বাজল নজরুলের গান। জনপ্রিয় হলো নিষিদ্ধ, অপর, ইতরের কন্ঠ। নিষিদ্ধ, অপর, ইতর দ্বার ভাঙল গান দিয়ে, অন্তর্ঘাত ঘটাল। গানে তাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ এল। ক্ষমতায়ন হলো, ইচ্ছেমতো বাঁচার অধিকার পেলেন হরিমতী, ইন্দুবালারা।
Published : 29 Aug 2023, 01:47 AM
নিম্নবর্গ নিজের কথা বলবে কী ভাবে? এ নিয়ে গত শতকে জ্ঞানপুরোহিতরা নানা মত উত্থাপন করেছেন। পশ্চিমী ধারণাগুলির বিপ্রতীপে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতামতটি উত্থাপন করেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। তিনি তুলে আনেন তাঁর দিদিমার বোন ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ির কাহিনি, ভুবনেশ্বরী আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে নিজের কণ্ঠস্বরটি রেখে গিয়েছিলেন। প্রান্তিকের অশ্রুত কণ্ঠস্বর, তা বহুস্রোতা, বহুশ্রুত হবে মৃত্যুতে- এই আখ্যানটির দিকে তাকিয়ে ভাবছি, আর কি কোনো পথ প্রান্তিকসমাজ, আরও বিশেষভাবে বললে উনিশ বা বিশ শতকের বাঙালি মেয়েরা খুঁজে পাননি, যাকে বিবৃতি হিসেবে পাশে রাখা যায়? ভাবছি, ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ির মতোই, বা তাঁর তুলনায়ও আর্থসামাজিক সুযোগসুবিধের নিরিখে ভাবে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের মধ্যে, উনিশ বা বিশ শতকের বারাঙ্গনাদের মধ্যে কোনো গল্প লুকিয়ে নেই কি, যা আদতে উলটপুরাণ, নিষেধ আর সংস্কারের দেওয়াল ধসিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার গল্প? চিন্তার পথে বেশ কয়েকজন বিশ শতকীয় গায়িকা এসে দাঁড়াচ্ছেন, আর দাঁড়াচ্ছেন একজন সাধারণ, এই গাইয়ে মেয়েদের শিক্ষক কাজী নজরুল ইসলাম। একে একে বলি সেই সব মেয়েদের কথা। তারপর গল্পের সুতোগুলি জোড়া যাবে না হয়।
বিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকার জিন্দবাহার লেনে বহু বাইজী থাকতেন। তাদের মধ্যে দেবী বাইজী ও হরিমতীর নামডাক ছিল সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র (নির্বাক) দ্য লাস্ট কিস-এ অভিনয় করেন দেবী-হরিমতী দুজনেই। হরিমতীর সম্পর্কে তথ্য বিশেষ নেই। আঁকিয়ে পরিতোষ সেন আত্মজীবনী জিন্দাবাহার-এ (প্যাপিরাস, পৃষ্ঠা ৯৭) তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘হরিমতী বাঈজীর ঘরটি আমাদের বারান্দা থেকে পরিষ্কারই দেখা যায়। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো ভৈরবী রাগে গান ধরেছেন, “রসিয়া তোরি আখিয়ারে জিয়া লালচায়’ ঠুংরি ঠাটের গানের এ কলিটির সুরের মাধুর্য্যে আমাদের জিন্দাবাহার গলিটি কানায় কানায় ভরে উঠেছে...আমাদের পাড়ার বারবনিতারা প্রতিদিন সকালে দল বেঁধে বুড়িগঙ্গায় স্নান করতে যায়।’ বুঝতে অসুবিধে হয় না হরিমতী কোন সমাজের প্রতিনিধি। এই হরিমতীই ত্রিশ দশক জুড়ে রেকর্ড করছেন নজরুল ইসলামের গান। জয় করছেন শ্রোতাচিত্ত। শুকনো পাতার নুপুর বাজে, আজি চৈতী হাওয়ার মাতন লাগে, কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল, ঝরা ফুল দল কে অতিথি-- এইচএমভি থেকে প্রকাশিত অসংখ্য গান চিরায়ত হয়েছে তাঁর কণ্ঠে ভর করে। নজরুল রচিত ইসলামী গান গাওয়ার জন্যে এই হরিমতীই সাকিনা বেগম নাম নিয়েছিলেন।
আসব কাননদেবীর কথায়। কিংবদন্তি অভিনেত্রী কাননবালা ছিলেন এক রক্ষিতার মেয়ে। সেকালে ভদ্রবিত্তের মেয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় করবে/ সিনেমায় 'নামবে' ভাবাও যেত না। পেটের টানে অকুলীন কাননবালা সেই জুতোতেই পা গলালেন। রক্ষিতা হওয়ার থেকে সিনেমায় অভিনয় করা তুলনামূলক সম্মানের, ভেবেছিলেন কাননের মা। হাওড়ার কাননবালা ভাগ্য অনুসন্ধানে আসেন টলিপাড়ায়। রক্ষিতার মেয়ের সম্মানের কথা সেদিন টালিগঞ্জ তেমন একটা ভাবেনি। সেকালের পরিচালকরা তাঁকে নগ্নাবস্থায় পর্দায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৩১ সালে রাধা ফিল্মস-এর জোরবরাত ছবিতে তাঁকে তাঁর অমতেই চুম্বন করা হয়। সাম্মানিকও অন্যদের তুলনায় কম পেতেন কানন। জায়গা করতে অনেক বেশি লড়তে হয়েছে তাকে। ঠেলতে হয়েছে অপমানের পাহাড়। নজরুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ভিয়েন কেমন? নিউ থিয়েটার্সের তত্ত্বাবধানে দেবকী বসুর পরিচালনায় 'বিদ্যাপতি' ছবিতে বিদ্যাপতির নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই ছবির চিত্রনাট্য গান নজরুল লিখেছিলেন। সাপুড়ে ছবির জন্য সর্বমোট ছটি গান লিখবেন নজরুল। তাঁর মধ্যে আবার দু'টি গান কাননবালা। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, আখতারীবাই, পঙ্কজ মল্লিকদের কাছে যেমন গান শিখেছেন কানন, তেমনই নজরুলের গানের তালিম নিয়েছেন তিনি নজরুলের কাছেই। গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানিতে নজরুল শিক্ষক পদে নিযুক্ত থাকার সময়ে কাননবালার ছটি গান রেকর্ড হয়েছে। পরে নজরুল নিজে যখন গানের সত্ত্ব সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমার কারণে গ্রামাফোন কোম্পানি ছাড়লেন, বহু নজরুল অনুরাগীই সেই সংস্রব ত্যাগ করে। এই পর্বেই নজরুলের 'লক্ষ্মী মা তুই ওঠ গো' গান দিয়ে পথচলা শুরু হলো মেগাফোনের। মেগাফোনের পাঁচ নম্বর রেকর্ডটাই ছিল কাননের। দীর্ঘকাল মেগাফোনের সঙ্গে কাননের যোগাযোগ ছিল, এই যোগাযোগের গোড়াপত্তন হয়েছিল নজরুলের হাত ধরেই।
হরিমতী বা কাননবালার মতোই ডাকসাইটে নজরুলগীতি গাইয়ে ছিলেন ইন্দুবালা দেবী। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে অমৃতসর শহরে তাঁর জন্ম। ইন্দুবালার মা রাজাবালা কাজ করতেন মতিলাল বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে। সেখানেই প্রণয় রাজবালা-মতিলালের। বিবাহও হয় দুজনের। কিন্তু ইন্দুবালার জন্মের পরেই সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ইন্দুবালার ঠাঁই হয় রামবাগান লেনের নিষিদ্ধ পল্লিতে। সেখানে ইন্দুর মা রাজবালা রাগসঙ্গীতের তালিম নেন। ইন্দুবালা বড় হন সুরের সাগরে ভাসতে ভাসতে। এই ইন্দুবালাকে প্রবল বাৎসল্যের সঙ্গে একের পর এক গান শিখিয়েছেন, রেকর্ড করিয়েছেন নজরুল ইসলাম। অঞ্জলি লহ মোর গানটি তাঁর কণ্ঠেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।
নজরুলের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ইন্দুবালা লিখছেন, "...হাসতে হাসতে বললেন, আয় ইন্দু বোস। তারপর আমি তাঁর পাশটিতে বসতেই বললেন, 'আচ্ছা তোর ওই অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে-এর উল্টো পিঠে গানটা কী লিখি বল্ তো?' আমি চট করে জবাব দিলাম না। কাজীদা মহান কবি, শ্রেষ্ঠ গীতিকার। তাঁর এ কথার জবাব দিতে যাওয়া আমার মত মানুষের পক্ষে মুর্খামি ছাড়া আর কি?
তাই একটুখানি চুপ করে থেকে শুধু বললাম, 'কাজীদা, ওই গানটার সঙ্গে ওই নতুন গানটাও যেন খুব ভালো হয়।'
কাজীদা আবার হা হা করে সারা ঘর হাসিতে ভরিয়ে তুলে বললেন, 'আচ্ছা দাঁড়া, চুপটি করে বোস্।' বলে এক মুখ পান ঠেসে খসখস করে কাগজে লিখে দিলেন সেই আমার গাওয়া বিখ্যাত গানটি- 'দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে।'" (তথ্যসূত্র- বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত নজরুল স্মৃতি, সাহিত্যম)
সব মিলিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ইন্দুবালা পঞ্চাশ বছর কাজ করেছেন। এইচএমভি থেকে অজস্র গান রেকর্ড করেছেন। আজীবন রামবাগানেই থেকেছেন।
ভদ্রবিত্ত সমাজের চোখে যে স্থান পরিত্যজ্য, সেখানকার বাসিন্দা না হলেও, হাওড়ার আমতা থেকে কলকাতা বেতারে গাইতে এসেছিলেন যূথিকা রায়। ১৯৩৪ সালে যূথিকার প্রথম গ্রামাফোন রেকর্ড নজরুলের তত্ত্বাবধানে। ওরে নীল যমুনার জল- সহ বহু নজরুল গীতি যূথিকার কণ্ঠে ফুল হয়ে ফুটেছে।
আপাতত এই লেখায় আখ্যান আর বুনতে চাই না। শুধু তথ্যের খাতিরে বলা, হরিমতী, কাননবালা, ইন্দুবালা, যূথিকাদের মতোই নজরুলের গানে মজেছেন কমলা ঝরিয়া, ফিরোজা বেগমরা। গানের খাতিরে, ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে বাঁচতে, গানকে আরও জনপ্রিয় করতে নিজেদের নাম বদলেছেন।
এখন যে কথা বলার, দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এই মেয়েরা রবিবাবুর গান তেমন গাননি। বিশ শতকের প্রথম চার দশক রবীন্দ্রনাথের গান জনপরিসরে তেমন চালু ছিল না। রেডিওর মধ্যে দিয়ে সেই গান ঘরে ঘরে প্রচারিত হচ্ছে, এমন হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান সংরক্ষণ করার তাগিদে প্রতিষ্ঠান গড়বেন। শান্তিদেব ঘোষ, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরদের গুরুদায়িত্ব দেবেন। সেই প্রতিষ্ঠানে গানের দীক্ষা নিতে আসবেন সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়রা। রবীন্দ্রনাথের গান ক্রমে প্রচারিত হবে দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্রদের সৌজন্যে, অনেকটা পরে। আর একজন তথাকথিত ভুঁইফোড়, পারিবারিক সাংস্কৃতিক পুঁজি-শূন্য প্রতিভা নজরুলের গান? তিরিশের দশকেই সে গান গাইবেন তাঁরা, যাঁরা তথাকথিত ভদ্রসমাজের অন্তর্ভুক্ত নন। যারা বেশ্যাপাড়ার বাসিন্দা, সিনেমার অভিনেত্রী, বাইজী। বিশ শতকীয় ভদ্রসমাজ তাদের ড্রয়িংরুমে ঢুকতে দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তাদের সঙ্গে একাসনে বসতে রাজি ছিল না। কিন্তু নিঃশব্দেই বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিলেন নজরুল। যে বাবুটি তার মেয়েকে সিনেমায় নামতে দিতে চান না, নাটকে অংশ নিতে দিতে চায় না, যে বাবুটি ওপাড়া পেরোন মুখ ঘুরিয়ে, তার বাড়িতেই ঢুকল রেডিও। বাজল নজরুলের গান। জনপ্রিয় হলো নিষিদ্ধ, অপর, ইতরের কন্ঠ। নিষিদ্ধ, অপর, ইতর দ্বার ভাঙল গান দিয়ে, অন্তর্ঘাত ঘটাল। গানে তাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ এল। ক্ষমতায়ন হলো, ইচ্ছেমতো বাঁচার অধিকার পেলেন হরিমতী, ইন্দুবালারা। আত্মহত্যায় নয়, নীরবতায় নয়, ভদ্রবিত্ত তাঁদের সসম্ভ্রমে দেখতে শুনতে বাধ্য হলো দক্ষতার কারণে। তাঁদের হয়ে কথা বললো সুর-স্বরের মুনশিয়ানা। অপরের বিবৃতি হয়ে রইল গান। আর স্রষ্টা হিসেবে, শিল্পী নির্বাচন ও তাঁকে তালিম দেওয়ায় এবং তৈরি হওয়া গান কন্ঠ মারফত নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়ে একটি সামাজিক উলটপুরাণ রচনা করলেন নজরুল ইসলাম। সঙ্গীত সংস্কৃতির মূলধারার যে বহতা নদী তার চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়াল নিম্নবর্গের প্রতিনিধি। নেপথ্যে রইলেন নজরুল ইসলাম।
নজরুলের প্রয়াণের ৪৭ বছর পর তাঁর এই অনন্য কৃতিত্বের কথা গলা তুলে বলা হোক।