Published : 16 Dec 2015, 11:40 AM
মাস দুয়েক হল, এখানে আছি। সেক্টর, এক, হরিণা, মনু, আগরতলা। লিখলাম তো, হরিণা, মনু, হবে কি মনু, হরিণা? দূর ছাই, এতদিনে মনেও পড়ে না। সে, অন্য জীবনের স্মৃতি। জুন, ১৯৭১। দুই দেশের সীমারেখা পার হয়ে, হাঁটছি খোয়া ওঠা দীর্ঘপথ, প্রায় দেবদূতের মত আর্বিভূত হলেন, চট্টগ্রামের প্রখ্যাত চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডাক্তার জাফর, আওয়ামী লীগের নেতা এবং পূর্ব-পরিচিত, একই দেব পাহাড়ে বসবাসের সূত্রে, জোর করেই তুলে নিলেন একটি ট্রাকে। যাহোক, দুশ্চিন্তায় ছিলাম, এবার শ্বাস ফেললাম। তার পিছে-পিছে এই সেক্টর হেড কোয়ার্টারে। ঘন বাশবাগানে ঘেরা, বাঁশ দিয়েই নির্মিত এই মুক্তি বাহিনীর হেড কোয়ার্টার, দৈর্ঘে ও আড়ে, বেশ প্রশস্ত। মেজর জিয়াউর রহমান, ন্যাস্ত হয়েছেন জেড ফোর্সের দায়িত্বে, এখানকার দায়িত্ব বর্তিয়েছে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের ওপর। যতদূর মনে পড়ে, তখনও তিনি ক্যাপ্টেন, মেজরের পদপ্রাপ্তি তার ঘটেনি। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন কাজ করছেন, সেখানে।
মনে হল, তুষ্টচিত্তেই আমাকে গ্রহণ করলেন তারা। নিজেদের মধ্যেই নিয়ে নিলেন। কিছু দায়িত্বও বর্তাল আমার ওপর। আমাকে বলা হল পলিটিক্যাল অফিসার, ১নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত। এবার, হেড কোয়ার্টারের কিছুটা বর্ণনামূলক পরিচিতি দেয়া যাক। কেন্দ্রভূমি, মূল ক্যান্টনমেন্ট, তবে বাইরে লাগোয়া ইয়ুথ ক্যাম্প। অদূরে, বাঁ পাশে ঘেরা, একটা আস্তানা, কয়েক জনের থাকার ব্যবস্থা। মূল ক্যান্টনমেন্টে আর্মি অফিসাররাই থাকেন, প্রধান প্রধান কর্মকান্ড চলে সেখানেই। একটা ঘর এবং দু'টো তাঁবু ফেলে, ব্যবস্থা করা হয়েছে, আর্মি অফিসারদের বসবাসের, খাওয়াদাওয়ার। ইয়ুথ ক্যাম্পে আস্তানা গাড়ে উৎসর্গিতপ্রাণ যুবকেরা, যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে এসেছে। এরা মূলত ছাত্র এবং কৃষক, কিছু কিছু শ্রমিকও আছে একই কাতারে। হ্যাঁ পাশের, অনেকটা মেসের মতো তৈরি করা ঘরটিতে আছেন, নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলের আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা ও কর্মী। তাদের বেশির ভাগ, মফস্বল থেকে এসেছেন। আমার জন্য ভেতরে নির্মিত হল খড়-ছন-বাঁশের একটি দোচালা। আমার খাওয়াদাওয়া আর্মি অফিসারদের সঙ্গেই, যেহেতু, আর্মি না হয়েও, তাদেরই সহকর্মী। ইয়ুথ ক্যাম্পে, যে সকল যুবক উপস্থিত, তাদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হয়, ভবিষ্যতের মুক্তিযোদ্ধা। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দু'বার, নির্বাচন বোর্ড বসে নিয়মিত। নির্বাচিতদের, অচিরেই, পাঠিয়ে দেওয়া হয়, অন্যত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার উদ্দেশ্যে। সপ্তাহ দু'য়েক যেতে না যেতেই, আবিষ্কার করলাম, আমিও ওই নির্বাচন বোর্ডের সদস্য মনোনীত হয়েছি। ভাগ্যকে সাধুবাদ জানিয়ে, হাজির হলাম কাজে। বলতেই হয়, উপভোগও করছিলাম। যা হোক, মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার সুযোগ তো ঘটল, আর কী চাই!
নিয়মিত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিই। অস্বীকার করব না যে, আত্মতৃপ্তি, কিছু পরিমাণে আত্মস্লাঘা যে অনুভব করি না, তা নয়। দেখতে দেখতে সপ্তাহ তিনেক কেটে গেল। একদিন, স্পষ্ট মনে আছে, দেখি টেবিলের সামনে উৎসাহী যুবকদের দীর্ঘ লাইন। এক একদল এগিয়ে আসছে, প্রাণপনে চোখে মুখে অব্যক্ত স্বরে বলতে চাইছে আমাকে বাদ দেবেন না দয়া করে, মরে যাবো। হঠাৎ মাথা উঁচু করে একটু সম্মুখে তাকিয়ে, আমি তো হতবাক। দেখি, একটি বহুচেনা মুখ, কচি বালকের। তাই কী, চোখ কচলিয়ে, ফের তাকালাম, না, ভুল হবার নয়, এ তো সে-ই, আমার পরিচিত চট্টগ্রাম মহসিন কলেজের প্রথম বর্ষ আই, এস, সির ছাত্র। যতদূর জানি, ঠিকই জানি, মা-বাবার, সবেধন নীল মনি, একমাত্র সন্তান, রাজীব। বহু সাধনার ধন। ঘোর না কাটতেই, সে এসে সটান দাঁড়াল টেবিল ঘেঁষে, মুখোমুখি। মুখে, দ্বিধাদ্বন্দ্বের ছাপা নেই। নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে নিয়ে বললাম, তুমি! নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই হতবাক আমি, অথচ তার কণ্ঠে কোনো জড়তা নেই, স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, স্যার, মুক্তিযুদ্ধে যাবে। তখনো ঘোর কাটেনি, ফের বললাম, তুমি! কিছুটা অপ্রয়োজনীয় জোর দিয়ে উত্তর দিল বালক, হ্যাঁ স্যার, মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাতে এসেছি।
তোমার মা-বাবা জানেন? না। উচ্চারণ অতি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু দৃঢ়। তোমার বন্ধু-বান্ধব শুভানুধায়ী? কেউ কেউ জানেন। তারা কী বললেন? বাঁধা দিয়েছেন। তবু, তুমি …!। শেষ হল না কথা। স্যার, আমি যাব। নইলে দেশে ফিরব না।
আমাদের কথপোকথন শুনে বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরাও কান খাড়া করেছেন ইতিমধ্যে। কী ব্যাপার! বালককে বললাম, আচ্ছা যাও। দেখা যাবে। সবাইকে বুঝিয়ে বললাম, বিস্তৃত বর্ণনা সহকারে। সবাই একমত, না, এ ছেলেকে নেয়া ঠিক হবে না। সে ফিরে গেল ইয়ুথ ক্যাম্পে। দিন যায়, সপ্তাহ যায়। খোঁজ নিলাম, না, সে কিছুতেই দেশে ফিরবে না। ঠিক করলাম মুক্তিবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে, চট্টগ্রামে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা যাক! না, সে বালক, রাজি নয়। তার এক কথা, মুক্তিযুদ্ধে যাব। একদিন শুনলাম, ছেলেটি জ্বরে ও রক্ত আমাশায় বেশ কয়েকদিন হল শয্যা নিয়েছে। কাউকে বলেওনি। অভিমানে হয়তো বা। ক্যাম্পের অপ্রতুল ব্যবস্থায় তার শরীরের কোনো পরিবর্তন হল না। পক্ষান্তরে আরও কাহিল হয়ে পড়ল সে, প্রায় জ্ঞানশূন্য। অগত্যা, পাঠানো হল আগরতলায়। সপ্তাহ খানেক পরে নিরাময় হয়ে ফিরল। খবর পেয়ে আমি ডেকে পাঠালাম। দেখি, তখনো শরীর ভীষণ নড়বড়ে, ঠিক মত হাঁটতেই পারছে না। অনুনয়ের সুরে বললাম, রাজীব, এবার বাড়ি যাও। উত্তর দিল, না। চোখে জল। ফর্সা মুখ রুদ্ধ অভিমানে লাল। অগত্যা হাল ছাড়তে বাধ্য হলাম। ভাবলাম, এভাবে, ওকে আর কষ্ট দেয়া অনুচিত।
পরের সপ্তাহেই ফের নির্বাচন বোর্ডের মুখোমুখি দাঁড়ল সে। আমি এবার নিজেকে সংযত রাখলাম, বহুকষ্টে। কোনো কথাই বললাম না। পক্ষান্তরে নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল খুব। অসহায় আমি অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলাম। একজন সদস্য বললেন, কী আর করা। স্যার, ওকে পাঠিয়েই দিই। ভাবখানা এমন যে, এখানে থাকলেও মারা পড়বে, ওখানে যদি বেঁচে যায়, তো বলতে হবে, ভাগ্যগুণে। অবশেষে, সিদ্ধান্ত হল, পাঠিয়ে দেয়ার। সর্বসম্পতিক্রমেই। আমি নিশ্চুপ। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে।
দেশ স্বাধীন হল, স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশে ফিরলাম, চট্টগ্রামে চাকরিতেও যোগ দিলাম। এযাত্রায়, চট্টগ্রামে ছিলাম, তিন চার মাস। ক্লাসও নিয়েছি। কিন্তু চোখে পড়ল না এই আকাঙ্ক্ষিত সেই মুখ, রাস্তাঘাটেও নয়। ওর মা-বাবার ঠিকানা জানা ছিল না যে খোঁজ নেব। বন্ধু-বান্ধবই বা কারা, কেউ এগিয়ে এসে বলেনি। অগত্যা ভেবে নিই… কী ভাবছিলাম, জানি না।