Published : 11 Jun 2020, 11:33 PM
আমরা জানি, এবং এ প্রশ্নাতীত, যে পৃথিবীতে আর সব প্রাণীর মত মানুষও নশ্বর। ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুই প্রত্যেকের চূড়ান্ত পরিণতি, সারা জীবনের সঞ্চয়-অপচয় এককভাবে তার শূণ্যে বিলিয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারে না। এদিক থেকে কারও বাস্তব জীবনে চাওয়া পাওয়ার সব হিসাবই নিরথর্ক। কিন্তু তাদের পেছনে ছোটা অনিবার্য নাস্তির সামনে যেন এক অন্তহীন তাগিদ। এই ভুবনে প্রাণের লীলায় সবটাই তা গ্রাস করে। এবং তার সচলতাই জীবনপ্রবাহে নিয়তির মত ক্রিয়াশীল। সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বিষাদ, সব নিয়ে প্রতিটি প্রাণময় সত্তা, নিষ্ফল জেনেও, 'আরো দুই মুহূতের্র ভিক্ষা মাগে', 'জীবনের প্রচুর ভাঁড়ারে' অনাদ্যান্ত মোহ জাগে অনিঃশেষ। মৃত্যুই যে ধ্রুব, এটা চোখ রাঙালেও জিজীবিষা মরে না। মহাভারতে ধর্মবক যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'সব চেয়ে আশ্চর্য কী? উত্তরে বলেছিলেন, প্রতিদিন প্রাণীসমুদয় (ভূতাদি) 'যমমন্দিরে' ঢুকে যাচ্ছে। তার পরেও আমরা বেঁচে থাকতে চাই, এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী? (কিমাশ্চমতঃপরম)? মৃত্যুপথযাত্রী সুলতানের শেষ প্রশ্নের জবাবে মহাকবি ফিরদৌসিও আরো একটু বিষাদ মিশিয়ে জানিয়েছিলেন, 'জাহাপনা, পৃথিবীতে মানুষ জন্মায়, কষ্টপায়, মারা যায়, তার জীবনের সার্থকতা এই!' যুধিষ্ঠির বা ফিরদৌসি কোন ভ্রান্ত মায়া জাগাননি। ব্যক্তি জীবনের সারাৎসারই তাঁরা স্পর্শ করেছেন। এবং তা সর্বাত্মক। নিজের কাছে সর্বাধিক কিছু হলেও সে তার ধর্ম মাত্রও ধরে রাখতে পারে না। মৃত্যু তাকে পরাস্ত করে। মানব প্রবাহে ওই কীর্তির রেশ অবশ্য বহু দূর থেকে যেতে পারে। ভাল মন্দ যাই হোক না কেন। ব্যক্তি নশ্বর হলেও মানব সমুদয় তা নয়। 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়'। ঐতিহ্যে অধিকার তাতে সম্পূর্ণ করে এই পরস্পরবিরোধী অনিবার্যতার টানাপড়েনের কশাঘাতে বিড়ম্বিত হতে হতে পথ খোঁজা, আর পথ চলা তার অবশ্যম্ভাবী নিয়তি। এবং এর দায় সম্পূর্ণই তারই। প্রত্যেকের, ও সকলের। যদিও ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক বিচারবোধ আপেক্ষিক। এবং তা দেশ-কাল পাত্রর মুখাপেক্ষী।
তারপরেও বিবেচনায় নৈর্ব্যক্তিক কল্যাণ এষণা কাঙ্খিত। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের অন্ধ তামস ওই মানব যাত্রার এতিহ্যে মিশে থাকলেও তার সঙ্গে যুগে-যুগে পদে পদে লড়াই করতে করতেই তার এতদূর আসা। পেছনে মৃত মানুষের অবিরাম ধারা বয়ে নিয়ে চলে-এবং মুছেও ফেলে-তার কর্ম অপকর্মের সকল কালচিহ্ন। আমরা বাস্তবের ধাবমানতায় অসংখ্য গতিপথের দিকচিহ্ন খুঁজি। ঐতিহ্যের স্বরূপ—এক নয়, একাধিক—মাথা তোলে, বিকশিত হবার আভাস দেয়; হারিয়েও যায়। অথবা আত্মাবামননার প্রদর্শনী খোলে। 'কালের যাত্রা' কিন্তু 'উদ্দামউধাও'। তার পথরেখা সম্ভাবনার একটি মাত্র পথ ধরে এগোয়। সংশ্লিষ্ট মানবসমুদয়ের ভাবনারাশি, কীর্তি-অপকীর্তি, পতন-উত্থান সবই তার উপাদান। তিল-তিল করে বললেও বাড়িয়ে বলা হয়, তিলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সমূহের সকর্মক ও অকর্মক মিলিত প্রবাহে তারা ঐতিহ্যের রূপ-কাঠামো নির্মাণ করে । ঠিক-বেঠিকের স্বয়ংশাসিত কোন ধারণা প্রাথমিকভাবে অবান্তর, মূল্যমান স্থান ও কালনির্দিষ্ট মানব-মানবীরচলমান ক্রিয়ায়-প্রতিক্রিয়ায় প্রাসঙ্গিক। এবং গুরুত্বপূর্ণও বটে। তবে তা ওই মানব প্রবাহের প্রেক্ষিতে। কোন কোন ব্যক্তির কোন কোন বাস্তবতায় তাতে প্রবল ছাপ রেখে যাওয়া সময়ের খণ্ডাংশে স্মৃতির সীমায় খুবই সম্ভব। কিন্তু ব্যক্তি স্বয়ং তার ফলভোগের অধিকারী নয়। মৃত্যু তাকে নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় শক্তির মৌনে নিক্ষেপ করে। এই স্ববিরোধ ঐতিহ্যে প্রাথমিক সত্য। কল্পনার মায়া দিয়ে শূন্যের আগ্রাসন ঠেকারবার প্রয়াস অবশ্য তারই অকরুণ প্রতিক্রিয়া। ঐতিহ্য তা মেনে নেয়। তাতে মূল্য আরোপ করে। পরিণাম সব সময় শুভ হয় না। মহৎ ভ্রান্তি বৃহৎ বিশ্বাসে রূপান্তরিত হলে মানবভাগ্যে বিপর্যয় অস্বাভাবিক থাকে না। আরো একটা বিষয় খেয়াল করবার। ঐতিহ্য কালের ধারাবাহিকতা মানে না। স্মরণাতীত কালের অলৌকিক মায়া, আর, কাছের ঘটনারাশির সম্পূর্ণ জাল তালগোল পাকিয়ে সমষ্টি চেতনায় খোপে-খোপে, অথবা নাটাই-এ জাড়ানো অবিচ্ছিন্ন সুতোর গুটিয়ে থাকার মত ঘাপটি মেরে থাকে; বতর্মান কালের বহুমুখী টানাপড়েনে সুযোগ পেলে ফুঁসেও ওঠে। ভুক্তভোগী মানুষে উত্তেজনা ছড়ায়। অনেক সময় যুক্তি-বুদ্ধির ধার ধারে না। উদ্বোধন বা অধোগমন, ফলবতী হতে পারে যে কোনটিই। নিরর্ভর করে তা ওই সব মানুষের সাড়া দেবার, অথবা অভিঘাত ঠেকাবার ক্ষমতার ওপর যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি সুযোগসন্ধানীদের উদ্যোগ গণমানসে কতদূর ছড়ায়, তার ওপর। ঐতিহ্য তাই আমাদের অস্তিত্ব চেনায়, আবার তাকে বিপর্যস্তও করে। সেখানে ঐতিহ্যে ভ্রান্তিও কম দায়ী নয়। এই ভ্রান্তি মানুষেরই কর্মফল। অনেক সময় স্বেচ্ছাকৃত। জোটবন্ধ স্বার্থ উদ্দেশ্যমূলক তাড়না তাতে ইন্ধন জোগায়। যদিও যথোচিত ঐতিহ্য-সচেতনতা তাদের প্রকৃত আত্মজ্ঞানে উদ্বোধিত হতে প্রেরণা জোগাবে, এমনটিই সাধারণ প্রত্যাশ।
অস্বীকার করা যায় না, ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধারায় মানব জগতের বিকাশ ঘটেছে। সবার গল্প একরকম নয়। প্রকৃতির দাক্ষিণ্য বা কার্পণ্য নানা রূপে-নানাভাবে মানুষের হয়ে ওঠায় ছাপ ফেলেছে। দাপটও দেখিয়েছে। প্রকৃতি যেখানে নির্দয়, আবহাওয়া প্রতিকূল, দীর্ঘ-দীর্ঘ পরম্পরায় মানুষও সেখানে নির্মম। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বিধি-বিধান মাথা তুলেছে কত পরে! এবং সে সবেও কত রকম ফের। অবশ্য উৎস যতদূর জানা যায়,এক। এখন সেখান থেকে কী করে কোথায় কখন ছড়িয়ে পড়া তা অনেকটাই অনুমান যদিও বুদ্ধির নৈর্ব্যক্তিক কর্ষণীয়। তবে কালের মাত্রা এতটাই বিশাল, আপাতভাবনায় অসীমই, যে মানব ঐতিহ্যের গোড়ায় পৌঁছতেও কেটে যায় লক্ষ- লক্ষ সৌর-বৎসর। কিছুই তার রূপকথা নয়। সব বাস্তব। হয়ত চেতনায় অস্পষ্ট। কিন্তু ধারণা বাঁধা পড়ে সম্ভাবনার সীমায়। এবং তা যৌক্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাচাই করে নিয়ে তারপর। মানুষ তাতে বিশ্ব প্রকৃতির সীমায় প্রাণের যাত্রায় শামিল হয়। আবার, এই নশ্বরতায় নিরবলম্ব নিরর্থক যাত্রাকে সহনীয়, এবং কল্পনায় অর্থবহ, করার আকুতিতে অলৌকিকের শরণ নেয়। তাতেই শান্তির আশ্রয় খোঁজে।
আজ আমরা অনেকখানি নিশ্চিত হয়ে জোর দিয়ে বলতে পারি, 'সুদূর, বিপুল সুদূরে' প্রায় সাড়ে তের বিলিয়ন বছর আগে অচিন্ত্যনীয় ভরের অকল্পনীয় শূন্যতায় যে মাহবিস্ফোরণ ঘটে,- কেন, তার উত্তর মেলে না,¬- তারই পরিণামে মহাকাশে মহাবিশ্বের অনন্তাভিসারী অন্তহীন বিস্তার, যার গতিবেগ অপ্রশমিত ও বিকাশ অবাধ। এই প্রক্রিয়ায় চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ- তারা সব পারস্পরিক আকর্ষণে-বিকর্ষণে আপন আপন পথে সচল। তাদের আকার, তাড়না ও গতি এই সহ-স্বয়ংক্রিয়ার চলমান পরিণাম। নীহারিকাপুঞ্জ, ছায়াপথ, সমস্ত নিয়ে মহাবিশ্বের বিরামহীন ব্যাপ্তি, লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ পেরিয়েও যার সমাপ্তি মেলেনা। এখানে পৃথিবী আপন বিপুল ছায়া পথে সূর্য নামে নক্ষত্রের এক গ্রহ। সমগ্রের প্রেক্ষাপটে এতই তুচ্ছ যে আমাদের দৈনন্দিন ভবনায় ধুলোকণা যেমন, অথবা তার চেয়ে অকিঞ্চিতকর। মহাবিশ্বের স্বয়ংক্রিয় আয়োজনের বাইরে থেকে কোন মহাবোধি এ নিয়ে ফন্দি ভাঁজবেন, তার কোন সংগত ব্যাখ্যা মেলে না। এটা আরো স্পষ্ট হয় এই পৃথিবীতেই অনু-পরমাণু থেকে প্রাণের অভিযাত্রায় পথ পরিক্রমার দিকে যদি নজর দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, তবে মহাবিস্ফোরণের ফলে পদার্থ, শক্তি, কাল ও স্থানের আবির্ভাব ঘটে। খেয়াল করি, আগে-পরে সময়ের হিসাব তার পরিণাম। এর প্রায় তিন লক্ষ বছর পরে বস্তু ও শক্তির পারস্পরিক সংঘর্ষনে অনু-পরমাণুর সৃষ্টি। আরো অনেক পরে, আজ থেকে পৌনে চার বিলিয়ন বছরের মত আগে এই পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন শোনা যায়। অন্তর্বতীকালে ক্রমাগত চলতে থাকে মৌল কণা-রূপান্তরিত কণা ইত্যাদির কার্যকারণহীন উদ্দেশ্যহীন সংযোগ-সংঘাত। প্রাণের আবির্ভাব তারই আকস্মিক পরিণাম। পৃথিবী স্বয়ং আকার পেয়ে সৌরমণ্ডলে জায়গা করে নেয় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে। প্রাণের উদ্বর্তনে মানুষের আকার জেগে ওঠে, প্রথমে আফ্রিকায়, তারপরে কেটে গেছে প্রায় আড়াই মিলিয়ন বছর। যাকে বলি সভ্যতার উষাকাল, তার জন্যে তখন 'স্তধ্ব আসনে প্রহর'গোনার শুরু। দেখা মেলে তার আজ থেকে প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে। কৃষি কাজের উদ্ভাবন আরো আটান্নো হাজার বছর পার করে। বিজ্ঞানের গুরুত্ব পাওয়ার কাল বতর্মানে বড় জোর পাঁচশ বছর, এই সময়ে পৃথিবীতে মানুষ তার ছাপ ফেলেছে প্রায় সকল স্থলভাগে। তবে বস্তুগত অবস্থা তাকে সমজাতীয় করে না। পারিপার্শ্বিকতা ও জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতা অনিবার্যত বিভিন্ন। এবং প্রতিটি মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন। চাহিদা ও প্রাপ্তির সম্ভাবনা প্রত্যেকের নিজের নিজের মত। তাই সভ্যতার বিকাশ ঘটে আলাদা-আলাদা চাক বেঁধে আপন আপন ছকে। ব্যক্তি ও সমষ্টি একে অন্যে নির্ভর করে। বিচ্ছিন্নও হয়। মানুষে-মানুষে নৈকট্য ও দূরত্ব, দুই-এ মিলে জীবন যাত্রার-সংগ্রামেরও -প্রেক্ষাপট রচনা। বৃত্ত যেমনই হোক। এবং বৃত্ত থেকে বৃত্তান্তরে যাতায়াত-রেখা সরল বা জটিল, যাই হোক। যৌক্তিক ও গাণিতিক শুদ্ধি কাম্য হলেও অনায়ত্তই থেকে যায়। অনেক সময় অমন শুদ্ধতা ও কাম্যতা বিপরীত মুখে হাঁটে। 'সহজ-কঠিন দ্বন্দ্বে-ছন্দে' পথ চলা। পথ হারানোও। এবং, আগেই বলেছি, মৃত্যুকে সামনে রেখে প্রত্যেকে অসম্পূণর্ –অসহায়। এ ছাড়া অভিজ্ঞতার গনগনে আঁচে কখনো-কখনো 'মিথ্যাও সত্য হয়'। দেশ-কাল-পাত্রে ছাপ পড়ে তার নিশ্চিত। তেমন বিভীষিকার মুখব্যাদানে ঐতিহ্যের স্বরূপ, আর সভ্যতার অন্তরলোক বিকৃত হয় যদিও। আমাদের এই উপমহাদেশের দিকে তাকিয়ে কথাটা এখন আরো বেশি পীড়া দেয়। কেন, সেই দিকেই এবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
দুই
সবাই জানেন, এই ভূখন্ডের সভ্যতায় প্রাচীনতার গৌরব আছে। খৃষ্টপূর্ব প্রায় তিন হাজার বছর আগে পাঞ্জাবের হরপ্পায়, ও সিন্ধু প্রদেশের মহেন-জো-দারোতে, দ্রাবিড় সভ্যতা গড়ে ওঠে। এ বিষয়ে প্রথম অবহিত হই ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ প্রত্মতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহামের হরপ্পায় কিছু মৌল উপকরণের সন্ধান পাওয়ায়। পরে বিশ শতকের তৃতীয় দশকে ডি. আর. সাহানি ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হরপ্পা ও মহেনজো দারোয় নগরভিত্তিক দ্রাবিড় সভ্যতার প্রায় পূর্ণাঙ্গ যুগল নিদর্শন আবিষ্কার করেন। আরো যা চমকপ্রদ, তা হলো, দ্রাবিড়দের কৃষি কাজ জানা। তবে কৃষকদের বাস ছিল নগরের বাইরে। এ অনুমান জোর পায় যে সমাজে বর্ণ-বিভাজনের আদিরূপ ফুটে উঠতে থাকে এরই সূত্র ধরে। এখন অবশ্য হরপ্পা-মহেনজোদারোর সমান্তরালে উপমহাদেশে আরো অনুরূপ মানব-বিকাশের আলাদা আলাদা নিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিকদের নজরে পড়ছে। তবে তাদের একে -অন্যে সামাজিক বা বাণিজ্যিক কোন যোগসূত্র ছিল কিনা, তা নিশ্চিত জানা যায় না। সব মিলিয়ে এই দ্রাবিড় কীর্তি যে বহিরাগত আর্যদের সফল অধিকারের নমুনার পাশে ন্যূন ছিল না, নিরাসক্ত বিচারে এ কথা উপেক্ষা করা চলে না। একটু খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পড়ে আর্যদের কথা ও কাহিনির অনেক গৌরবেই আছে প্রাক-আর্য-অবদান। পৃথিবীতে কোন সভ্যতাই একক বিচ্ছিন্নতায় গড়ে ওঠেনি। তেমন কোন দাবি মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত অপমান। আবার, কোন ব্যবস্থাই কোন কালে সর্বার্থ সাধক হয়নি। পূর্ণাঙ্গা সিদ্ধিও অবাস্তব। মানুষের একাকিত্বে ও নশ্বরতায়, এবং মানব সমুদয়ের বিরতিহীন পথ চলায় অবিরাম দ্বান্দ্বিকতায় তার স্বরূপ অধরাই থেকে যায়। যদিও তার স্বপ্নসাদ মিলিয়ে যায় না।
মহাভারতের সূচনা পর্বেই যযাতি-শর্মিষ্ঠা-পুরু উপাখ্যান পড়ি। শর্মিষ্ঠা দৈত্যরাজ বৃষপর্বার কন্যা। রাজা যযাতির সঙ্গেঁ তার গোপনে বিয়ে। পুরু তাদের কনিষ্ঠ সন্তান। অভিশপ্ত যযাতির জরা তরুণ পুত্র পুরু নিজে গ্রহণ করে পিতাকে পাপমুক্ত করে। পরে পরিতুষ্ট যযাতি ওই জরা পূর্ণগ্রহণ করে পুরুকেই রাজাসিংহাসনে বসায়। তারই বংশে জন্ম রাজা দুষ্মন্তের। ঋষি বিশ্বামিত্রও অপ্সারা মেনকার কামজ কন্যা শকুন্তলা। গান্ধর্ব বিবাহে (পিতা বা কোন স্বীকৃত অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে কন্যা স্বেচ্ছায় কাউকে পতিত্বে বরণ করে স্বয়ংসিদ্ধা হলে) শকুন্তলা দুষ্মন্তের স্ত্রী হন। তাঁদের সন্তান ভরত। এই ভরতের নামানুসারেই ভারত বা ভারতবর্ষ স্থলভাগের পরিচয়।
কিছু পরে আসি মহাভারতের কেন্দ্রভূমির গোড়ায়। সূত্রপাত ধীবর কন্যা সত্যবতী কথা দিয়ে। পৌরাণিক খোলস সরিয়ে উঁকি দিলেই ধরা পড়ে, তাঁর মা জেলেনি, যে কন্যা জন্ম দেবার সময় মারা যায়। বাবার পরিচয় রহস্যাবৃত। এই কন্যাই রাজা শান্তনুর স্ত্রী হয়ে মহাভারত কথার নিয়ামকে পরিণত হন। তাঁর প্রাক্ -বিবাহ পুত্র বেদব্যাস ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু উভয়েরই প্রকৃত পিতা। আকারে-প্রকারে ব্যাস, বা, তাঁর বাবা, মনি পরাশর, কাউকেই আর্য বংশীয় মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ নেই শ্রীকৃষ্ণ বা দ্রৌপদীকেও শুদ্ধ আর্য মনে করার। আসলে মহা ভারতের বিপুল বিস্তারের তলদেশে আমরা দেখি বিবিধ মানব-মানবীর অবিরাম-অসংকোচ মিশ্রণ লীলা। প্রাণের সঞ্চার ঘটে তাতে এভাবেও। তা নির্বিকার ও উদার।
তবে কী ধর্ম আর কী ধর্ম না, এ প্রশ্নে আমরা সচকিত হই গোটা মহাভারতেই। এবং ধর্ম যেখানে অনায়ত্ত, সেখানেও দেখি পথের অন্বেষণ। আগের ওই ধর্মবকের কাহিনীতেই পড়ি, পথ কী -এ প্রশ্নের জবাবে যুধিষ্ঠির বলছেন, বেদ -শ্রুতি বিভিন্ন, মুনি ঋষিদের এমন দেখা মেলে না, যেখানে তাঁরা একমত। ধর্মের তত্ত্ব গুহায় নিহিত। অতএব সব মানুষ যেদিকে যায়, সেইটিই পথ। রবীন্দ্রনাথ এমনটিকেই বলেছেন, 'মহামানবের সাগরতীরে।' এতে, জাত-পাত, বর্ণ-সম্প্রদায়, সবই তাৎপযর্ হারায়। চাই, 'সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীর । কিন্তু ধর্মেও গ্লানি জমে। জমে নিরাসক্ত সমদৃষ্টিতে। তাতে ডুবে যাওয়া নয়,নির্ভয়ে তার প্রতিকারে এগিয়ে আসাই সেখানে সততার সঙ্গেঁ দায়িত্ব পালন। নিজের চার পাশে বেড়া তুলে অশুচিতাকে দূরে ঠেলার অসহিষ্ণুতাই হলো ধর্মের সবচেয়ে বড় অপমান। অপমান মনুষ্যত্বেরও। নামহীন অস্তিত্ব থেকে একটু একটু করে হয়ে ওঠার হাজার হাজার বছরের প্রক্রিয়ায় এই বোধ অভিজ্ঞতার দীর্ঘ পরিক্রমায় চুঁয়ে চুঁয়ে তাতে মেশে। অবচেতনের অবতল থেকে চৈতন্যের ওপর তলেও। ঐতিহ্য পুষ্টি পায়। ব্যক্তির নশ্বরতাকে ছাপিয়ে মানব-প্রবহমানতায় তা প্রেরণা জোগায়।
এমন প্রেরণারাশিই মানব বাস্তবতাকে কাল থেকে কালান্তরে অর্থবহ করে চলে। এ শুধু যুক্তি-তর্ক-বিবেচনা নয়। ও সবে আপন আপন স্বার্থ হার-জিতের হিসাব-নিকাশও প্রবলভাবে মিশে থাকে। সবটুকু তার সামষ্টিক কল্যাণের সহযোগী নয়। যদিও সহযোগী যে কিছু থাকে না, তাও নয়। ব্যক্তির, সমষ্টিরও, স্বাভাবিক ভাবনা-চিন্তায়, ও কাজে প্রতি মুহুর্তে তাদের প্রতিফলন। এই সব নিয়ে যুগ-যুগ ধরে প্রাণের অভিযান। তারই ধারায় মানব যাত্রা। প্রেরণায় ও প্রবঞ্চনায় মিশে থাকে তার পথ। এখন পর্যন্ত তেমনই। এই ভূখন্ডেও।
প্রবঞ্চনার উৎসে ব্যক্তির বা দলের ইচ্ছাকৃত দুর্বৃত্তায়ন থাকতে পারে, না-ও পারে। কখনো কখনো হয়ত সদিচ্ছার মোড়কে বৃহৎ ভ্রান্তি বাসা বাঁধে। অথবা এমনও হয়, অভিসন্ধিহীন ব্যক্তি-বাসনার অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে সমষ্টি জীবনে নরকের উৎপাত নেমে আসে। তবে তাদের সম্ভাবনা ভেতরে ভেতরে গজায়। প্রাত্যহিক জীবন যাপনে হয়ত অলক্ষে থেকে যায়। 'মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ' 'নিপুণহাতে' পাতা থাকতে পারে। যুগ-যুগান্তের অলীক ভাবনার উদ্দাম কল্পনা হয়ত তাকে প্রশ্রয় দেয়। পরিণাম কিন্তু হতে পারে সর্বগ্রাসী বিপুল সর্বনাশ। সত্য কথা, দিকচিহ্নহীন অতীত থেকে মানব প্রাণের সমন্বিত অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে তাকে বার বার পথের কাঁটা মাড়িয়ে একটু-একটু করে সামনের দিকে অতিম্লান থেকে ঝাপসা আলোর পর্ব-পরম্পরা পেরিয়ে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর উজ্জ্বলতায় নিয়ে চলেছে। কিন্তু কখনোই তা নিদ্বান্দ্বিক নয়। দ্বন্দ্ব নিজের সঙ্গেও। পরাজয়ের ভাগ্যলিপিও মেনে নিতে হয় বার-বার। যদিও প্রত্যক্ষের মায়ায় কখনো-কখনো পরাজয়কেই মনে হয় বিজয়। তার উৎকট হুংকারে মানুষের অপমানে নির্মমতার যন্ত্রণা চাপা পড়ে যায়। এমনকি অবশ্যম্ভাবী নয়। কিন্তু ভ্রান্তির সম্মোহন বা উত্তেজনা প্রতারণা ছড়ায়। মানুষ কখনো -কখনো তাতেই মজে। অলীক অহংকারে মনুষ্যত্বের বিপর্যস্ত শ্রেয়বোধ প্রাসংগিকতা হারায়। তারপরেও অবশ্য মানব যাত্রা থেমে নেই। তা সামনের দিকেই এগোয়। ক্ষত ও ক্ষতির লাঞ্ছনার দাগ গভীরে থেকে যায় যদিও। এবং ভ্রান্তির রাজত্ব স্থায়ী হতে পারে অতি দীর্ঘকাল।
আমাদের এই ভূখণ্ডের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো মনে হয় আজ অতি প্রাসঙ্গিকে। কণায়-কণায় মিশে অবিরাম সচলতায় যে ঐতিহ্য এখানে প্রত্যক্ষের ভাবনা-চিন্তায় ক্রিয়াশীল, তাতে মানব অস্তিত্বের, অখণ্ড আনন্দময় বিস্ময়ের ঘোষণায় আমরা তাকে সূচনা লগ্নের অবিমিশ্র আলোকে উদ্ভাসিত হতে দেখি। তারপরেই আসে মৌলিক সব প্রশ্ন: কী সৎ, কী অসৎ; কী ভ্রান্তির অন্ধকার, কী জ্যোতির্ময় পূর্ণতা-, কী নিয়তি-তাড়িত অনিবার্য অবসান, কীসে তা থেকে উজ্জ্বল উদ্ধার। অথবা, উদ্ধারও এক স্বপ্ন-কল্পনা। সব মিলে বড় হয়ে ওঠে, এই সীমা-অসীমের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতায় বহুমুখী অভিলাষ ও কৃতার্থতা-অকৃতার্থতার বিরামহীন সমাহারে কীভাবে, কী নিয়ে মানুষ বাঁচে-একা, এবং সবাই। কীভাবে মৃত্যু নির্বারিত জীবন অর্থবহ হয়– যদি হয়। এদের সামনে রেখে নিরন্তর যে অনুশীলন এবং সমাধানসূত্রের অন্বেষণ, তাকে এক কথায় বলা হয় 'ধর্ম।''ধর্মই' ধর্মের বাস্তবতার পূর্ণতা। কোন শর্তে বা প্রকৃতিতে তা বিভাজিত নয়। এইখানে তার ধ্রুপদী মাহাত্ম্য। অবশ্য এখনকার নয়, ওই কালচেতনার প্রেক্ষাপটে।
আমরা তাই দেখি, গোটা মহাভারতের মূল তাড়না, কী ধর্ম, আর কী ধর্ম নয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক-লগ্নে দুর্যাধন মা গান্ধারীর আশীর্বাদ কামনা করতে গেলে স্বাভাবিক পক্ষপাতিত্বে মা পুত্রের বিজয় কামনা করেননি। বলেছেন, ধর্ম যেখানে, জয় সেখানে (যথাধর্মস্তথা জয়)। তবে ধর্মেও গ্লানি জমে। তখন চাই তা থেকে উদ্ধারের সাধনা। (গীতায় শ্রীকৃষ্ণ) গৌতম বুদ্ধও ধর্মে শরণ নেবার বাণী উচ্চারণ করেছেন- (ধম্মং শরণং গচ্ছামি)যদিও কেউ তাকে অব্যয় -অক্রয় বা নিশ্চল বলেননি। স্থান ও কালে গতিশীল বাস্তবতায় ধর্মের প্রায়োগিক রূপও পালটায়। এবং জীবন-মৃত্যুর প্রবহমান ধারা তাতে একই রকম প্রাথমিক উদ্বেগ সঞ্চার করে। কিন্তু ওই ধ্রুপদী পর্বে 'ধর্ম' শব্দের কোন বিশেষণ ছিল না। মানব সমাজের সমস্তটা সামনে রেখে তার প্রয়োগ সিদ্ধির পথ খোঁজা। সবই যে তার সব সময়ে গ্রাহ্য, এমনটি নিশ্চয় দাবি করা যায় না। রামায়ণে 'উত্তর কাণ্ডে' রাম যে অন্তঃসত্ত্বা সীতাকে বর্জন করেন, এটা অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য হওয়া বিচিত্র নয়। উভয় সংকটের অন্য দিকে থাকে রামের রাজধর্ম পালন। প্রজাকুলের দাবি মেটাতে আত্মসুখ বিসর্জনের এ নিষ্ঠুরতম নিদর্শন। তা ছাড়া সীতার ব্যক্তিস্বরূপের উপেক্ষায় সার্বিক ন্যায়ও যে খণ্ডিত হয়, এ অভিযোগ এড়িয়ে যাবার নয়। তবু সব মিলিয়ে 'ধর্ম' তখন সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে চায়। নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে বরং পূর্ণ বাস্তবতার ন্যায়কেই আত্মস্থ করায় যত্নবান থাকার বিশ্বাসযোগ্য ধারণা ফুটিয়ে তোলায় অকুণ্ঠ উৎসাহ দেখায়।
কিন্তু আজ ওই প্রাচীন 'ধর্মের' দোহাই দিয়েই ক্ষমতার স্বার্থবাহী তৎপরতায় প্রকট হতে দেখি আত্মখন্ডনের পালা। একটু একটু করে ঐতিহ্যের আশ্রয়ে যার স্বতস্ফূর্ত প্রেরণা হতে পারত মানসমুক্তির ক্রমপ্রকাশমান চলমান অবলম্বন, তারই হাতে-পায়ে পরানো হয়েছে অলীক শৃংখল, এবং ওই শৃংখলকেই বৃহৎ আস্ফালনে বসানো হয়েছে পুজোর বেদিতে। তাকে ঘিরে চাক বেঁধেছে কায়েমি স্বার্থের অতি উৎসাহী মধুমক্ষিকার দল। অসহিষ্ণু হুল ফোটাবার আস্ফালনে সন্ত্রস্ত করে তারা মনুষ্যত্বের সুস্থ বিকাশের সরল উৎসাহকে। মুক্ত প্রাণের প্রেরণা বুঝি হারিয়ে যেতে বসে প্রবঞ্চনায়।
এদিকে এই উপদ্বীপে সভ্যতার ধারাবাহিক বিকাশে একটা বৈশিষ্ট্য–বার বার তার বাইরের অভিঘাতে অভিনবত্ব অঙ্গীকার করা। আদিবাসী ও দ্রাবিড় জনসমুদয়কে এখানে প্রাথমিক পর্ব থেকেই দেখি। সম্ভবত এখানে মানব বিকাশে নবীন-উষার আলো সবার আগে তাদের ওপরেই পড়ে। তারপর খৃষ্টপূর্ব প্রায় দুহাজার বছর থেকে শুরু মেসোপটেমিয়া-ও মধ্য-এশিয়ার স্টেপ-ভূমির যাযাবর আর্যদের নিরন্তর আগমন। আর সব যাযাবরদের মত তারাও কৃষি কাজ জানতো না। এবং সামাজিক স্তর বিভাজনও যাযাবর বৃত্তির সঙ্গে মানিয়ে চলা সম্ভব ছিল না। অনুমান, উচ্চতর স্থিতিশীল দ্রাবিড় জীবন-প্রণালী থেকে এগুলো তারা আত্মস্থ করে। তবে ঘোড়ায় চড়ে দ্রুতগতিতে ছোটায় ও যুদ্ধ চালনায় তারা অভ্যস্ত ছিল। এইটিই তাদের প্রভুত্ব বিস্তারে প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে। প্রথমে সিন্ধুনদ থেকে গঙ্গা-যমুনার মাঝখানের উর্রব জমিতে তারা থিতু হয়। পরে পুবে ও দক্ষিণেও ছড়ায়। সভ্যতার বিকাশে মিশ্র কলা নিঃশব্দে কাজ করে চলে। ধর্ম যথারীতি মানব সমুদয়ের ঐহিক ও পারত্রিক প্রশ্ন-মীমাংসার সমাধান খোঁজে। যদিও বহুবিধ মানুষের মিশ্রণে বহু মত গজায়। একে-অন্যে সহাবস্থান করে। কিন্তু 'ধর্ম' কোন বাড়তি অভিধায় নিজেকে সংকুচিত করে না। তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে অনতিক্রম্য বাধাও তোলে না। অবশ্য বিবিধ অঞ্চলে বিবিধ লোকাচার রাজত্ব করে পরস্পরে মিশ্রণ অনিবার্যভাবে ঘটে চলে। কখনো-কখনো সংঘাতও সমন্বয়ে পরিণতি পায়। এ সবই ন্যায় ও নৈতিকতার নির্দেশনায় 'ধর্ম' শব্দের একক মহিমা অক্ষুন্ন রেখে। যদিও জাত-পাত, বর্ণ-বিভাজন জায়গা করে আকার পেয়ে চলে তার ভেতরেই। এদের প্রভাব এখনও মানব-মহিমা ক্ষুণ্ন করে। তারপরেও এক শ্রেণীর নৃ-বিজ্ঞানী এমন বিভাজনের পক্ষে সাফাই গান এই বলে, যে, এর পরিণামে বহু বিচিত্র মানুষের অব্যাহত বিকাশের আদি রূপের বিশ্বাসযোগ্য নমুনা এখনও চিনে নেওয়া যায়। আর্যরক্তের শুদ্ধতার অবিকৃত দেখা মেলে। এই বক্তব্যের যথার্থতা কিন্তু খণ্ডন করেন প্রশান্ত মহলানবিশ পরিসংখ্যান বিদ্যার বৃহৎ-নমুনা-পদ্ধতির বিজ্ঞান সম্মত বিচারে। তিনি সুস্পষ্ট দেখান, এই উপমহাদেশে ব্রাহ্মণ ও চণ্ডালের মাথার খুলি পরিমাণযোগ্য লক্ষণসমূহের তুলনামূলক সংস্থাপনে কোন তাৎপর্যপূর্ন তফাত্ ধরা পড়েনা। এই ভূখণ্ডে আর্যেদের বাইরে থেকে এসে স্থায়ী বসতি গড়াই শেষ কথা নয়। তারপরে তরঙ্গের পর তরঙ্গে শক, হুন, মোংগল, পারসিকদের অভিযান বার বার চলেছে। জয়ী হয়ে দখলও প্রসারিত করেছে। তবে তাদেরও আগে ম্যাসিডোনিয়ার গ্রীক রাজকুমার আলেকজান্ডার ৩২৭ খৃষ্ট পূর্বাব্দে পারস্য পেরিয়ে এখানে পাঞ্জাব পর্ন্ত অগ্রসর হয়ে ফিরে যান। গ্রীকদের সঙ্গেঁ ভাবের আদান প্রদান শুরু হয় কিন্তু তখন থেকেই। বাণিজ্য সংযোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়। চীনের সঙ্গে যোগাযোগ ক 'শতাব্দী পরে। এই ধারাবাহিকতায় সবাই ফিরে যায়নি। যারা এখানে স্থায়ী নিবাস গড়েছে, 'গুণকর্ম বিভাগ' অনুযায়ী কালক্রমে তারা বর্ণ বিভাজনের কোন কোন খোপে খাপ খেয়ে মিশে গেছে। এবং তা অনেকটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। ৭১১ খৃষ্টাব্দে আরব সেনাপতি মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু দেশ জয় করেন। তুর্কি, আফগান, আরব, মোগল যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটে এভাবেই। পরে ৯৯৮-১০৩০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে গজনির তুর্কো-আফগান বংশীয় সুলতান মাহমুদ সাত বার অভিযানে আসেন। প্রতিবারই বিপুল ধনরত্ন লুন্ঠন করে ফিরে যান। এখানে রাজ্য প্রতিষ্ঠার কোন অভিলাস তাঁর ছিল না। দিল্লী দখল করে বাদশাহী ধারা চালু করেন প্রথম কুতুবুদ্দিন আইবেক ১২০৬ সালে। নানা-উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে পাঠান আধিপত্য চলে ১৫২৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১৫২৬-এ মোগল অভিযানে বাবর লোদি বংশের সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পানিপথের যুদ্ধে পরাস্ত করে দিল্লীতে স্থায়ী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত চলে কম-বেশি মোগল প্রতিপত্তি। ব্রিটিশ প্রভুত্বের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে। তুর্কো-মোগল-আফগান ধারায় যাঁরা এখানে এসে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলেন তাঁরা ও তাঁদের অনুসারীরা কিন্তু নিজেদের সামাজিক রীতি-নীতি বিসর্জন দেন না; যদিও বর্ণ-বিভাজনের মৌল ধারার সঙ্গে আপোষ রফা করেন। ধর্মান্তরণ প্রক্রিয়ায় স্থানীয়দেরও এক উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁদের সহগামী বলে গণ্য হন।
তবে এই উপমহাদেশে আদর্শগতভাবে 'ধর্ম' কোন যৌথ সমষ্টির নির্দেশক ছিল না। তা এক রকম, মানবিক ন্যায়-নীতিতে শ্রেয় ভাবনার ক্রমবিবর্তন। অনেকটা নদীর মত প্রবহমান। তাতে যোগ-বিয়োগ সচল ও স্বাভাবিক। এবং 'ধর্ম' বলতে শুধু 'ধর্ম'ই বোঝায়। মানুষ তার অনুসারী হতে পারে। কিন্তু তা কোন মানুষের পরিচয়ের নির্দেশক নয়।
তারপরেও 'হিন্দু ধর্ম' বলে এক শব্দ-বন্ধের আজ প্রবল দাপট। এর প্রায়োগিক সংগতি-অসংগতি কী করে বোঝাই? যে শব্দ স্বয়ং বহিরাগত, তা অন্তর্জাত আত্মজ্ঞানের অথবা ন্যায় ভাবনার পরিচায়ক হতে পারে কীভাবে? এমন কি হতে পারে, সবটাই ইতিহাসের নির্মম কৌতুক? অথবা উদ্দেশ্যমূলক হাত সাফাই? কাল বিচারে অনভ্যস্ত মানুষের কাছে তেমনটিই মনে হয় মৌলিক? এবং তেমন হলে অভ্রান্ত-নিত্যসত্য?
একটা বিষয় প্রথমে স্পষ্ট করি। এই ভূখণ্ডের সাধারণভাবে প্রচলিত নাম, ভারত বা ভারতবর্ষ, ইন্ডিয়া, আর, হিন্দুস্থান। আগেই দেখেছি, ভারত বা ভারতবর্ষ পরিচয়টি পৌরাণিক, তার ধারাবাহিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠে না, রাখা-না-রাখা অধিবাসীদের হাতে। তাতে তার কালের মাত্রা মিথ্যা হয়ে যায় না। ইন্ডিয়া বা হিন্দুস্থান বহিরাগত। অভ্যন্তরীন মানুষের ক্রিয়াকর্ম-নিরপেক্ষ। অবশ্য উভয়েরই উৎস এক। এই সমাপতন কৌতূহলোদ্দীপক। সিন্ধুনদের স্রোতপ্রবাহের সামনে পর্যন্ত এসে গ্রীক রাজকুমার আলেকজাণ্ডার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ ধরেন। দেশে ফেরার আগে পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অধিকৃত ভূভাগ প্রধান ক'জন সেনাপতি নিজেদের ভেতর ভাগ করে নেন। গান্ধার থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত এলাকার নায়ক হন সেলুকাস। পরে মগধের প্রথম মৌর্যরাজ চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে যুদ্ধে সেলুকাস বাহিনী হেরে গিয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হয়। উভয় অঞ্চলের ভেতর রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক আদান প্রদান বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখন, এই গ্রীকরা স-এর উচ্চারণ ঠিক ঠিক করতে না পেরে সিন্ধুকে বলতো 'ইন্দু' বা 'ইস্তু', এবং সিন্ধু পেরিয়ে ভূভাগটি 'ইন্ডিয়া'। গ্রীক পরিব্রাজক মোগস্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় সেলুকাসের দূত হয়ে আসে। তাঁর অভিজ্ঞতাভিত্তিক ভ্রমণগ্রন্থটির নাম 'ইস্তিকা'। এদিকে আরবদের সিন্ধু জয়ের কালেও উদ্ভব হয় একই রকম পরিস্থিতির। তারা সিন্ধুকে বলে 'হিন্দু'। সেই সূত্রে তা পেরিয়ে গোটা ভূভাগ 'হিন্দুস্থান'। অধিবাসীরা হিন্দে', 'হিন্দ্রি' বা 'হিন্দুস্থানী, এই অভ্যাস এখনও প্রবল।
তা হলে অষ্টম শতাব্দীর আগে 'হিন্দু' বলে কোন শব্দ ছিল না। যদিও গৌরবজনক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে বৈচিত্র ও ঐশ্বর্য ছিল। এবং আগেই দেখেছি 'ধর্মের' তৃষ্ণা ছিল, তার মুক্ত ও বহুমুখী বিকাশ ছিল। এদের কোনটির সঙ্গে তখনও অপরিচিত 'হিন্দু' বা 'হিন্দুত্ব' শব্দের বা ধারণার কোন পরিচয় থাকার কথা ভাবাটাও অকল্পনীয় ছিল। তা হলে পাঁচ হাজার বছরের (অতি উৎসাহী আতিশয্যে শত শত কোটি বছরের) হিন্দু সভ্যতা নিয়ে গগনবিদারী উল্লাস বা শূন্যে উল্লম্ফন কি এক স্ববিরোধের উৎকট জালে আটকা পড়ে যায় না? সত্য কথা, বহিরাগত শাসকেরা স্থানীয়দের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টিতে ওই শব্দের ব্যবধানকে একটা কৌশল হিসেবে নিয়েছিল। কিন্তু এতে কি অন্য একটা সমস্যাও তৈরি হয়নি? এই অঞ্চলেই যারা শাসক শক্তির অনুসারী হয়ে অথবা অধিকতর মানবিক আচরণের আশায় আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মান্তর গ্রহণ করে, তারা কি তবে মাঝখানে এক যাঁতাকলে পড়ে যায় না?
বিষয়টি ঔপনিবেশিক অনুমোদন পায়, যখন ১৮৭২ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজশক্তি দশকওয়ারি জনগণনা চালু করে; এবং তাদের ধারণা অনুযায়ী ধর্মের সীমা টেনে টেনে নাগরিকদের পারস্পরিক তফাতের বিষয়টি প্রকট করে তোলে। সাম্প্রদায়িকতার মনগড়া পালে জোর হাওয়া লাগে। বাস্তবের বাচ-বিচারে অসুস্থতার বিকার হানা দিতে শুরু করে। তবে যা আরো করুণ, তা হলো, য়োরোপীয় রেনেসাঁর অনুকরণে এখানেও প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শন সমূহের সঙ্গে পুনঃসংযোগে তাতে 'হিন্দু ধর্মের' ঐশ্বর্যের প্রমাণ পেয়ে অতি উল্লাসে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করা। অষ্টম শতকে আমদানি এক সংজ্ঞায় সেই সময়ের হালচাল মনে রেখে প্রাচীন কীর্তির জয়ধ্বজা ওই নামে ওড়ানো আর যাই হোক, যৌক্তিক নয়, শোভনও নয়। কিন্তু এই ভ্রান্তির উন্মাদনাই তার দখল ছড়ায়। ক্রিয়ায়- প্রতিক্রিয়ায় মিথ্যা অহংকার ও আত্মগরিমার অসহিষ্ণু প্রচার বিকারের যে উদ্গার তোলা শুরু করে, তার এখনও বিরাম নেই। মানবমুক্তির মাপকাঠিতে যতটুকু এগোতে পারি, পিছিয়ে যাই যেন তার চেয়ে বেশি। আরো যা উদ্বেগের, তা হলো, এতে কোন দুর্ভাবনা বা আত্মগ্লানি চোখে পড়ে না।
ইতিহাসে কালপর্ব-বিভাগে হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে প্রারম্ভিক অধ্যায় যে তত্ত্বগত ও বস্তুগত, দুভাবেই ভ্রান্ত, একথাটি কেন যে কেউ, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন না, এটা বুঝে উঠতে পারি না। কোন কায়েমি স্বার্থের মৌরুসি পাট্টা কি তাতে প্রশ্নের মুখে পড়ে? অপ্রস্তুত বোধ করি, যখন দেখি, স্বামী বিবেকানন্দর মত মহৎ মানুষ 'হিন্দু' ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে শিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগ দিয়ে তার বিজয়-কেতন ওড়ান। দেশবাসীও আত্মগরীমায় বেলুনের মত ফুলতে থাকে। আবেগের জোয়ারে ভাল-মন্দ বোধ ভেসে যায়। অথচ তাঁর আগে বিদ্যাসাগর বেদান্তকে ভ্রান্ত বলার সাহস দেখিয়েছেন। সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথও বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন। শেষে সমাধান বাতলেছেন এই ভূখন্ডের অধিবাসী হিসেবে সবার পরিচয় তারা 'হিন্দু' বা হিন্দুস্থানী। তারপর মত ও পথের বিচারে কেউ হিন্দু শৈব, হিন্দু শাক্ত, হিন্দু বৈষ্ণব,–একই রকম হিন্দু বৌদ্ধ, হিন্দু ব্রাহ্ম, হিন্দু পারশি, হিন্দু খৃষ্টান, হিন্দু মুসলমান, অথবা এইরকম আর সব সম্প্রদায়। রবীন্দ্রনাথের বিবেচনা জনসম্প্রদায়ের মত আবেগের সামনে হালে পানি পায়নি। কারো সাড়াই এতে মেলেনি।
তবে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের ভাবনা একভাবে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি। হয়ত তাঁরা একে অন্যকে প্রাণিত করেছেন। আচার্য সেন তাঁর বিখ্যাত 'হিন্দু ধর্ম' গ্রন্থের ভূমিকায় শুরুতেই জানাচ্ছেন, " … প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে ভারতের সমস্ত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সঙ্গীকরণ ও স্বীকরণের মধ্য দিয়ে ক্রমশ গড়ে উঠেছে এই ধর্ম। ফলত মতান্তরের মীমাংসার জন্য এর কোনও বাইবেল, কোরাণ কিংবা ধম্মপদ নেই। … এই বিচিত্র মতাদর্শের মধ্যে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই পার্থক্য আছে। এমনকি আজও তাদের তফাতগুলি কোনও দিক থেকেই তুচ্ছ নয়। …" (১৯৫৯)। এও দেখি, উত্তর ভারতের মধ্যযুগীয় মরমিয়া সাধনা এই পরিচ্ছেদে তিনি সশ্রদ্ধ একাগ্রতায় রামানন্দ, কবীর, নানক, দাদু-এঁদের অবদানে আলোকপাত করেছেন। পরে বাউল সাধনাকেও অঙ্গীভূত করেছেন। আজকের আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদীরা শুরুতেই এমন উদারমনস্কতাকে নাকচ করে দেবেন। তবে প্রতিক্রিয়ায় এটাও স্পষ্ট করা জরুরি, যে, সাম্প্রতকি হিন্দুত্ববাদ এক শিকড়হীন পরগাছা। বিনাশের সংক্রমণ ছড়ানো আর আজগুবির কারবার ছাড়া আর কিছুতে তার আগ্রহ ক্ষীণ। মানবিক মূল্যবোধহীন অসহিষ্ণুতার হুংকারে মর্যাদা কারো এতটুকু বাড়ে না। অনৈতিহাসিক উদ্ভট কথামালায় মজে যাবার মাদকতা অবশ্য থাকে। মানবিক দায়িত্ববোধ তা হরণ করে। মুক্ত মানুষের আলম্ব (Vertical) যোগাযোগ ও চলাচল কুসংস্কারের নিষেধে গতি হারায়।
এটাও আরো দেখি, 'আপনার নিরানন্দ অন্ধ কারাগার' চাড়িয়ে মুক্ত চিন্তারও–তার সঙ্গে বহুমুখী অনিশ্চয়তার সামনা সামনি হতে ভয় পেয়ে আজ নানারকম জাতি বা সম্প্রদায় -গোষ্ঠী একই রকম অসহিষ্ণু আক্রোশে কোটরের বিচ্ছিন্নতায় মুখ ডুবিয়ে বাইরের কর্মকান্ডের ওপর এলাপাথারি আঘাত হেনে চলেছে। এটাই যেন তাদের নিশ্চয়তার ও নিশ্চিন্ততার বিধিসিদ্ধ চাবিকাঠি। মানুষের দুর্দশা বাড়ে। কিন্তু মানব যাত্রা থেমে থাকে না। যুগ -যুগান্তের প্রবাহে শুভ ঐতিহ্যের ক্রমবর্ধমান প্রেরণা এই সব 'প্রতারণা' বা 'প্রবঞ্চনা'কে পরাস্ত করে। তারই ধারা আমাদের আশা জাগিয়ে রাখে। যদিও পিছুটানের মোহকে খাটো করে দেখার কোন কারণ নেই।
তবে শুরুতেই বলেছি, প্রতিটি মানুষের জীবনে মৃত্যু অনিবার্য। অনায়াসে বিশ্ব-প্রকৃতিতে অসংখ্য বন্ধনে 'ছলনা' সহ্য করতে পারা বা না -পারার ওপর তা নির্ভর করে না। মৃত্যুই যদি হয় 'পরম শান্তি, তবে তাতে অধিকার প্রত্যেকের ন্যায় অন্যায় বা ভাল মন্দর তায়াক্কা তাতে নেই। বাস্তবে সংকীর্ণ স্বার্থবাহী ইতর সংস্কার ও পারস্পরিক বিভেদের সঙ্গে অবিরাম লড়াই করে যাওয়াই এখানে শুদ্ধ মানব চৈতন্যের অনিঃশেষ বিধিলিপি। জীবনযাত্রায় আশার জায়গাও এইটিই। তা প্রত্যেকর, এবং সকলের। সফল সব জায়গায় সব সময় হই না। তবে এখন পর্যন্ত মানব যাত্রা সব মিলিয়ে সামনের দিকে। 'হিন্দুত্বে' কালের অসংগতি ও আত্মপ্রবঞ্চনা এই ভূখন্ডে তাই, আশা করতে ইচ্ছে করে, কোন অনপনেয় ক্ষতির গাদ ভবিষ্যতের কর্মপ্রবাহে সচল রাখতে পারবে না। মধ্য পর্বের সৃষ্টির গৌরব কারো অসাধু উপক্ষোয় ম্লান হবে না। সমন্বিত কল্যাণের আকাঙ্ক্ষাই দ্বন্দ্ব-সমন্বয় অঙ্গীকার করে সামনের দিকে এগাবার সাহস জুগিয়ে চলবে। তবে, আবার বলি, তা সমগ্র মানব -বাস্তবতায় একাত্ম হয়ে। মৃত্যু-লাঞ্ছিত জীবনে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় কালের যাত্রায় চূড়ান্ত বিচারে নিরর্থক। যদিও তাদের প্রত্যেকের কাল চিহ্নিত কর্মকান্ড আপেক্ষিক প্রাসঙ্গিকতা কিছু না কিছু রেখে যায়। এদিক থেকে আত্মপরিচয় সমগ্রে প্রসারিত করার দায়ও একটা মেনে নিতে হয়। তাতে 'হিন্দুত্ব' বা এই রকম আরো সংকীর্ণতার গন্ডি সব মানবিক বিবেচনাতেই মূল্য হারায়। তা সমষ্টির কাছে, সমষ্টির ধারায় মূল্য সংযোজনে আপন, দায়িত্বে সচেতন ব্যক্তির কাছেও। তবে ব্যক্তির আপন জীবনের সীমায় রচিত স্বার্থের কাছে নয়। মৃত্যু তাকে অনিবার্য হরণ করে।