Published : 27 Oct 2020, 06:46 PM
ইয়েভজেনি ইয়েভতুশেংকো (১৯৩৩-২০১৭) বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ার অন্যতম সেরা কবি। 'বাব্ই-য়ার'(১৯৬১)তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতার একটি। অবরোধহীন মানবিক মূল্যবোধ তাঁকে বিশিষ্ট করে তোলে। বিতর্কিতও। রাশিয়ায় পোল্যান্ড সীমান্তের কাছাকাছি কিয়েভ শহরের লাগোয়া দুই পাহাড়ের মাঝখানে এক খাঁড়ি 'বাব্ই-য়ার'। রুশ জনতা পার্টি ( দ্য সোসাইটি অফ দ্য রাশিযান পিপল) নামে এক চরমপন্থী ইহুদি-বিদ্বেষী সংগঠন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালেও সেখানে সক্রিয় ছিল। ১৯৩৯-এ ওই মহাযুদ্ধ শুরু হলেও রুশ-জর্মন অনাক্রমণ চুক্তির দোহাই দিলে গোড়ার দিকে সোভিয়েট ইউনিয়ন তাতে জড়ায়নি। ১৯৪১-এ পোল্যান্ড দখলের পর জর্মন নাৎসি বাহিনী রাশিয়ায় আক্রমণ চালালে পালটা রুশ সেনারাও যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। রুশ জনতা পার্টি কিন্তু নাৎসি কাণ্ডে উৎসাহিত হয়ে বেপরোয়া ইহুদি-নিধন অব্যাহত রাখে। কিয়েভ ও তার আশেপাশের ইহুদিদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে মৃত-অর্ধমৃত সবাইকে তারা বাব্ই-য়ারে ঢালাও কবর দেয়। তার দুঃসহ স্মৃতির প্রেক্ষাপটে এই কবিতা লেখেন। এতে যে 'বেলওস্টোক'-এর উল্লেখ আছে, তা আগে রুশ শাসনাধীন ছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়।
পিটার লেভি ও রবিন মিলনার গুলান্ড-এর অনুবাদে প্রকাশিত সিলেকটেড পোয়েমস, ইয়েভজেনি ইয়েভতুশেংকো ১৯৬৯ থেকে কবিতাটি গৃহীত হয়েছে।
১৯৯২ তে সোভিয়েত ইউনিয়নে কম্যুনিস্ট শাসনের অবসান ঘটার পর ইয়েভজেনি ইয়েভতুশেংকোর কোন লেখা আমি পড়িনি।— অনুবাদক।
অনুবাদ: সনৎকুমার সাহা
বাব্ই-য়ার
বাব্ই-য়ার। তার কোন স্মৃতিসৌধ নেই।
পাহাড়ের খাড়ি যেন বিমূর্ত খোদাই,
দেখি–ভয় পাই।
বিশ্বে ইহুদি যত বেঁচেছিল আগে,
বেঁচে আছে আজ, আমার বয়স
ওদের একত্র সমান।
এই ক্ষণে মনে হয় আমিও ত নেই
যেন দূর অতীতের মিসরপ্রবাসী,
ক্রুশবিদ্ধ চলি সোজা আপন বিনাশে।
ওই সে শূলের দাগ চোখে পড়ে আজো।
অথবা সে ফিলিস্তিন–নিজেই নিজের
অভিযোক্তা-বিচারক, এক সাথে দুই।
খাঁচাবন্দি-কোণঠাসা-ওরা থুথু দেয়,
হিংস্র-মিথ্যা ছুতো তুলে গালাগাল করে,
বিলাসী নারীরা সব বিকৃত চিৎকার
তাদের ছাতার বাঁটে আমাকে খোঁচায়।
বেলওস্টোকের অসহায় ছেলেটি ত আমি,
টুপটুপ আঙ্গিনায় রক্ত ঝরে পড়ে,
মাস্তান-হাঙ্গামা-পানশালা উৎকট
ঝাঁঝালো মদের গন্ধ-বিবমিধা ঘোরে।
বুটের লাথিতে আমি গড়াগড়ি খাই
শক্তিহীন অসহায়। কাকুতি-মিনতি
তারা কিছুই শোনে না। 'পেটাও নাসারা,
আর রাশিয়া বাঁচাও'-এই মত্ত চিৎকারে
আমার কাঙাল মাকে মেরে ছাতু করে
মৌলবাদী উন্মাদ অসহিষ্ণু এক।
নিজেকে আমার আনা ফ্রাংক্ মনে হয়-
এপ্রিলের নিষ্পাপ বৃক্ষশাখা যেন।
-আর আছে ভালোবাসা, কথা অনর্থক
শুধু চাই একে-অন্যে মুখপানে চাই;
কতটা আমরা রিক্ত দেখাতে-ঘ্রাণেতে,
আকাশ-নিসর্গ শোভা উভয়ে বঞ্চিত।
তারপরও আমাদের সাধ্যে কত থাকে!
জড়িয়ে থাকতে পারি কোমল আদরে
একে-অন্যে ঘন হয়ে, অন্ধকার ঘরে!
তারা কি আসছে? ভয় নেই।
ওই শুনি পাখি ডাকে-কলকল রোল
এদিকেই ভেসে আসে।
আরো কাছে এস।
তাড়া করো। ঠোঁট দুটো দাও!
ওরা কি উদ্যত দরজায়? তাই অত রব?
না! বরফ ভাঙছে…
বুনো ঘাস গজিয়েছে বাব্ই-য়ারে–
এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া, মাতামাতি করে,
গাছগুলো কড়া চোখে কট্ মট্ চায়।
যেন বা বিচারে বসা।
আর, সব কিছু মিলে এক নিঃশব্দ ক্রন্দন।
মাথা থেকে টুপি খুলি। মনে হয় ধীরে ধীরে
বুড়ো হয়ে যাই
মাটিচাপা অগণিত মৃতের স্তুপে
মিশে গিয়ে আমি যেন এক হাহাকার
বিশাল নিশ্চুপ!
এখানে নিহত বৃদ্ধ প্রত্যেকে আমি।
প্রতিটি নিহত শিশু, সেও এই আমি।
আমার সত্তায় মেশা অনুকণা যত
আমৃত্যু এমন বলে যাবে।
গর্জে ওঠা 'আন্তর্জাতিক' সংগীত
রাশিয়ার জনগণ এই গান গায়
ইহুদি বিদ্বেষ এতে এতটুকু নেই।
আর, আত্মআস্ফালনে যারা তেমন বিদ্বেষী
ওরাও ও রুশ!-আমি ভুলতে পারি না!
যখন তাদের মূল উৎপাটিত হবে
'আন্তর্জতিক' গাওয়া তবে তখনই সার্থক।
ইহুদি রক্তের লেশ আমার শিরায়
এতটুকু নেই!
তবুও আমাকে ওরা সমঘৃণা করে
যেন আমিও ইহুদি।
এতেই প্রমাণ হয়, আমি রাশিয়ান!