Published : 01 May 2010, 03:17 PM
(কিস্তি ৬-এর পর)
…….
আহমদ ছফা (জন্ম. চট্টগ্রাম ৩০/৬/১৯৪৩ – মৃত্যু. ঢাকা ২৮/৭/২০০১)
…….
স্বৈরাচারী এরশাদকে ছফা কাকা সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু এক জায়গায় দেখলাম তার গুণগান করতে। তিনি বলতেন, এরশাদ সাহেব আর যা-ই করুন, তিনি ঢাকা শহরে ফুলের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তুলেছেন।
ছিয়াশি সালের প্রথমদিকে ছফা কাকার সঙ্গে গ্যোতে ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর পিটার জেবিৎসের বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সম্পর্কটা তাঁর জীবনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ওই সময়ে তিনি জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটে নিয়মিত যাওয়া আসা করতেন। উল্লেখ করা দরকার, তখন তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে জার্মান ভাষা শেখায় রত ছিলেন। জনাব মফিজ দীন শেখ ছিলেন তাঁর ভাষা শিক্ষার গুরু। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে তিনি জার্মান ভাষার ওপর ডিপ্লোমা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই সময় জার্মান বন্ধু পিটার জেবিৎসের উৎসাহে তিনি ফাউস্ট-এর অসমাপ্ত অনুবাদ শেষ করতে উঠেপড়ে লেগে যান এবং সফলও হন। এ পর্যায়ে ফাউস্ট অনুবাদ শেষ করতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। একই বছর 'মুক্তধারা' থেকে বইটি প্রকাশের একটি ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন।
—————————————————————–
আজকাল অনেক বড় বড় মানুষ আমাকে মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে আনন্দবোধ করেন। এঁদের মধ্যে দেশের বড় কবি, প্রথিতযশা অধ্যাপক, সাংস্কৃতিক-কর্মী এবং শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকেই রয়েছেন। তাঁরা এই সম্মানটা আমাকে দিতে এতটা কেন আগ্রহবোধ করেন তা সত্যি সত্যি অজানা। এ সমস্ত ভদ্রলোক যাঁরা হাওয়া পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টান, অতীতের কর্মকাণ্ড গর্ভগুহার মধ্যে লুকিয়ে রেখে শুধু গলাবাজির জোরে জনমানসে এক একটি স্থান অধিকার করতে চান, তাঁদের চিন্তা-ভাবনা এতই অপরিণত, তাদের সুবিধাবাদ এতদূর; নির্লজ্জভাবে ননী মাখন লুট করা ছাড়া দেশ জাতির উপকারে আসে এ ভূমিকায় তাঁদের কোনদিন দেখা যায়নি। তাঁদের আসল স্বরূপ জনসমক্ষে উন্মোচন করে দেখানো আমার কর্ম নয়। আমার পথ আলাদা।
—————————————————————-
ফাউস্ট অনুবাদের পেছনে কাকা বিশ বছরের অধিক সময় ব্যয় করেছিলেন। উনিশ শ' চৌষট্টি সালে ফাউস্টের সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল এবং দীর্ঘ পরিক্রমার ভেতর দিয়ে ঊনিশ শ' ছিয়াশি সালে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। এটা একটা ইতিহাস তো বটেই। এই ইতিহাসটা কী, সেই সম্পর্কে ছফা কাকা ফাউস্টের ভূমিকায় একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:
অপাসঙ্গিক হলেও একটা কথা এখানে বলা উচিত মনে করছি। ১৯৭৬-'৭৭ সালের দিকে যখন অনুবাদটি 'সমকালে' প্রকাশ পাচ্ছিল, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা থিসিস তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু গ্যোতের চিন্তার গভীরতা এবং কল্পনার অনুপম সৌন্দর্য আমাকে এমনভাবে তন্ময় করে রাখে যে ওই গবেষণার কাজটিকেই আমার নিতান্ত অশ্লীল বলে মনে হতে থাকে। এই ধারণা মনে জন্ম নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার কাজটি আমি ছেড়ে দেই। মজার ব্যাপার হল, অনুবাদকর্মেও আর অধিকদূর অগ্রসর হতে পারিনি। একূল-ওকূল হারানোর মত ব্যাপার। বর্তমান বছর অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের শুরুর দিকে আমি জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটের জার্মান ভাষা শিক্ষার একটা কোর্সে ভর্তি হই। এই জার্মান ভাষা শিক্ষা করতে গিয়ে কালচারাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর হের পিটার জেবিৎসের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। তাঁর সংস্পর্শে আসার পর অসমাপ্ত অনুবাদকর্মটির একটি গতি করার আকাঙ্ক্ষা মনে ঘনিয়ে উঠে এবং খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে মাত্র অল্পদিনের মধ্যে কাজটি শেষ করে ফেলি। (ছফা, খ. ২, পৃ. ৩৩৫)
ছিয়াশি সালে ফাউস্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ছফা কাকার পশ্চিম জার্মানি যাবার পথ প্রশস্ত হয়। বন্ধু জেবিৎসই তাঁকে এ ব্যাপারে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি পশ্চিম জার্মানি গিয়েছিলেন আগস্টের প্রথমদিকে এবং দু' মাসের মাথায় অক্টোবরের দিকে তিনি দেশে ফেরেন। জার্মানিতে কোলনস্থ জার্মান বেতারে (ডয়েস ভেলে) গ্যোতে এবং ফাউস্ট বিষয়ে তিনি তিনটি বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন।
জার্মানিতে অবস্থানকালে ছফা কাকা জার্মান প্রবাসী ইন্দিরা রায় নামে এক ভারতীয় মহিলার প্রেমে পড়েন। ভদ্রমহিলা খুব সম্ভব হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। ইন্দিরা রায়ের প্রসঙ্গ যেহেতু এসে গেল তার আগে আরেকজন ভদ্রমহিলার কথা আমাকে বলতে হবে, নইলে পুরো ব্যাপারটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
আমি যখন ঢাকায় এসে ছফা কাকার সঙ্গে থাকতে শুরু করি তখন তাঁর বাসায় একজন ভদ্রমহিলাকে প্রায় আসা-যাওয়া করতে দেখতাম। পরে পরে জেনেছিলাম ভদ্রমহিলার নাম 'র'। আগেও একজন 'র'-এর কথা লিখেছি। কিন্তু এই 'র' সেই 'র' নয়। ইচ্ছে করলে আমি এই ভদ্রমহিলার পুরো নামটি উল্লেখ করতে পারি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে তাঁকে বেকায়াদায় ফেলা ঠিক হবে না। ছফা কাকা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন আমি যেন 'র'কে ফুফু বলে ডাকি। কাকার শেখা কথায় আমি তাঁকে ফুফু বলে ডাকতাম।
—————————————————————–
…একদিন হল কী রুদ্র আমাকে জানাল, তসলিমা প্রস্তাব দিয়েছে সে আবার রুদ্রের সঙ্গে একঘরে থাকতে চায়। এ ব্যাপারে আমার মতামত কী রুদ্র জানতে চাইল। আমি বলেছিলাম খুবই উত্তম প্রস্তাব। এ অসুখের সময়ে তসলিমার মত কেউ কাছে থাকলে খুব ভাল হয়। রুদ্র বলেছিল তাহলে আপনি মুরুব্বিয়ানা করুন। আমাদের মিলমিশ করিয়ে দিন। আমার জবাব ছিল তসলিমা যদি রাজি থাকে তবে অবশ্যই আমার যেটুকু সাধ্য করব। তারপর রুদ্র আমাকে বলল, আগামীকাল সন্ধ্যায় তসলিমা আমাকে নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছে এবং রুদ্র আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। আমি যথারীতি রুদ্রের সঙ্গে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আধারাত অপেক্ষা করেও তসলিমার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। তসলিমা সংবাদপত্রে খবরটি এমনভাবে ফাঁস করেছেন যেন আমি দুষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলাম বলেই তাঁর দারোয়ানের সঙ্গে এক টুলে বসে কাটিয়েছি। আমি যদি অন্য উদ্দেশ্যে যেতাম আধারাত কেন গোটা রাতটাই অপেক্ষা করে ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করতাম না।
—————————————————————-
তাঁরা একে অপরকে পছন্দ করতেন। এমনকি তাঁরা বিয়ে করবেন–এ কথাটিও নিজেরা পাকাপোক্ত করেছিলেন। কিন্তু ছফা কাকা আমাকে দায়ী করতে থাকলেন আমার জন্য তিনি বিয়ে করতে পারছেন না। তিনি আমাকে বারবার বলতে থাকলেন আমি একটা ঘর দখল করে আছি বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে না। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, মিরপুর বাঙলা কলেজে পড়ি। তিনি আমাকে তাগাদা দিতে থাকলেন আমি যেন কলেজের হোস্টেলে উঠে পড়ি। আমি হোস্টেলে ওঠার চেষ্টায় ছিলাম বটে, কিন্তু হোস্টেলে ছাত্রসংখ্যা এত বেশি ছিল যে কোনো রকমে সিট পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। কাকা আমার জন্য বিয়ে করতে পারছেন না–একটা অপরাধবোধ আমার ভেতর সব সময় কাজ করত। ফলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম কোথাও চলে যাব। এমনকি পুনরায় গ্রামে চলে যাওয়ার কথাও আমাকে ভাবতে হয়েছিল।
আগেই বলেছি কাকা জার্মানিতে ইন্দিরা রায়ের প্রেমে পড়েছিলেন। এই প্রেমের গভীরতা এত বেশি ছিল যে 'র'কে ছফা কাকার কাছ থেকে সরে যেতে হয়েছিল। তখন ছফা কাকা মানসিকভাবে ভয়ানক রকম ভেঙে পড়েছিলেন। 'র'-এর চলে যাওয়া এবং ইন্দিরার দূরে প্রবাস জীবন যাপন দুটোর কারণেই তিনি হয়ত দহনজ্বালায় ভুগছিলেন। 'র'কে তিনি একরকম ভুলতে বসেছিলেন। প্রায় ভুলে গিয়েছেনও বলা যায়। তারপরও বেশ কিছুদিন পর ডাকে 'র'-এর একখানা চিঠি আসে। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি। চিঠিতে অভিমানের ভাষাটা বেশ প্রোজ্জ্বল ছিল। তাতে লেখা ছিল–ছফা সাহেব, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। নারীরা আপনাদের সাহিত্যের উপাদান ছাড়া আর কী হতে পারে!
ছফা কাকা ওই চিঠির জবাব দিয়েছিলেন কিনা জানা নেই। জবাব দেয়ার কথাও নয়। কারণ ইন্দিরা তখন ছফা কাকার মন-প্রাণ জুড়ে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। টেলিফোনে তখন তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ করতেন। উত্তরণ অফিসের আবু বকর সিদ্দিক ফণী একদিন জানালেন টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়েছে। প্রায় ষাট হাজার টাকা টেলিফোন বিল বাকি পড়েছে। টেলিফোনে কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা চিঠির লেনদেন শুরু করেছিলেন। এমন কোনো সপ্তাহ বাদ ছিল না তাঁরা চিঠি লেখালেখি করতেন না। ইন্দিরা রায়ের লেখা প্রায় দু' তিন শ' চিঠি আমার কাছে এখনও সংরক্ষিত আছে। মাঝখানে আমি ঢাকা শহরে ছিলাম না। আমাকে বিশেষ প্রয়োজনে গ্রামে চলে যেতে হয়েছিল। তখন ছফা কাকার সঙ্গে সপ্তাহে কম করে হলেও দু'টি চিঠি আদান-প্রদান হত। চিঠিতে ছফা কাকা ইন্দিরা রায়ের ব্যাপারেও আমাকে লিখতেন। নব্বই সালের একুশে এপ্রিল ছফা কাকা আমাকে লিখেছেন:
নব্বই-এর বিশ মে লিখেছেন :
জুনের ছয় তারিখ আবার লিখেছেন :
অক্টোবরের ত্রিশ তারিখের চিঠিতে:
ছফা কাকা একানব্বই সালের পয়লা মার্চ জার্মানি থেকে আমাকে আরেক চিঠিতে:
তিরানব্বই সালের মাঝামাঝি সময়ে ইন্দিরার সঙ্গে তাঁর প্রেমের ইতি ঘটে। কেন এমন হল আমি বলতে পারব না। তবে তিনি জুলাইয়ের সাত তারিখের চিঠিতে লিখেছেন:
ঊননব্বই সালে কোলকাতার মিরান্দা প্রকাশনী থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রকাশিত হয়। এ উপলক্ষে 'ত্রিপুরা হিতসাধনী সভা' মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত প্রকাশনা উৎসবে ছফা কাকা বক্তৃতা প্রদান করেন।
নব্বই সালে কাকা ভয়ানক রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়েছিল তিনি যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিয়াত্তর সালেও তাঁর শরীরের যক্ষা ধরা পড়েছিল। যক্ষা রোগ নির্মূলের জন্য যে দীর্ঘদিন ওষুধ সেবন করতে হয়, ছফা কাকা হয়ত সেটা করেননি। তিনি তো কখনও নিয়ম মেনে চলার মানুষ ছিলেন না। খুব সম্ভব আগের রোগটাই তাঁর শরীরে নতুন করে বাসা বেঁধেছিল। রোগ বাঁধিয়েছিল বটে, কিন্তু চিকিৎসা করার মত টাকা তাঁর ছিল না। ফলে তাঁর বন্ধু তপন চক্রবর্তীর কাছে গিয়ে হোমিওপ্যাথির ফ্রি চিকিৎসা নিতেন। দিলওয়ার হোসেন লিখেছেন:
হাসপাতাল ছেড়ে আবার তাঁর ব্যস্ততা, আবার অনিয়ম। 'উত্তরণ' তখন বন্ধ। থাকেন সোহরাব হোসেনের সঙ্গে পরিবাগের বাসায়। ৪/৫ মাস পর আবার হাসপাতালে। পরীক্ষায় ধরা পড়ে আবার টিবি দেখা দিয়েছে, সঙ্গে হাঁপানি, পাইলস এবং ডায়াবেটিসও। এবারও তিনি ডাক্তারের কথা শোনেন না। এখানেও প্রচুর সিগারেট খেতে থাকেন, চিনি দিয়ে চা খান, ওষুধ খেতে চান না। অবশেষে ডাক্তার তাঁর জন্য দৈনিক একটি, বড়জোর দু'টি সিগারেট খেতে অনুমতি দিলেন। চা হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হত সুকরোল দিয়ে। এবারও তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন।" (ছফা, স্মা., পৃ. ১৮৫)
কাকা একটি স্বেচচ্ছাসেবী সংগঠন 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি' গঠনে তৎপর হয়েছিলেন। নব্বই-এর আঠার ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটি জন্ম লাভ করে। সংগঠনটি গঠনে তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন জার্মান নাগরিক ফাদার ক্লাউস বুয়েলে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ছফা কাকা স্বয়ং। জনাব আজিজুল হক চেয়ারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন ডক্টর আনিসুজ্জামান। উন্নয়ন সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন ডক্টর হোসেন জিল্লুর রহমান। কবি অসীম সাহা ছিলেন এই সংগঠনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। প্রফেসর কবীর চৌধুরী, ডক্টর শমসের আলী, বেগম পারভিন আহমদ প্রমুখ ছিলেন সংগঠনের সদস্য। উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, লেখক হাসনাত আবদুল হাই, শিল্পী এস. এম. সুলতান, জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নাট্যকার শেখ আকরাম আলী, জনাব শাহ মো. নাজমুল আলম।
ঊনিশ শ' একানব্বই সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতি হয়। তখন এই সংস্থার মাধ্যমে কক্সবাজারের মহেশখালীতে পর্যাপ্ত ত্রাণকার্য পরিচালিত হয়। বিশেষ করে দুর্গত এলাকার মানুষদের ঘর নির্মাণে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সংগঠনটি। ভেঙে যাওয়া বেড়ি বাঁধ নির্মাণেও সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের গ্রামেও এক শ' বিশটার মত ঘর তৈরি করা হয়েছিল।
ঊনিশ শ' বিরানব্বই সালের ছয় ডিসেম্বর ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত ভারতের বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দিলে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। তার রেশ ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হন। কোথাও কোথাও তাদের ঘর-বাড়ি, উপসনালয় ইত্যাদি ধ্বংস করে ধর্মান্ধ মৌলবাদী চক্র। মহেশখালীর মাতার বাড়ির নাপিতপাড়ায় বেশ কিছু ঘর-বাড়ি নষ্ট করে ফেলেছিল। আগুনে দগ্ধ হয়ে একটি শিশুও মারা যায়। 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি' এ সকল ঘর-বাড়ি মেরামতে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। যেদিন ওই ঘরগুলো নির্মাণ করতে মাতারবাড়ি যান ছফা কাকা একটা সভা ডেকে অনেক মানুষের সমাগম ঘটিয়েছিলেন। এলাকার মান্যগণ্য বক্তিবর্গ ছাড়াও এ সভায় উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার জনাব কামাল উদ্দিন চৌধুরী, বিসিকের প্রাক্তন মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ সচিবের প্রাক্তন সচিব জনাব সিরাজ উদ্দিন, বুয়েটের ডীন ড. হারুনুর রশীদ, নাট্যকার সাঈদ আহমদ, তাঁর স্ত্রী পারভিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. অজয় রায়, সংস্কৃত বিজ্ঞানের প্রফেসর ড. নারায়ণ বিশ্বাস, দর্শন বিভাগের ড. আনিসুজ্জামান আরও অনেকে।
টাঙ্গাইলে মজলুম জননেতা মরহুম মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত 'সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে' এক ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল এই সংগঠনটি। এখানে মহিলাদের কাজের এক বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।
এ সংগঠনের মাধ্যমে যত ভাল কাজ হয়েছে তার প্রাণ-পুরুষ ছিলেন ছফা কাকা। 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি' পাশাপাশি গরিব মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠিত সংগঠন 'তরঙ্গ'-এর তিনি ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন।
ছিয়ানব্বই সালে এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ছফা কাকাকে 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি' থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তাঁর ধারণা, প্রফেসর কবীর চৌধুরী, কবি অসীম সাহা, মোফাখখারুল ইসলাম পাপা এবং ফাদার ক্লাউস বুয়েলে এই ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন। তাঁরা ছফা কাকাকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কৌশলে সরিয়ে দিয়েছিলেন। 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি'তে তিনি সদস্য হিসেবে থাকতে পারতেন। কিন্তু সংগঠন থেকে পদত্যাগ করাটাই তিনি যোগ্য বিবেচনা করেছিলেন। এর বড় একটা কারণ ছিল ফাদার ক্লাউসের সঙ্গে ছফা কাকার মানসিকভাবে না বনা। ক্লাউস সাহেব ছিলেন স্বৈরাচারী লোক। নিজের একক চিন্তা-ভাবনা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে তিনি দ্বিধা করতেন না। তাছাড়া তিনি ভোগবিলাসে মত্ত থেকে প্রচুর অর্থ নষ্ট করতেন যেটা ছফা কাকা পছন্দ করতেন না।
একানব্বই সালে 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি'র প্রতিনিধি হয়ে তিনি জার্মানিতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সম্প্রীতির জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। তিনি এ যাত্রায় প্রায় দুই কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেটি একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণের কাজে বিতরণ করেছিলেন। জার্মানি থেকে ফিরে ইংরেজিতে তিনি একটি ভ্রমণকাহিনী লেখেন, যাঁর শিরোনাম ছিল German Perspective। এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি' থেকে। বইটি বাংলাদেশে তেমন প্রচার-প্রসার পায়নি। বইটির সমস্ত কপি জার্মানিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই সময় ছফা কাকা প্রফেসর কবীর চৌধুরীকে দিয়ে হাসনাত আবদুল হাই-এর বিখ্যাত উপন্যাস সুলতান-এর ইংরেজি অনুবাদ করাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং বইটির বেশিরভাগ কপি জার্মানিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তিরানব্বই সালে যখন পুনরায় জার্মানি ভ্রমণে যান তখন জার্মানির ভেৎসলার শহরের মহাকবি গ্যোতের স্মৃতিবিজড়িত কিয়স্কটির (পানশালা) ছফা কাকার নামে নামকরণ করা হয় এবং জার্মান প্রধানমন্ত্রীর সইযুক্ত একটি সাদা স্বর্ণের ঘড়ি তাঁকে উপহার হিসাবে প্রদান করা হয়।
বিরানব্বই সালে ছফা কাকা বাংলা একাডেমীর সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু পুরস্কারটি তিনি প্রত্যাখান করেছিলেন। এ পুরস্কার প্রত্যাখানের পেছনে বোধকরি তাঁর একটা অভিমান কাজ করেছিল। তিনি আমাকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, "তোমাকে বোধহয় জানাইনি। বাংলা একাডেমী আমাকে একটা পুরস্কার দিয়েছিল। পুরস্কারটা নিলে ভাল হত। কিছু টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু আমি গ্রহণ করিনি। বিশ বছর আগে বাংলা একাডেমীর ওই পুরস্কার দেয়া উচিত ছিল। আমার মনে হয় পুরস্কারটা না নিয়ে আমি অন্যায় করিনি। আল্লাহ আমাকে অন্যদিক থেকে সম্মানিত করবেন।" (ছফা, খ. ৬, পৃ. ৩৪৮)
এ পুরস্কার প্রদানকে উপলক্ষ করে বাংলা একাডেমীর কর্মকর্তা এবং ছফা কাকার মধ্যে চিঠির মাধ্যমে বাক-বিতণ্ডাও হয়েছিল। বাংলা একাডেমীর ব্যাপারে ছফা কাকা অনেকগুলো অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। মহাপরিচালককে লেখা তাঁর এক চিঠিতে উল্লেখ পাই, একাডেমীর এক কর্মকর্তা কাকাকে গালমন্দও করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে ছফা কাকা বাংলা একাডেমীকে একটি গোশালার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
চুরানব্বই সালে জার্মান কনসাল জেনারেলের আর্থিক সহায়তায় মিরান্দা প্রকাশন থেকে ফাউস্ট-এর অনুবাদের একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এ উপলক্ষে ম্যাক্সমুলার ভবনে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং ছফা কাকা এতে ফাউস্ট অনুবাদের ওপর একটি বক্তৃতা প্রদান করেন। এই অনুষ্ঠানে অনুবাদের নির্বাচিত অংশ পাঠ করা হয়। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেত্রী অপর্ণা সেন, নাট্য-পরিচালক সোহাগ সেন, গায়ক অভিনেতা ও পরিচালক অঞ্জন দত্ত একটি পাঠপর্বে অংশ নিয়েছিলেন। এ যাত্রায় মিরান্দা প্রকাশন থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রকাশেরও একটি ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন।
এই বছর বাংলা একাডেমী বইমেলা উপলক্ষে স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁকে নানারকম বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কেউ বলেছিল এরকম একজন লেখককে নিয়ে লিখে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, কেউ কেউ বলেছেন, কাকা যোগ্য কাজটিই করেছেন।
এক সময় তসলিমার সঙ্গে ছফা কাকার একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল। এটা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে কিনা বলতে পারব না। দু'জনেই কাকার প্রীতিভাজন ছিলেন তাঁর নানা লেখায় এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে জীবনে আমি একবার দেখেছিলাম। কাকা একদিন কবি রুদ্রকে মিরপুরের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। তখন তাঁর একটি বই আমার হাতের কাছে ছিল। বইটির নাম ছিল মানচিত্র। ওই বইয়ের মলাটটি ছাপা হয়েছিল রুদ্রের ছবি দিয়ে। সুতরাং তাঁকে প্রথম দেখায় আমার চিনতে একটুও ভুল হয়নি যে ইনি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ছফা কাকা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, এঁরে চেন? ইনি বাংলাদেশের একজন বড় কবি।
আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিলাম, অবশ্যই চিনি। তিনি কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে যেভাবে দেখেছিলাম তসলিমাকে দেখার সেই সুযোগ আমার কখনও হয়নি। তারপরেও তসলিমার ব্যাপারে কিছু কথা আমাকে লিখতে হবে। সেটা লিখব ছফা কাকার কথা ধার করে, নিজের থেকে একটুও নয়।
তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে কাকার সম্পর্ক এক সময় তিক্ততায় ভরে উঠেছিল। তসলিমার নিমন্ত্রণ বইটি পড়ে অনন্যার এক সাক্ষাৎকারে ছফা কাকা বলেছিলেন, এটা একটি ইতর শ্রেণীর রচনা। তসলিমা নাসরিন কাকার কথায় খেপে গিয়ে খবরের কাগজে আরেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আহমদ ছফা ইতর প্রকৃতির মানুষ। তিনি মৌলবাদীদের সঙ্গে জুটেছেন। তিনি লিবিয়ার দালালি করেছেন, এখন ইরানের খোমেনীপন্থীদের সঙ্গে দহরম-মহরম করে চলেছেন। তসলিমার মতে, আহমদ ছফা কথা দিয়েছিলেন তিনি তসলিমার হয়ে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। তারপর কিছুটা খারাপ ইঙ্গিত করে তসলিমা বলেছেন, একবার আহমদ ছফা তসলিমার জন্য অপেক্ষা করে আধা রাত দারোয়ানের সঙ্গে টুলে বসে কাটিয়েছেন। স্বাভাবিক কারণে তসলিমার প্রতি ছফা কাকা ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। ফলে তসলিমার কথার জবাব তসলিমাকে লিখিতভাবে দিতে হয়েছিল। তাঁর ভাষ্য:
তারপরে আসি লিবিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে। ওই দেশটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল এতে লুকানোর কোন কিছু আছে এমন মনে করি না। এখন ইরান প্রসঙ্গ। ইরানের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক কস্মিনকালেও ছিল না। আয়াতুল্লাহ খোমেনীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকায় সাফল্য সত্ত্বেও তাঁর মতবাদকে আমি আধুনিক সভ্যতার পরিপন্থী বলে মনে করি। অনেকবার সাভানার রোলার সঙ্গে আমি আয়তুল্লাহ খোমেনীর তুলনা করেছি।
…তসলিমা নাসরিন শুধু একা নন। আজকাল অনেক বড় বড় মানুষ আমাকে মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে আনন্দবোধ করেন। এঁদের মধ্যে দেশের বড় কবি, প্রথিতযশা অধ্যাপক, সাংস্কৃতিক-কর্মী এবং শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকেই রয়েছেন। তাঁরা এই সম্মানটা আমাকে দিতে এতটা কেন আগ্রহবোধ করেন তা সত্যি সত্যি অজানা। এ সমস্ত ভদ্রলোক যাঁরা হাওয়া পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টান, অতীতের কর্মকাণ্ড গর্ভগুহার মধ্যে লুকিয়ে রেখে শুধু গলাবাজির জোরে জনমানসে এক একটি স্থান অধিকার করতে চান, তাঁদের চিন্তা-ভাবনা এতই অপরিণত, তাদের সুবিধাবাদ এতদূর; নির্লজ্জভাবে ননী মাখন লুট করা ছাড়া দেশ জাতির উপকারে আসে এ ভূমিকায় তাঁদের কোনদিন দেখা যায়নি। তাঁদের আসল স্বরূপ জনসমক্ষে উন্মোচন করে দেখানো আমার কর্ম নয়। আমার পথ আলাদা। আমি লোম বেছে কম্বল উজাড় করার কাজে লাগতে পারব না।
তবে আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশের তথাকথিত বড়লোকদের সূক্ষ্মচিন্তাহীন উচ্চ চিৎকার মৌলবাদকে শক্তিশালী করার কাজে অনেকখানি সাহায্য করেছে। মৌলবাদ যেভাবে অন্ধবিশ্বাস সম্বল করে সমস্ত চরাচর দখল করে নিতে চায়, উনারাও এক ধরনের আবেগী অন্ধবিশ্বাস, অত্যন্ত উচ্চ চিৎকার উচ্চারণ করে মৌলবাদ ঠেকাচ্ছি আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। কিন্তু এভাবে মৌলবাদ ঠেকানো যায় না। এক অন্ধতার বিরুদ্ধে আর এক অন্ধতা প্রচার করে মৌলবাদ ঠেকানো সম্ভব নয়। যেখানে ব্যক্তিবাদী চিন্তা পরাজিত হয়, যেখানে একপেশে সংকীর্ণতা ও গোঁয়ার্তুমী মানুষের মনের নিরন্তর প্রশ্নশীলতা চেপে রাখে সেখানে মৌলবাদের উদ্ভব ঘটতে বাধ্য। মৌলবাদ আসলেই ফ্যাসিবাদ। ধর্মের নামে উদ্ভাসন ঘটলেও তার বহু রকম চেহারা ও আকার রয়েছে। তথাকথিত প্রগতিশীল বু্দ্ধিজীবীরা যা-ই বলুন, সমাজে তাঁদের প্রকৃত অবস্থানটি কোথায় ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে তাঁদের প্রকৃত পরিচয় উন্মোচিত হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমি আর কোন কথা বলব না।
…গোড়াতে তসলিমার সঙ্গে আমার একটা স্নেহের সম্পর্ক ছিল। যতকাল তিনি রুদ্রের স্ত্রী ছিলেন অনেকবার আমার কাছে এসেছেন। এক সময়ে আমি অসুস্থ অবস্থায় তোপখানা রোডে অবস্থান করছিলাম। তসলিমা এবং রুদ্র একরাতে তাঁদের বাসায় নিয়ে গিয়ে অনেক সমাদর করেছিলেন এবং চিকিৎসা বিষয়ক আনুষঙ্গিক উপদেশ দিয়েছিলেন। রুদ্রের সঙ্গে বিয়ে ভাঙার পরেও তসলিমা অনেক অনেকবার তাঁর নতুন নতুন বন্ধুদের নিয়ে আমার বাসায় এসেছেন। এখানে পাঠকদের একটি বিনীত অনুরোধ করব। তসলিমা সাধারণত যে সমস্ত লেখক-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক লেখার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেন আমাদের সম্পর্ক কখনও সে পর্যায়ে ছিল না, একথাটি যেন বিশ্বাস করেন।
…তসলিমা বলেছেন তাঁর বাড়িতে যেয়ে দারোয়ানদের টুলে বসে আমি আধারাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। কথা সত্যি। তবে একটু ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। তসলিমা আমাকে অন্তত পঞ্চাশবারেরও বেশি তাঁর বাড়ি যেতে নিমন্ত্রণ করেছেন। একবার আর্মানিটোলার ফ্ল্যাটে গিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করেছি এবং চা-নাস্তা খেয়ে এসেছি। যেবার দারোয়ানের টুলে বসে আধারাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি বলে তসলিমা উল্লেখ করেছেন সে কাহিনীটা একটু ভিন্ন। পেছনের ঘটনাটি খুলে না বললে বিষয়টি সকলের কাছে স্পষ্ট না-ও হতে পারে।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে তসলিমার ছাড়াছাড়ি হয়েছিল অনেকদিন আগে। তারপর রুদ্র অনেকদিন ঢাকা শহরে আসেনি, খুলনা চলে গিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে তার কোন দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেনি। মারা যাওয়ার সাত-আট মাস আগে থেকে রুদ্র আবার ঢাকা শহরে ফিরে এসে এখানে-সেখানে কাজকর্মের চেষ্টা করতে থাকে। কেউ তাকে চাকরি দেয়নি।
…একদিন হল কী রুদ্র আমাকে জানাল, তসলিমা প্রস্তাব দিয়েছে সে আবার রুদ্রের সঙ্গে একঘরে থাকতে চায়। এ ব্যাপারে আমার মতামত কী রুদ্র জানতে চাইল। আমি বলেছিলাম খুবই উত্তম প্রস্তাব। এ অসুখের সময়ে তসলিমার মত কেউ কাছে থাকলে খুব ভাল হয়। রুদ্র বলেছিল তাহলে আপনি মুরুব্বিয়ানা করুন। আমাদের মিলমিশ করিয়ে দিন। আমার জবাব ছিল তসলিমা যদি রাজি থাকে তবে অবশ্যই আমার যেটুকু সাধ্য করব। তারপর রুদ্র আমাকে বলল, আগামীকাল সন্ধ্যায় তসলিমা আমাকে নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছে এবং রুদ্র আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। আমি যথারীতি রুদ্রের সঙ্গে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আধারাত অপেক্ষা করেও তসলিমার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। তসলিমা সংবাদপত্রে খবরটি এমনভাবে ফাঁস করেছেন যেন আমি দুষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলাম বলেই তাঁর দারোয়ানের সঙ্গে এক টুলে বসে কাটিয়েছি। আমি যদি অন্য উদ্দেশ্যে যেতাম আধারাত কেন গোটা রাতটাই অপেক্ষা করে ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করতাম না। আমার জীবনে এমন ঘটনা অল্প নয়। অনেক নামহীন গোত্রহীন মহিলার পেছনেও আমি রাতের পর রাত অপেক্ষা করে কাটিয়েছি। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নষ্ট করেছি। কারণ ওই মহিলাদের তখন ভাল লেগেছিল। কাউকে ভাল লাগার একটা তাৎক্ষণিক মূল্য আছে। এটা দিতে আমি কখনই কার্পণ্য করিনি।
তসলিমার সঙ্গে আমার কোনো গহন সম্পর্ক কখনো গড়ে ওঠেনি। সে চিন্তা আমার মাথায়ও আসেনি। তাঁকে সব সময় রুদ্রের বউ হিসেবে আমি কল্পনা করেছি। এখন তসলিমা যেভাবে প্রচার করছেন পাঠকের এমন ধারণা অস্বাভাবিক নয়। আমি মত্তমাতঙ্গের মত তাঁর প্রেমে উন্মত্ত হয়ে ঘরের দুয়ারে মাথা ঘষতে ছুটে গিয়েছিলাম। কথাটার মধ্যে একটুও সত্যতা নেই। আমার সঙ্গে যে মানুষটি আধারাত কাটিয়েছিল সে ছিল তসলিমার এককালীন স্বামী, প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। হালফিল তসলিমার কল্পনা একটা দিকেই আবর্তিত হতে আরম্ভ করছে। যখনই কোনো পুরুষ মানুষের প্রসঙ্গ আসে তসলিমা মনে করতে থাকে লোকটি তার সঙ্গে গোপন অভিসার করতে ছুটে আসছে। আমার আধারাতের প্রতীক্ষার কথা বলে যে অনুগ্রহ তিনি দেখিয়েছেন সম্ভবত তার মধ্যেও একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত তিনি দিতে চেষ্টা করেছেন। আমি তো আমার কথা বলে ফেলেছি। পাঠক যা ইচ্ছা ধরে নিন। আমি যদি তসলিমার প্রেমে পড়তাম আধারাত নয় আধাযুগ তাঁর পেছনে ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হতাম না। কিন্তু বুকের ভেতর ওই বোধটি আমার জাগেনি। যতবারই তসলিমাকে দেখেছি, আমার তাঁকে সুন্দর সুদৃশ্য একটি রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমের মত মনে হয়েছে। যেখানে অনেক পুরুষ অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু কোনো গহনতা, নির্জনতা নেই।" (ছফা, খ. ৮, পৃ. ৮১)
তসলিমা নিয়ে বিতর্ক এখানে থেমে থাকলে ভাল হত। কিন্তু তসলিমাকে যখন লজ্জা উপন্যাসের জন্য 'আনন্দবাজার' পুরস্কার ঘোষণা করল তখন ছফা কাকা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তসলিমাকে পুরস্কার প্রদান করে আনন্দবাজার এক রকম প্রতিশোধ নিয়েছিল। কেন প্রতিশোধের কথা বললাম শোনা যাক ছফা কাকার ভাষায়:
তসলিমা নাসরিনের সূত্র ধরে পশ্চিম-বাংলার একজন পণ্ডিত ব্যক্তির কথা অনায়াসে এসে পড়ে। এই অসামান্য ব্যক্তিটির নাম শ্রী শিবনারায়ণ রায়। এই মানুষটির প্রতি ছফা কাকার ঋণ কম নয়। সাহিত্যাঙ্গণে বিচরণ করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কাকার ব্যক্তিগত পরিচয় গড়ে উঠেছিল। তাঁদের মধ্যে প্রায় সময় চিঠিপত্র আদানপ্রদান হত। মাঝে মাঝে ফোনালাপও চলত। কিন্তু শিববাবু যখন তসলিমাকে নিয়ে পক্ষপাতিত্বের সুরে কথা বলতে থাকলেন ছফা কাকা স্বাভাবিকভাবে মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কাকা শিববাবু সম্পর্কে লিখেছেন:
শিববাবুর প্রতি ছফা কাকা উঁচু ধারণা পোষণ করতেন বটে; কিন্তু তসলিমা ইস্যুতে সেই সম্পর্কের কিছুটা ভাটা পড়ে। জানা যায়, শিববাবু তসলিমা এবং আনন্দবাজারকে অন্ধভাবে না হলেও সজ্ঞানে সমর্থন করতেন। ছফা কাকা লিখেছেন:
উনিশ শ' চুরানব্বই সালে ছফা কাকা শেষবারের মত জার্মানিতে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন বাংলা-জার্মান সম্প্রীতির একটি সাংস্কৃতিক টিম নিয়ে। ওখান থেকে যান সুইজারল্যান্ডে। তিনি ওখানে গিয়ে দেখতে পান তসলিমা-বৃত্তান্ত মানুষের মুখে মুখে। ওই দেশের মানুষের ধারণা হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি মৌলবাদীদের দখলে চলে গেছে। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে কোন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে বাস করা সম্ভব নয়। বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম এভাবে ক্ষুন্ন হওয়ার জন্য ছফা কাকা তসলিমা নাসরিনকে দায়ী করেছিলেন। তিনি তসলিমার ওপর ভীষণ ক্ষীপ্ত হয়েছিলেন এবং দেশে ফিরে তিনি 'সাপ্তাহিক রোববারে' একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখাটির শিরোনাম ছিল 'আসুন তসলিমার জানাজা পড়ি'। এই লেখাটি পত্রিকাটির কভার স্টোরি হয়েছিল। লেখাটি যখন পত্রিকায় ছাপা হয় দুয়েকদিনের মধ্যে সব কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে পত্রিকাটির ওই সংখ্যা পুনরায় ছেপে বাজারে ছাড়তে হয়েছিল। পরে এই রচনাটি 'নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ' বইয়ে 'তসলিমার জার্মান কাণ্ড' শিরোনামে স্থান পায়। ওই লেখার একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। ছফা কাকা লিখেছেন:
তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসটি সরকারকে খানেকটা হলেও বিপদে ফেলে দিয়েছিল। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি সরকার। আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ বইটিতে তসলিমা সম্পর্কে কাকা কিছু কড়া জবাব দিয়েছিলেন। ওই সময় সাংবাদিক নাজিম উদ্দীন মোস্তানের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি তখন রাষ্ট্র নামের একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করতেন। পত্রিকাটি মোটামুটি জনপ্রিয়ও হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক সংকট এত প্রকট ছিল যে পত্রিকাটি এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। ওই পত্রিকায় আমিও বছর দুয়েক কাজ করেছি। এই পত্রিকার সুবাদে, কিংবা অন্য কারণে হোক বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে নাজিম উদ্দীন মোস্তানের একটা সুন্দর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময় নাজিম উদ্দীন মোস্তান কাকার আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ বইটি বেগম খালেদা জিয়ার হাতে পৌঁছিয়েছিলেন। বইটি পড়ে খালেদা জিয়া আহমদ ছফা সম্পর্কে জেনেছিলেন এবং তাঁকে ফোন করে দাওয়াতও করেছিলেন। তবে ছফা কাকা যাননি। তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে বলেছিলেন, যেতে পারি এক শর্তে। আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে হবে। শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে রান্না করে খাইয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার রান্না করার সময়ও হয়নি, ছফা কাকাও যেতে পারেননি।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছফা কাকার আরেকবার ফোনালাপ হয়েছিল। উপলক্ষ ছিল এনজিও ব্যুরো থেকে 'বাংলা-জার্মান সম্পীতি'র রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে। ছফা কাকাই বেগম জিয়াকে ফোন করেছিলেন। ফোনটি ধরেছিলেন তাঁর পিএস। ছফা কাকা বিনয়ের সঙ্গে পিএসকে বলেছিলেন, ম্যাডামকে কি একটু দেয়া যাবে? আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
পিএস সাহেব জানতে চাইলেন, আপনি কে?
কাকার জবাব, আমি আহমদ ছফা।
পিএস সাহেব ফের জানতে চাইলেন, কোন আহমদ ছফা?
পিএস-এর কথায় ছফা কাকা ভয়ানক রকম খেপে গিয়েছিলেন। তিনি রাগলে সচরাচর যে গালটি তাঁর মুখ দিয়ে বা'র হত সেটি বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি কোন রকম ভূমিকা না করে বললেন, বাংলাদেশে আহমদ ছফা দু'জন আছে নাকি?
ছফা কাকা কথা না বাড়িয়ে রিসিভারটি ধপাস করে রেখে দিয়েছিলেন।
পিএস সাহেব ছফা কাকার এ অশোভন আচরণের কথা বেগম জিয়াকে জানিয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি। কিছুক্ষণ পরে বেগম জিয়া ফোন করেছিলেন। ছফা কাকার কথার ঝাল তখনও থেকে গিয়েছিল। ফোন পেয়ে তিনি বেগম জিয়াকে বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ম্যাডাম, কী সব অশিক্ষিত পিএস টিএস রাখেন আহমদ ছফার নাম জানে না।
ছফা কাকার কথায় বেগম জিয়া হেসে জবাব দিয়েছিলেন, আমি নিজে অশিক্ষিত; শিক্ষিত মানুষ পাব কোথায়। আপনারা কেউ তো এগিয়ে আসছেন না?
'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি' থেকে বাসায় লোকজন এলে কাকা বেগম জিয়ার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়টি সবিস্তারে বয়ান করেছিলেন। তিনি বেগম জিয়ার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বারবার বলে যাচ্ছিলেন, ভদ্রমহিলার তারিফ না করে পারা যায় না। তিনি আশ্চর্য রকম বিনয়ী।
ছফা কাকা বেগম জিয়ার কাছ থেকে 'বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি'র রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে সহযোগিতা পেয়েছিলেন এবং কাজটা খুব তাড়াতাড়ি হয়েছিল।