে এই বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিলে মেধা বিকাশে ও মননশীল পাঠক তৈরিতে প্রকাশনা শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, জসিম উদ্দিন ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
জসিম উদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ, কথাপ্রকাশ এর গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের সংগ্রহে পাঠক-লেখকদের স্বাগতম।

…………………….
পাঠকের হাতে টাকা কোথায় যে বই কিনবেন?
পারভেজ হোসেন, লেখক-প্রকাশক, সংবেদ
…………………….


বিডিনিউজ: গত বছর একুশে গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাব শুরু হয়। অর্থনীতিতে, জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কতোটা পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
পারভেজ হোসেন: পুস্তক ব্যবসা জনজীবনের বাইরের কিছু কি? সবকিছুর মতোই এই ব্যবসায়ও মহামারি কোভিডের আঁচ কোনো অংশে কম নয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বন্ধ। ফলে মার্কেট খুলে দিলেও বইয়ের ক্রেতা খুবই কম। তা ছাড়া কোভিড নিয়ে জনজীবনে যে ধকল যাচ্ছে পাঠকের হাতে টাকা কোথায় যে বই কিনবেন? এই যে ফেব্রুয়ারি, বই মেলার মাস, হাজার হাজার বই প্রকাশের মাস; কিন্তু লেখক-প্রকাশকের কোনো উত্তেজনা নেই। সবাই তো ধরে নিয়েছিল বইমেলা হচ্ছে না। গত মেলা শেষ করার পর থেকেই কী কঠিন অবস্থার মধ্যদিয়ে যে যাচ্ছে প্রকাশকেরা বলে বোঝানো যাবে না। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের দিকে এগোচ্ছে দেখে মেলা করার ঘোষণা এসেছে। সেটাও মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে, বলতে গেলে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে! এর পরই রোজা, ঈদ। আপনিই বলুন বই-ব্যবসয়ীর মনে কি করে আসবে উত্তেজনা?

বিডিনিউজ:
আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে সংবেদ কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
পারভেজ হোসেন: বই বিপননের জন্য এখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া একটা বড় ভূমিকা রাখছে। সেখানে যে যার মতো প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, প্রয়োজনে পিঠ চাপড়ানো রিভিউ করাচ্ছে। কিন্তু সঠিক বইটি চিনিয়ে দেয়ার উপযুক্ত নিরপেক্ষ প্লাটফর্ম এখনো গড়ে ওঠেনি, যাদের নির্বাচনে কিংবা রিভিউয়ে পাঠক নিশ্চিন্তে একটা বইয়ের অর্ডার দিতে পারেন কিংবা দোকানে গিয়ে কিনে আনতে পারেন। দায়িত্বসম্পন্ন তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে ভালো হতো। প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রিকাগুলো একেবারে করছে না তা নয়, কিন্তু ওতে নিজেদের প্রচার এত বেশি থাকে যে বিভ্রান্ত হতে হয়। আত্মপ্রচার কমিয়ে সততার সঙ্গে সবার তরে এই কাজটা আরো ভালোভাবে কিন্তু করা যায়। একটা সময় জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র একটা ম্যাগাজিন করতো, এখন করছে কিনা জানি না। দারুন সব রিভিউ হতো। দিনে দিনে সব কিছু কেমন ক্ষীণ হয়ে আসছে। সংবেদ-এরই বা কতোটুকু সাধ্য? যতোটুকু পারছি করছি। চটকদার প্রচার আর বিপননের কারসাজির মধ্যে রুচির বিসর্জন না ঘটিয়ে একটা ভালো বই যাতে প্রকাশ পায় নিজের মতো করে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বিডিনিউজ: কাঁটাবন এলাকাসহ ঢাকার নানান স্থানে অনেক প্রকাশনীর নিজস্ব আউটলেট ছিল, যার অনেকগুলোই উঠে গেছে। এটা কি শুধুই করোনার কারণ, না কি সারা বছর মানুষের যে পাঠ-স্বল্পতা তারই ঘনায়িত প্রভাব?
পারভেজ হোসেন: দুটোই। অনেক বইয়ের দোকান উঠে গেছে। দোকানের ভাড়া দিয়ে, কর্মচারির বেতন গুনে যদি ব্যবসা ধরে রাখতে না পারে গুটিয়ে নেবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এই পৃথিবীর বিশাল বিশাল সব বইয়ের দোকান, সারাদিন ঘুরেও একেকটা মল দেখা শেষ হবে না— এমন, চোখে দেখিনি, শুনেছি বন্ধ হয়ে গেছে। ছাপানো বইয়ের প্রতি আগ্রহ কমতে শুরু করেছে পাঠকের। কারণ যুগের চেহারা দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে যে। এই বদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসে বুঁদ হওয়া মানুষের সুস্থিরতাও কমে যাচ্ছে। ধনতান্ত্রিক পৃথিবীর অস্থির উল্লম্ফনে দিশেহারা মানুষ ডিজিটালাইজেশনের চক্করে পড়ে গেছে। নিমগ্ন হয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা যে পড়বে তেমন সময় কই? নিরুদ্বিগ্ন সময়ের আজ বড়ই অভাব। কোভিড কিন্তু আশ্চর্য একটা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়েছে আমাদের। দেখিয়ে দিয়েছে— স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মিটিং, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, বাজার-সদাই এমনকি বন্ধুদের আড্ডা, সবই কেমন করে একটা ডিভাইসে ঢুকে পড়তে পারে। আগামীর পৃথিবীটা যে কেমন হবে কল্পনায় ধরা যাচ্ছে না। তারপরও বলব— ছাপানো বইয়ের দিন ফুরিয়ে যেতে দেরি আছে।

বিডিনিউজ: বই প্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা ওঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক কখনো কখনো তিক্ততায় গড়াতেও দেখি। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসাব তাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া। বিদেশী বই অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন নেয়া। এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকুল? আপনার প্রতিষ্ঠান এসব কতটা মেনে চলে?
পারভেজ হোসেন: খুব কম প্রতিষ্ঠান আছে এগুলো যথাযথ মেনে ব্যবসা চালাতে পারছে। হাতেগোনা যে কয়টি প্রতিষ্ঠান আছে, তারা আবার এই সচ্ছতার বিনিময়ে লেখককে কম সম্মানী দেন। তবুও মন্দের ভালো। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এসব কাটায় কাটায় মেনে প্রকাশনা ব্যবসা ধরে রাখা অসম্ভব। জানি এটা অন্যায়, কিন্তু বাংলাদেশের বইয়ের বাজার এখনো সেই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেনি। এর মধ্যে নানাবিধ হিসাব নিকাশ আছে ভাই। নতুন লেখকদের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু নামিদামি লেখকদেরও যেসব বই বছরের পর বছর ধরে বিক্রি হয় না, প্রকাশকের ঘারে সেই বোঝা কতো ভয়ঙ্কর-বোঝা ভাবতেও পারবেন না। পুঁজি খাটিয়ে গোডাউন ভাড়া গুনতে গুনতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন প্রকাশক। ওদিকে লেখকের উপর্যুপরি চাপ তো থাকেই। কারণ সে বিশ্বাস করতে পারে না যে, তার অবিক্রিত বই পোকায় কাটছে। আবার অনেক প্রকাশক চালু বইটির প্রকৃত তথ্য গোপন করেন, কারণ ওখান থেকে যে কয়টা বাড়তি পয়সা আসে তা দিয়ে অবিক্রিত বইয়ের বোঝা তিনি টানেন। সব মিলিয়ে প্রকাশনা ব্যবসার লগ্নিকৃত টাকার মুনাফা আদতে শুভঙ্করের ফাঁকি।

খুব কম লোকই আছেন যারা এই ব্যবসায় আলোর সন্ধান পান। তাহলে প্রশ্ন উঠবে— কেন প্রকাশনা ব্যবসায় নামছে মানুষ? বছর বছর তো এই ট্রেডে নতুন নতুন মুখও দেখা যাচ্ছে। আমার ধারণা, নামছেন প্রকাশনাকে ভালোবেসে, আবেগের তাড়নায় কিংবা অন্য ব্যবসা আছে সঙ্গে এটা করছেন। আর একটা কথা, বই যদি বিক্রি হয় তবে এর মুনাফাটাও কিন্তু কম নয়। ভালো মানের বই, পাঠকপ্রিয় বই, জরুরি বই, সিরিয়াস বই— যে ধরনের বইই হোক, বিক্রি হলে প্রকাশক-cলেখকের কোনো ঝামেলাই থাকার কথা নয়। প্রকাশকরা ব্যবসায়ী হলেও ধরনটা আলাদা। আর হ্যাঁ, বই যদি বিক্রি হয়, টাকা খরচ করে অনুমোদন নিয়ে অনুবাদ করে ছাপতেন তো কোনো সমস্যা নেই। অনেকেই জানেন না, এই অনুমোদনের খরচটা ডলারে দিতে গেলে বাংলাদেশের টাকায় তার পরিমাণটা কতো বড়।

বিডিনিউজ: মানসম্পন্ন বই করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা খুবই জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য। এ নিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। সংবেদ এটা কিভাবে করছে?
পারভেজ হোসেন: সম্পাদনা এবং প্রুফ ছাড়া বই প্রকাশ করাটা তো চিন্তাই করা যায় না। আমাদের দেশে লেখকই এই দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। প্রকৃত সম্পাদনার কাজ করাতে গেলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে, অন্তত তিনটি প্রুফ দেখাতে গেলে যে টাকা দিতে হবে, একেকটা বইয়ের দাম বর্তমান দামের দ্বিগুন করলেও বিক্রেতার পোশাবে কিনা সন্দেহ। অথচ একটা বই প্রকাশের পর এক বছরে যদি কমপক্ষে দেড় হাজার কপি বিক্রি করা যায় তবে সম্ভব।
খেয়াল করবেন, ষোল কোটি মানুষের দেশে মাত্র দেড় হাজার কপি বই বিক্রির কথা বলছি। কিন্তু কটা বই বছরে তিনশ কপি বেচতে পারেন একজন প্রকাশক? দু-একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া এখন তো কোনো বই-ই তিনশ কপির বেশি ছাপা হয় না। আমার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দু-একজন দরদী আছেন যারা সামান্য অর্থের বিনিময়ে সংবেদকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। সত্যি বলতে কি, প্রকৃত সম্পাদনার কাজ সংবেদ-এও হয় না। সম্ভব না। প্রকাশনা সেক্টরটা জোড়াতালি দিয়েই এতদূর এসেছে। সম্পাদনা এবং প্রুফ তো একটা প্রফেশন। এই প্রফেশনে কটা লোক খুঁজে পাবেন! পাবেন না কারণ এই পেশায় যোগ্যলোক আসছেন না। আসছেন না কারণ এই পেশায় ভাত নেই।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে থাকে ছোট ছোট প্রকাশনীগুলো। তারা বিপননের নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়? সব প্রকাশনীই কি বইমেলার বিক্রির উপর খুব বেশি নির্ভর করে?
পারভেজ হোসেন: দেখুন, বই প্রকাশ এবং বই বিক্রি একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস। অথচ আমরা ফেব্রুয়ারির মেলাকে কেন্দ্র করে সারা বছর হাত গুটিয়ে থাকি। মেলা এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি সবাই। লেখক-প্রকাশক সবাই। কোনো প্রফেশনালিজম ডেভলপ করেনি আমাদের। এটা এই শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায় তো বটেই। এই প্রফেশনে অনেককিছুই হয়নি, আবার এমন কিছু হয়েছে যা নিয়ে গৌরব করা যায়।
একুশের বইমেলাকে স্রেফ বাণিজ্যিকীকরণ করতে চাওয়া আমি কখনোই সমর্থন করিনি। এখন এটা আমাদের জাতীয় উৎসব। আমাদের সংস্কৃতির সারবান ভূমি। এর চর্চা করতে হবে।

বিডিনিউজ: সংবেদ ইতিমধ্যে প্রায় দেড়শ বই প্রকাশ করেছে। শুরু থেকে মননশীল ও মানসম্মত বই প্রকাশের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে আসছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেন?
পারভেজ হোসেন: আমরা যা চাই সব ক্ষেত্রে যে তা রক্ষা করতে পারছি— এমন ধৃষ্ট কথা বলব না। বলতে গেলে সবসময় অসহায়তা নিয়ে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি। পুঁজি এবং মানসম্মত পাণ্ডুলিপি এই দুয়ের অভাবে আমি দিশেহারা। তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভালো ছাপা ভালো বাঁধাই সহকারে নির্ভুল বই যাতে প্রকাশ পায়।

বিডিনিউজ: মননশীল প্রকাশনা নিয়ে কথা বলতে গেলে একটা বিষয় এসেই যায়, তা হল প্রকাশকের নিরাপত্তা। বই প্রকাশের কারণে জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপনকে মরতে হয়েছে, শুদ্ধস্বর এর আহমেদুর রশিদ টুটুলকে আক্রান্ত হয়ে বিদেশে চলে যেতে হয়েছে। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে? প্রকাশনা এখনো ঝুঁকির মধ্যে আছে, আপনি কি মনে করেন?
পারভেজ হোসেন: অবশ্যই ঝুঁকির মধ্যে আছে। প্রতিটি পাণ্ডুলিপি তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়— ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার মতো কিছু থেকে যাচ্ছে কি না। এগুলো লেখকের স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায়। আর এ শুধু মননশীল বইয়ের বেলাই বা কেন, সৃজনশীল বইয়ের বেলায়ও ঘটে। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, হুমায়ূন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ উপন্যাসটির কথা। তাকেও তো কোপ খাওয়ার কারণেই মরতে হলো।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেবার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে একটু বেশি সময় লাগে— সেই ধরনের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখেছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ পেয়েছে। তো, এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকা রাখতে পারে?
পারভেজ হোসেন: মননশীল বইয়ের পাঠক কমছে, না বাড়ছে— এ নিয়ে আমি ধন্দে পড়ে যাই। বলতে পারেন লেখক কমে যাচ্ছে। জ্ঞানের চর্চা কি আছে সমাজে? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকান, তাদের রেটিং দেখেন, তবেই বুঝবেন। মোটিভেশনাল বইয়ের চাহিদা এখন অনেক বেশি। ধর্ম বিষয়ক বইয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সেটা হয়ত আপনারা লক্ষ্য করেন নাই। প্রকাশক কি করবে? যেহেতু ব্যবসায় নেমেছে প্রকাশক সেহেতু চাহিদার দাস।

বিডিনিউজ: সংবেদ এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
পারভেজ হোসেন: খুব বেশি বই তো ছাপি না আমরা। সারা বছরে বারো থেকে পনেরোটা। এবার আরো কম হবে। মোবারক হোসেন সম্পাদিত স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ, ড. কাজী নুরুল ইসলাম সম্পাদিত মহানবী ও চার খলিফার জীবন (প্রায় ১,০০০ পৃষ্ঠার বই), বিপ্লব দাশের ঈশ্বরতত্ত্ব থেকে ঈশ্বরকণা, অভিজিৎ চক্রবর্তীর মিশেল ফুকোর জীবন ও কর্ম, রঞ্জন সাহা পার্থর গ্রামীণ সমাজ ও কৃষি কাঠামো, সাম্প্রতিক পরিবর্তন। এছাড়াও আছে কোভিড ডায়রি-২০২০ এবং কয়েকটি কবিতার বই।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে যেগুলো লেখকের প্রথম বই। এর মান নিয়েও থাকে নানান বিতর্ক। বড় প্রকাশনীর একটা দায় কিন্তু সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকদের তুলে আনা। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন।
পারভেজ হোসেন: অবশ্যই প্রকাশকের দায়িত্ব প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখকের সন্ধান করা, তাদের বই ছেপে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা। আমিও প্রায় প্রতিবছরই এমন লেখকদের খুঁজি। তাদের বই ছাপি। নতুনরা তো একবার লিখেই পাণ্ডুলিপি তৈরি করে না। বিভিন্ন জায়গায় লিখে লিখে একটা অবস্থানে আসে— ছোট কাগজে লেখে, বড় কাগজে লেখে, ফেইসবুকে লেখে। এরকম প্রস্তুতির মধ্যদিয়েই তো একজন লেখক তার সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখে। এতে তাকে চিনে উঠতে বেগ পেতে হয় না।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, পারভেজ ভাই, আন্তরিক সময় দেওয়ার জন্য।
পারভেজ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

…………………….
এ বছর থেকে চালু হয়েছে দ্যু প্রকাশন এর ওয়েবসাইট (dyu.com.bd), সেখানে লেখক আলাদাভাবে তার বইয়ের সর্বশেষ বিক্রিত হিসেব
হাসান তারেক, প্রকাশক, দ্যু প্রকাশন
…………………….


বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনি অনুভব করেছেন?
হাসান তারেক: করোনা মহামারি একটি বৈশ্বিক সংকট। পৃথিবীর কোনো কিছুই এখন আর এই সংকটের প্রভাবমুক্ত নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব সামান্য অবদান আমাদের এই সৃজনশীল প্রকাশনার। তাই সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকটে এর প্রভাব হয়তো সামান্যই। কিন্তু প্রকাশনা শিল্পকে শুধু অর্থনৈতিক কাঠামো দিয়ে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে এর প্রভাব ব্যাপক ও সুগভীর। জ্ঞানভিত্তিক সমাজের অন্যতম পূর্বশর্ত হল— প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ। তাই এই মারিকালে অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে, অথবা সংকুচিত করেছে। আমরাও আমাদের প্রকাশিতব্য অনেক বই এই মুহূর্তে প্রকাশ করতে পারছি না। সত্যি বলতে, এখন টিকে থাকার লড়াই করছি। এ যাত্রায় টিকে যেতে পারলে আগামীতে আরো নতুন উদ্যমে কাজ করবো।

বিডিনিউজ: বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে দ্যু প্রকাশন কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
হাসান তারেক: শুরু থেকেই আমাদের বই বিপণনে অনলাইন মাধ্যমের উপর অধিক নির্ভরশীল আমরা। রকমারি ডটকম, বইমেলা ডটকম-সহ এখন অনেকগুলো অনলাইন বিক্রয়মাধ্যম কাজ করছে। তাদের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত পর্যায় পর্যন্ত বই পৌঁছে দিতে পারছি। পাশাপাশি নির্বাচিত, বাতিঘর এর মতো কিছু চেইন বুকশপও বিপণনে বড় ভূমিকা রাখছে। প্রচারের ক্ষেত্রে ফেসবুক ও গুগলের উপর নির্ভর করা ছাড়াও এসএমএস মার্কেটিং করে থাকি আমরা। এছাড়াও বিপণন ও প্রচার-বিষয়ক আরো কিছু পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি, যা এ বছর থেকেই চালু হবে।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী কি এসব মেনে চলছে?
হাসান তারেক: বই প্রকাশের চুক্তি, লেখক সম্মানী প্রদান, অনুমতি নিয়ে অনুবাদ— এসব ব্যবসায়িক পেশাদারির সাথে ওতোপ্রতোভাবে সম্পর্কিত। এবং শেষ বিচারে বাণিজ্যিক অনুকূল্যের সহায়ক। তাই এসব বিষয়ে শুরু থেকেই গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আমরা প্রথম থেকেই চেষ্টা করছি প্রকাশনায় পেশাদারি অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করার। কিন্তু এখনো শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। ঘাটতি রয়েছে, আছে আক্ষেপও। তবে আন্তরিকভাবে কাটিয়ে উঠতে তৎপর দ্যু-টিম। এ বছর থেকে চালু হয়েছে দ্যু প্রকাশন এর ওয়েবসাইট (dyu.com.bd), সেখানে লেখক আলাদাভাবে তার বইয়ের সর্বশেষ বিক্রিত হিসেব, প্রাপ্য ও প্রাপ্ত রয়্যালিটির আপডেট দেখতে পাবেন। সম্ভবত দেশে আমরাই প্রথম (ডিজিটালি) এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। প্রতি বছরের ২৩ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে রয়্যালিটি প্রদান করা হবে, যা এ বছর থেকেই চালু হচ্ছে। এর আগে তা বিচ্ছিন্নভাবে দেয়া হতো। প্রভৃতি চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ সফল করতে পাঠক, লেখক ও শুভানুধ্যায়ীদের আন্তরিক সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। দ্যু প্রকাশন এটা কিভাবে করছে?
হাসান তারেক: শুরু থেকেই দ্যু প্রকাশন এই বিষয়ে মনোযোগী। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার সাথে আমরা— প্রকাশক ও লেখকরা খুব একটা পরিচিত নই; অথচ বহু আগে থেকেই হাতে গোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠান পাণ্ডুলিপি যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই শেষে সুসম্পাদিত পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ করছেন। এতে প্রকাশিত বইটি গুণে ও মানে আরো সম্মৃদ্ধ হচ্ছে।
আমাদের সম্পাদনা-টিমটি ছোট্ট, কিন্তু কার্যকর। আসলে আমরা প্রকাশনা হিসেবেও যথেষ্ট ছোট; সবে ৫ বছর। আর বিষয়ভিত্তিক বইয়ের জন্য বাইরের বিশেষজ্ঞ মতামত বা সম্পাদনার সাহায্য নেয়া হয়।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
হাসান তারেক: দেশের সার্বিক পরিস্থিতির মতোই প্রকাশনার বাজার অস্থির। প্রকাশক লেখকের কাছে দুই মাসেই বই লিখিয়ে নিতে চান, আর লেখক পাণ্ডুলিপি দিয়েই পরের সপ্তাহে বই চান। এতো অস্থিরতার মধ্যে আর যাই হোক, সৃজনশীল-সাহিত্য চর্চা হয় না। এ জন্যই আজ সাহিত্যের বাজারে মোটিভেশনাল আর সমর্পিত চিন্তার বাড়বাড়ন্ত। যুগসন্ধিক্ষণের এই অস্থিরতা হয়তো স্থায়ী নয়, কিন্তু এর চড়া মূল্য দিতে হবে আরো দীর্ঘ সময়।
চিন্তার স্বাধীনতা সংকুচিত, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়ার কথা সার্বক্ষণিক মাথায় রেখে এখানে লিখতে ও প্রকাশ করতে হয়। তাই বছরজুড়ে থাকে ভালো মানের পাণ্ডুলিপির সংকট। আর লিটলম্যাগ আন্দোলনের স্থবিরতা, সাহিত্য সাময়িকীগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতা, ভালো মানের সাহিত্য পত্রিকার ঘাটতি, সমালোচনা সাহিত্যের প্রতি অরুচি আমাদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ। যারা এই আত্মসমালোচনার সাথে দ্বিমত করেন তাঁদের উদ্দেশ্যেও বলতে চাই— আমাদের সাহিত্য চর্চার ক্রমাবনতি বোঝার জন্য ইউরোপ আমেরিকার সাহিত্য বোদ্ধা হওয়ার দরকার নেই, পার্শ্ববর্তী বাংলা ভাষাভাষি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যচর্চার সাথে তুলনা করলেও চলে। আমাদের খুচরা বই বাজারে তাদের বইয়ের বিক্রি আমাদের বইয়ের চেয়ে বেশি! পাঠক তার নিজের প্রয়োজনেই দরকারি বইটি খুঁজে নেবে— হোক সেটা আমাদের কিংবা অন্যদের। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ঠুনকো জাতীয়তাবাদের কোনো স্থান নেই।

বিডিনিউজ:
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি? আপনাদের মতো বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
হাসান তারেক: আমরা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বলে আসছি 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' নির্ভরতা প্রকাশনা শিল্পের বিকাশের জন্য অন্যতম অন্তরায়। তাই বলে আমি মেলার বিরোধী নই, বরং পক্ষে। সাহিত্য চর্চা একটি চলমান প্রক্রিয়া, বই প্রকাশও তাই। কিন্তু আমাদের বইয়ের বাজার ছোট হওয়ার দরুন এটা মেলাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। অথচ সারাবছর বই প্রকাশ ও বিপণনে মনোযোগী হলে প্রকাশক, লেখক ও পাঠক সবাই উপকৃত ও লাভবান হতেন। বইমেলাকে কেন্দ্র করে পাঁচ সহস্রাধিক বই প্রকাশে বইয়ের সার্বিক গুণ ও মানের অবনমন ঘটছে, পক্ষান্তরে উৎপাদন মূল্য বাড়ছে, চাপ নিয়ে লিখে লেখক বিপর্যস্ত, পাঠকও হচ্ছেন বীতশ্রদ্ধ। আমরাসহ দেশের বেশ কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সারা বছর বই করে থাকি, কিন্তু সেই সংখ্যাটি ফেব্রুয়ারির সাথে কোনোভাবেই তুলনীয় নয়।

বিডিনিউজ: দ্যু প্রকাশন ইতিমধ্যে দুইশতাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এত সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
হাসান তারেক: শিশুতোষ, ইতিহাস, রাজনীতি ও বিজ্ঞানের বইয়ের গুণ ও মান নিয়ে আপোসের কোনো সুযোগ নেই। এর বাইরে ফিকশনকেন্দ্রিক ভালো মানের পাণ্ডুলিপির ঘাটতির কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সে কারণে ফিকশনাল কাজ একটু কম করা হয়। সেই ঘাটতি পূরণ করা হয় বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ করে।

বিডিনিউজ: দ্যু প্রকাশন এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
হাসান তারেক: পরিকল্পনা ছিল অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশের। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তা আর হচ্ছে না। তবে উল্লেখযোগ্য কিছু বই আসছে: গণহত্যা (৭১-এ গণহত্যা নিয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের দুনিয়া কাঁপানো রিপোর্ট), কেইস ফর বাংলাদেশ (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা), একাত্তরের ডায়েরি (একাত্তরে এক কিশোরী মুক্তিযোদ্ধার দিনলিপি), উনিশশ' একাত্তর: বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি, বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা, স্বাধীন বাংলাদেশ: সংগ্রামের পটভূমি, সায়েন্স ফিকশন: দিতার ঘড়ি, রবীন্দ্র রচনায় বিজ্ঞান, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্বশাসন প্রভৃতি।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
হাসান তারেক: ভালো মানের কোনো পাণ্ডুলিপি না পাওয়ায় এ বিষয়ক কোনো বই প্রকাশ করতে পারিনি।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে যা সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
হাসান তারেক: আমরা শুরু থেকেই তরুণ লেখক এবং লেখায় তরুণদের নিয়ে কাজ করছি। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ খুব একটা হয়নি। আমরা নতুন পাঠক ও লেখক তৈরিতে দায়বদ্ধ।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
হাসান তারেক: বইয়ের উপর অযাচিত ২০% কমিশন উঠিয়ে দিয়ে যৌক্তিক নির্ধারিত মূল্য (MRP) নির্ধারণ করা, সরকারি বইক্রয়কে আরো স্বচ্ছ ও বিস্তৃত করা, প্রত্যেকটি হাউজিং সোসাইটি ও বহুতল আবাসিক ভবনে পাঠাগার বাধ্যতামূলক করা, প্রতিটি মাদ্রাসা-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাগার স্থাপন ও সচল রাখাসহ অসংখ্য প্রস্তাবের কথা বলা যাবে। কিন্তু মোদ্দাকথা রাষ্ট্রের অসাড় কানে এসব পৌঁছাবার নয়।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য।
হাসান তারেক: আপনাদেরও ধন্যবাদ, এই বাজার অর্থনীতির যুগে বই-সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে আপনাদের আন্তরিক মনঃসংযোগ করার জন্য।

…………………….
বই কেনার ক্ষেত্রে এর গায়ের দাম দিতে না চাওয়ার চর্চা এখন রীতিমত প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় পৌঁছে গেছে
মাজেদুল হাসান পায়েল, প্রকাশক, জয়তী প্রকাশ
…………………….


বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
মাজেদুল হাসান: যথেষ্টই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সৃজনশীল প্রকাশনা ব্যবসার সাথে জড়িত যারাই আছেন তাদের প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এই তালিকায় প্রকাশক থেকে শুরু করে লেখক, মুদ্রাকর, বাইন্ডার, কাগজ ব্যবসায়ী কেউই বাদ নেই। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এমনকি পাঠকেরাও।

বিডিনিউজ: করোনার শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি— যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেন নি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
মাজেদুল হাসান: অভিজ্ঞতাটা ভালোমন্দের মিশেল। অনেক পাঠকই অনলাইনে বই নেবার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে সরবারহ ব্যবস্থার সীমাবন্ধতা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। এটি একদিক দিয়ে আমাদেরও চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা প্রকাশরাও সমস্যাটি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে আমাদের প্রকাশনী নিজস্ব কুরিয়ার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। যা থেকে কেবল আমরাই নই অন্যান্য প্রকাশকদেরও দেশব্যপী বই সরবারহের সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি।

বিডিনিউজ: কাঁটাবন এলাকাসহ ঢাকার নানান স্থানে কয়েকটি বইয়ের আউটলেট উঠে গেছে। এটা কি শুধুই করোনার কারণ বলবেন, না কি সারা বছর মানুষের যে পাঠ স্বল্পতা, তারই ঘনিভূত প্রভাব বলবেন? কারণ এতদিনের ব্যবসা সাময়িক দুর্য়োগেও কি দাঁড়িয়ে থাকার কোনো সঞ্চয় দেয়নি— এই প্রশ্ন সামনেই আসে।
মাজেদুল হাসান: বিষয়টি অতটা সরলভাবে বলবার সুযোগ নেই। ব্যবসা প্রতিযোগিতার বিষয়। সারাবছরই বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা লাভ-লোকসানের ভেতর দিয়ে যান। কেউ টিকতে হিমশিম খান কেউবা টিকে যান ভালোভাবেই। তবে এটি ঠিক অতিমারীর একটি নেতিবাচক প্রভাব তো পরেছেই।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে জয়তী প্রকাশ কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
মাজেদুল হাসান: আগেই যেমনটি বলেছি, জয়তী নিজস্ব বিপনন ব্যবস্থা নিয়ে এসেছে। যার সেবার ব্যপ্তি আমরা অন্যান্য প্রকাশকদের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছি। ফলে দেশের সবপ্রান্তেই কাটাবন কিংবা ঢাকা থেকে বই পাঠানোর ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রচারে জয়তী আগেও কার্পন্য করেনি, এখন তো প্রশ্নই উঠে না। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে জয়তীর উপস্থিতি ছিল, আছে। আমরা প্রতিনিয়তই পাঠকের চাহিদা, চিন্তা, অভিমতকে মূল্যায়ন করি। এজন্য জয়তীর কার্যালয়ে প্রতিদিনই লেখক, পাঠক প্রকাশকের আড্ডা জমে। জয়তীর মূলমন্ত্রই হল— লেখক-পাঠক মেলবন্ধন।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী এসব কতটা মেনে চলছে?
মাজেদুল হাসান: মেনে চলার বিষয়টি অনেকখানিই সিস্টেম নির্ভর। এককভাবে স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়ার উপায় নেই। তবে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে যতটা সম্ভব স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করে জয়তী। প্রকাশনার ১২ বছর বেশ দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়ে জয়তীর ক্ষেত্রে কোন তিক্ততার অভিজ্ঞতা নেই।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। জয়তী প্রকাশ এটা কিভাবে করছে?
মাজেদুল হাসান: বিষয়টি নিয়ে জয়তী লেখকের স্বাধীনতাকেই বেশি গুরত্ব দেয়। অনেক লেখক সম্পাদনার জায়গাটি সহজভাবে নেন না। তবে আমাদের চেষ্টা থাকে নির্ভুল বই পাঠকের কাছে উপহার দেয়ার। আর আক্ষেপ যতটা না সম্পাদনার তার থেকে বেশি প্রুফ রিডিং এর। আমরা বানানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার চেষ্টা করি। এরপরও যতটুকু ভুল থেকে যায় তা নিতান্তই অনাকাঙ্খিত, অনিচ্ছাকৃত।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
মাজেদুল হাসান: বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। সারাবছর বই ব্যবসার জন্য যে স্বাভাবিক বিপণন ও বিক্রির সিস্টেম থাকা উচিত তার অভাবও এর একটি কারন। ন্যায্য মূল্যে বই বিক্রির পরিবর্তে উচ্চহারের ডিসকাউন্ট কিংবা কমিশনে বই বিক্রির চর্চা, পাইকারি এবং খুচরো দোকানদার প্রকাশকদের বই বিক্রির টাকা আটকে রাখাসহ নানা কারণে মেলার প্রতি এই নির্ভরশীলতা। তবে এই নির্ভরশীলতা অবশ্যই কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।

বিডিনিউজ: জয়তী প্রকাশ ইতিমধ্যে ৫০০ এর উপর গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। শুরু থেকে মননশীল ও মান সম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি বলে আসছেন আপনি। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
মাজেদুল হাসান: প্রকাশনার এই দীর্ঘ সময়ের তুলনায় আরও বেশি বই প্রকাশ করবার কথা ছিল আমাদের। নানা সীমাবদ্ধতায় তা হয়ে ওঠেনি। গুন ও মানের প্রশ্নে আমরা বরাবরই পাঠকের ইচ্ছে, চাহিদার পাশাপাশি লেখকের সদিচ্ছা,মানসম্পন্ন লেখার সততার ওপর নির্ভর করতে চেয়েছি। এর বাইরে আমাদের নিজেদের ভালো লাগা এবং পাঠককে আরো হৃদ্ধ হতে দেয়ার আকাঙ্ক্ষাও কাজ করেছে। এখনও পর্যন্ত এভাবেই এগুচ্ছে জয়তী।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। তো, এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকার রাখতে পারে?
মাজেদুল হাসান: বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের তালিকায় যে মননশীল বই নেই তা কিন্তু নয়। আর বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরাদের পিছিয়ে থাকবার কারণও অবশ্যই এটি নয়। এর অনেক কারণই থাকতে পারে। তবে এটি ঠিক, বাজার অর্থনীতিতে সময়ের সাথে সাথে অনেক ধারা পাল্টায়। মননশীল বই বলুন আর বিজ্ঞান বিষয়ক বইই বলুন— এর প্রতি পাঠকের আগ্রহ থাকলে প্রকাশকদের তা ছাপতে না চাওয়ার কোনো কারণ নেই এবং বাংলাদেশে এ ধরনের প্রচুর বই ছাপাও হচ্ছে।

বিডিনিউজ: জয়তী প্রকাশ এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
মাজেদুল হাসান: এ বছর দুটি বিশেষ কারণে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে। প্রথমত মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি, দ্বিতীয়ত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষকী। দুটো ইভেন্ট মাথায় রেখেই আমরা বই প্রকাশ করছি। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর গ্রন্থমালা সিরিজের আওতায় পুরো ২০২১ জুড়েই অনেকগুলো বই প্রকাশ হবে যা পাঠকদের পড়বার পাশাপাশি সংগ্রহে রাখা এবং উপহার দেবার আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। ছাড়া নিয়মিত প্রকাশনা তো রয়েছেই। এর মধ্যে ধর্মীয় বই, অনুবাদ, প্রবন্ধ সংকলণ সবই রয়েছে।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
মাজেদুল হাসান: লোকগানে বঙ্গবন্ধু নামে একটি বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর বিচার ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়াসহ একাধিক বই জয়তী থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
মাজেদুল হাসান: আমাদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া সরল এবং স্বচ্ছ। নতুন লেখকদের বিষয়ে আমরা বরাবরই লেখকের চেয়ে তার সাহিত্যমূ্ল্যকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছি।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
মাজেদুল হাসান: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে নানা বাধা আছে। এর মধ্যে অন্যতম খুচরো বই বিক্রিতে ন্যায্য মূল্য না পাওয়া। বই কেনার ক্ষেত্রে এর গায়ের দাম দিতে না চাওয়ার চর্চা এখন রীতিমত প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় পৌঁছে গেছে। এর বাইরে দোকানীদের টাকা আটকে রাখার প্রবণতা, কাগজের উচ্চহারসহ বেশ কতগুলো সমস্যা রয়েছে যার আশু সুরাহা প্রয়োজন।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
মাজেদুল হাসান: অবশ্যই। যেমনটি আগেই বলেছি, উল্লেখিত নানা সমস্যার আশু সুরাহা প্রয়োজন। প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশে এর বিকল্প নেই। আর এ জন্য সরকারি নীতিনির্ধারণী মহলে যারা আছেন তাদের সাথে প্রকাশকদের সমন্বয় রেখে চলাটা জরুরি।
বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, পায়েল ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
মাজেদুল হাসান: আপনাকেও আন্তরিক ধন্যবাদ আমাদের কিছু বলবার সুযোগ দেয়ার জন্য। ০