Published : 01 Sep 2024, 10:55 PM
অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন–'আমি কেবল থিয়েটারেই বেঁচে ছিলাম।' গ্রিক নাট্যকার ইস্কিলাস-ইউরিপিদেস-সফোক্লিস থেকে শুরু করে মহামতি শেক্সপিয়র, বার্নাড শ, আন্তন চেখভ, ক্রিস্টোফার মার্লো এমনকি আমাদের সেলিম আল দীন, গিরিশ কারনাড--এঁরা সবাই থিয়েটারেই বেঁচে ছিলেন, থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এঁদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে দু'ছত্র করে লিখলেও হাজার পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে। তলিয়ে দেখবার মতো বিষয়টি হলো–পুরাণসমৃদ্ধ দেশ বা জনপদের নাট্যকলা বরাবরই শক্তপোক্ত হয়।
'হয়বদন'। আক্ষরিক অর্থে দাঁড়ায় ঘোড়ার মুখ৷ বিশ শতকের শেষভাগে কন্নড় ভাষায় লেখা একটি নাটক। রচয়িতা গিরিশ কারনাড (১৯৩৮-২০১৯)। নাটকের প্লটটি প্রাচীন ভারতের মহাকাব্য বৃহৎকথা (দ্য গ্রেট ন্যারেটিভ) এবং জার্মান ঔপন্যাসিক টমাস মানের ট্রান্সপোজড হেডসের(মস্তক বিনিময়) রিটেলিংয়ের উপর ভিত্তি করে।
যারা বইয়ের খবরাখবর রাখেন, বই নিয়ে টুকটাক নাড়াচাড়া করেন; তাদের কাছে ট্রান্সপোজড হেডস এবং বৃহৎকথার বিষয়বস্তু নিয়ে নূতন করে বলবার কিছু নেই। আর আজ যেহেতু 'হয়বদন' নাটকটি নিয়ে কথা বলতে চলেছি তাই অন্য দুটো গ্রন্থ নিয়ে কথা বাড়াব না। 'হয়বদন' আত্মানুসন্ধানের এক গল্প। এই নাটক আমাদের শেখাবে কে চালায় মানুষকে? মাথা না শরীর!
নাটকটির প্রথম অঙ্কে মানুষকে দেহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 'হয়বদন' ঘোড়ার মাথাওয়ালা একজন মানুষ যে কি না পরিপূর্ণ মানুষরূপে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। স্বর্গের অপ্সরার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও 'হয়বদন' নিজেকে ঘেন্না করে। কারণ তার কোনো পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নেই, আজকের পৃথিবীতে যা সবচে' প্রাসঙ্গিক। কারনাড নাটকটির একটি খণ্ডিত অংশের ভেতর দিয়ে অপূর্ণ মোটিফের মাধ্যমে অস্তিত্ব অনুসন্ধান করেছেন। শূন্য থেকে তাকালে হয়বদনকে মনে হয় অসম্পূর্ণতার প্রতিমূর্তি। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কথক তাকে চিত্রকূট পাহাড়ে গিয়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে বলেন।
দ্বিতীয় অঙ্কে দেখা যায়—ধর্মপুরের দুই তরুণ বন্ধু দেবদত্ত ও কপিলকে, বিদ্যা-বুদ্ধি এবং শারীরিক সৌষ্ঠবের জন্য তাদের বেশ সুনাম রয়েছে। তারা পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু পদ্মিনী নামের এক সুন্দরী নারীকে কেন্দ্র করে দুজনের মধ্যে শুরু হয় টানাপোড়েন।
দেবদত্ত শিক্ষিত ব্রাহ্মণ—কবিতা লেখে, পেশিবল নেই বললেই চলে। কপিল ক্ষত্রিয়। সুদর্শন, শক্তিশালী। তবে দেবদত্ত ও কপিল কেউই পূর্ণ পুরুষসত্তা নয়। কথকের মতে, দেবদত্তের মাথা (জ্ঞান) এবং কপিলের দেহ (শারীরিক শক্তি) অর্থাৎ জ্ঞান এবং শারীরিক শক্তির মাধ্যমেই একজন পূর্ণ পুরুষ সৃষ্টি হয়। আগেই বলেছি, দেবদত্ত কপিলকে ভালবাসে কিন্তু স্টেরিওটাইপ সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষে-পুরুষে বিয়ে সম্ভব নয়। তাই দেবদত্ত কপিলকে জানায়, সে পদ্মিনীকে বিয়ে করতে চায়। পদ্মিনীকে না পেলে কালী মন্দিরে গিয়ে নিজের শিরচ্ছেদ করবে বলেও প্রতিজ্ঞা করে সে।
কপিল পদ্মিনীর কাছে দেবদত্তের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। পদ্মিনী দেবদত্তকে বিয়ে করতে রাজি হয়। যদিও প্রথম পরিচয়ে সে কপিলের শক্তিমত্তায় আকৃষ্ট হয়েছিল। বিয়ের পর দেবদত্তের শারীরিক অক্ষমতা পদ্মিনীকে হতাশ করে। অন্যদিকে দেবদত্ত ও কপিল পরস্পরকে না পেয়ে মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকে। একপর্যায়ে দেবদত্ত কালী মন্দিরে গিয়ে নিজের শিরচ্ছেদ করে। এদিকে কপিল দেবদত্তকে খুঁজতে থাকে। কোথাও না পেয়ে কালী মন্দিরে এসে চোখের সামনে প্রিয় বন্ধুর দ্বিখণ্ডিত দেহ দেখে যারপরনাই মর্মাহত হয়। শোক সামলাতে না পেরে একই তলোয়ার দিয়ে সে নিজের শিরচ্ছেদ করে। শীঘ্রই পদ্মিনী সেখানে পৌঁছায়। দুই বন্ধুর দ্বন্দ্ব ও মৃত্যুর জন্য সে নিজেকে দায়ী মনে করে। দিশেহারা হয়ে মা কালীকে প্রকট হতে আহ্বান জানায়। সাড়া না পেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। এমন সময় মা কালী আবির্ভূত হন। তিনি পদ্মিনীকে দুই বন্ধুর নিজ নিজ দেহের সাথে মাথা প্রতিস্থাপন করতে বলেন এবং পুনরায় তাদের জীবন দান করেন। ঘটনার আকস্মিকতা কেটে গেলে দেখা যায়, পদ্মিনী দেবদত্তের দেহে কপিলের মাথা এবং কপিলের দেহে দেবদত্তের মাথা জুড়ে দিয়েছে। নূতন জীবন ফিরে পাওয়ার পর কপিল ও দেবদত্ত নিজেদের নিয়ে বিভ্রান্ত হয়। তারা দুজনেই পদ্মিনীকে দাবী করে।
নাটকের এপর্যায়ে কথক আমাদের উদ্ভূত সমস্যার সমাধান নিয়ে চিন্তা করতে বলেন। প্রসঙ্গত 'বিক্রম-বেতাল’ গল্পটি চলে আসে। রাজা বিক্রম বেতালকে বলেন, মাথা হল শরীরের কর্তা। এটি একজন ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দেয়। যদিও কথক দেবদত্ত, কপিল ও পদ্মিনীকে সমস্যা সমাধানের জন্য একজন সন্ন্যাসীর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। সন্ন্যাসী বলেন–দেবদত্তের মাথা জুড়ে দেয়া শরীরটিই পদ্মিনীর স্বামী। শরীর যে চিন্তার জন্য অপেক্ষা করে না, শুধু কাজ করে যায় সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাটকের এই অঙ্কে। এটাও স্পষ্ট হয় যে, শারীরিক সক্ষমতা এবং ইন্দ্রিয়সুখই স্থুল মানবসত্তার একমাত্র লক্ষ্য, যা পদ্মিনী চেয়েছিল। কপিল হতাশ হয়ে বনে চলে যায়।
সময় বয়ে চলে। এদিকে দেবদত্তের মাথা জুড়ে দেয়া শরীরটি ধীরে ধীরে শক্তি হারাতে শুরু করে। ফলস্বরূপ তাদের পারস্পরিক আগ্রহ কমতে থাকে। ইতোমধ্যে তারা একটি শিশুর জন্ম দেয়।
দেবদত্তকে কিছু না জানিয়ে একদিন পদ্মিনী কপিলের সাথে দেখা করতে যায়। শিশুপুত্রের প্রসঙ্গ টেনে কপিলকে বলে, তোমার দেহ থেকে জন্মেছে, তাই শিশুটি তোমার পুত্র। কপিল শিশুটিকে অস্বীকার করে। তবে বহুদিন বাদে দেখা হওয়ায় অনিচ্ছা ও আড়ষ্টতা থাকা সত্ত্বেও তারা পরস্পরের প্রতি এক ধরনের শারীরিক টান অনুভব করে। পদ্মিনীকে খুঁজতে খুঁজতে বনে চলে আসে দেবদত্ত। কপিলের সাথে তাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পায়। ঈর্ষান্বিত হয়ে সে কপিলকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানায়। এই যুদ্ধে দুজনেই নিহত হয়। পদ্মিনী ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে। শিশুপুত্রটিকে পাঁচ বছর পরে দেবদত্তের পিতার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সে কথককে অনুরোধ করে। অবশেষে সতীদাহের প্রতিজ্ঞা করে সেখান থেকে চলে যায়।
এই নাটকটির বেশিরভাগ তথ্য আমরা মঞ্চে উপবিষ্ট কথকের মাধ্যমে জানতে পারি। আরব্য রজনীর গল্পের ভেতরে গল্প বলার মতই হয়বদনের প্লট। সফোক্লিসের 'শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস' নাটকে কোরাসের মাধ্যমে ঠিক একইভাবে গল্পের মধ্যে গল্প শুনেছি আমরা। এই নাটকের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে, যখন চরিত্রগুলো স্থুলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, ঠিক তখনই 'হয়বদন' এসে অস্তিত্বসংকট থেকে উত্তরণের জন্য আত্মদর্শন কতটা জরুরী বুঝিয়ে দিয়েছে। সাধারণত পৌরাণিক কাহিনী, লোককাহিনী, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম ও মনোবিশ্লেষণে ঘোড়াকে শক্তি, ক্ষমতা, দম্ভ, আগ্রাসী মনোভাব ও অবাধ যৌনতার প্রকাশ হিসেবে দেখানো হয়। হয়বদনও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে হয়বদনের ঘোড়াকে পুরোপুরি অশ্বমেধের ঘোড়া বলা চলে না বরং এটি বিমূর্ত কোনো ধারণা; যা চতুর্ভুজ প্রাণীটির শারীরিক বাস্তবতার বাইরে গিয়ে অন্য কিছু প্রকাশ করে। হয়বদন নাটকটির সার্থকতা এখানেই।