Published : 21 Apr 2015, 11:04 PM
আততায়ী পারফিউম
দৃষ্টিনন্দন ক্রিস্টাল বাহনে পর্যটন করা ফরাসি এজেন্টের
তরল পুষ্পের ঘ্রাণমুগ্ধ হয়ে
তুমি যখন তাকে তোমার সঙ্গী কর।
তুমি তার আপাত নিরীহ তরল রূপের প্রেক্ষাপটে
বিলম্বিত হন্তারকের ভূমিকা ধরতে পার না।
ফলে তুমিও এই আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হয়ে যাও।
তুমি জান না
পারফিউমের একটি বিনাশী ভূমিকা আছে।
পারফিউমের-এর একটি বিলম্বিত হন্তারকের ভূমিকা আছে।
ঘ্রাণইন্দ্রিয়ের যোগসাজসে
মস্তিষ্ককোষের বন্ধ দরোজা-জানালাগুলো
খুলে ফেলে একের পর এক অবলীলায়।
তারপর আস্তে আস্তে তার বিষক্রিয়া
রক্তের শিরা উপশিরা ধরে
সমগ্র দেহের রোমকূপে ছড়িযে যায়।
পারফিউমের উৎপাদন এবং মিশ্রণশৈলীর ভেতর
নাশকতার ষড়যন্ত্র আটঘাট বাঁধা আছে।
পারফিউমের উপাদানগুলো
পিয়ানোর সাদা দাঁতের মতো
তিনপর্বে থরেথরে সাজানো আছে
দেহ
মস্তিষ্ক
আত্মা।
আপাতদৃষ্টিতে টইটম্বুর
সুরের রসে ভরা মনে হলেও
স্রোতের নিচে লুকিয়ে আছে বিষকাঁটা।
বিলাসের নেশায় তুমি যখন
পিয়ানোর সেই অর্ধেক অন্ধকার অর্ধেক আলোর
সাদাকালো সিঁড়ি বেয়ে
তরতর করে উপরে কোথাও উঠে যাও।
আমি তোমার অপসৃয়মাণ ছায়া
অনুসরণ করতে না পেরে
একটি প্রগতিশীল মিছিল নিয়ে সেই আলো-আঁধারি সিঁড়ির নিচে
সিদ্ধান্তহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকি।
আর ভাবি
গণতন্ত্রের স্বপ্ন বাতিল করে দিয়ে
তোমার সঙ্গে আলো ঝলমল কনসার্টে
মজে যাব কি না?
স্বপ্ন দিয়ে তৈরি যে দেশ
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
বাগানকে ধাওয়া করলে
কিছুতেই তুমি ফুলের নাগাল পাবে না।
বাগান কোনো গুপ্তবিদ্যার অধীনস্ত বিষয় নয় যে
জাদুর কাঠি ছুঁয়ে দিলেই ফুল ফুটে উঠবে।
ফুলের দেখা পেতে হলে
বাগানশ্রমিকের শুশ্রূষায় ফুটেওঠা কুঁড়ির হাত ধরে
তোমাকে স্বপ্নের সাঁকো পার হতে হবে।
তারপর সবুজ তৃণভূমির ষড়জ থেকে
তুষারমৌলির নিখাদ শীর্ষে আরোহণ করে
প্রাগৈতিহাসিক পাথরের বুকে কান পেতে
শুনতে হবে অন্তর্নিহিত জলপ্রপাতের গোপন শব্দ
শানাইয়ের ঠাঁটকে পানপাত্র বানিয়ে
চাতকের মতো অফুরন্ত তৃষ্ণা নিয়ে
সেই সুপ্ত প্রস্রবণকে জাগিয়ে তুলে
নিয়ে যেতে হবে কুসুমের বিবশকায়।
তুমি যদি তাড়া কর
তবে তুমি কিছুতেই ফুলের নাগাল পাবে না।
যদি তুমি মায়ের মতো পরম মমতায় অপেক্ষা করতে পার
তবে তুমি ভ্রমরগুঞ্জের মতো মিহিন শব্দে ফুটেওঠা
ফুলের পাপড়ি মেলার শব্দ শুনতে পাবে।
যদি তুমি বাগানকে তাড়া করো, তবে
প্রজাপতি তোমার সঙ্গী হবে না
সঙ্গী হবে না পাখিরাও।
প্রজাপতি আর পাখির অনুসঙ্গ ছাড়া
কিছুতেই তুমি ফুল ফোটার বিরল দৃশ্যটি
দেখতে পাবে না।
গণতন্ত্রের ক্ষীয়মান যে ফুলটি
ঝরে যাওয়ার জন্য প্রহর গুনছে
তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে
আর জাগিযে তোলা যাবে না।
এই কথাটি নিশ্চিত জেনেও স্বপ্নাতুর জনতা
বধ্যভূমির ফসিলের উপর বীজতলা তৈরি করে
স্মৃতির বাগানে বারবার স্বপ্নের বীজ বোনে।
মিস হেরিটেজ
সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে
আমি তোমায় দেখতে আসিনি
সকলের মতো আমিও জানি
সূর্য অস্ত না যাওয়া
তোমার ছায়া গুটিয়ে নিয়েছ আগেই।
অনন্ত আকাশ জুড়ে তোমার
বর্ণিল ঘুড়ির উৎসব এখন নাটাইবন্দি
সুনীল সাগরে বিস্তারিত মায়াজল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে
হাতের কাঁকন বানিয়েছ।
দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি আর
সোনালি ফসল তোমার ওয়েডিং গাউনের ভেতর সীমাবদ্ধ।
গাংচিলের ডানায়
কিংবা ডলফিনের প্রশ্রয়ে
কিংবা রাজকীয় ঐরাবতে নয়
শুধুমাত্র হোমারের অন্ধ ভালোবাসায়
তোমার কাছে ছুটে এসেছি।
অনর্গল সুরের স্রষ্টা বেথোভেনের বধিরতা নিয়ে।
বিটলসের ইয়েলো সাবমেরিনে চেপে পাতাল ভ্রমণে
কিংবা
লন্ডন আইয়ের চক্রযানে আকাশ পর্যটনে।
আমার চোখ থাকে কালো কাপড়ে বাঁধা।
সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে
আমি তোমাকে দেখতে আসিনি
বাকিংহাম প্যালেসের বহূদূর বেষ্টনী ছুঁয়ে ছুঁয়ে
টাওয়ার ক্যাসেলের সংরক্ষিত কোহিনুরের উজ্জ্বল প্রভা এড়িয়ে
আমি শুধু অন্ধ, বধির, অধরা অনুভূতি নিয়ে
বুঝতে চেয়েছি এই শহরের কোথাও তুমি আছ
আমি এই শহরে অবস্থানের সকল সময়
তুমি আমাকে কুয়াশার মতো বেষ্টন করে আছ।
মিস মেলবোর্ন
মেলবোর্নের দীঘল সমুদ্র সৈকতে
রেস্তোরাঁর উঠানে একা বসে থাকি।
একটি হলুদ ঝুটি সাদা কাকাতুয়া
টিফিনের নিঃসঙ্গ টেবিলে বসে সঙ্গ দেয়
একচিলতে পিচঢালা পথ
ভাতঘুমে ডুবে থাকা চৈত্রের দুপুরের মতো সুনসান
বনের গভীরে ঝরনার চোখের জল শুকিয়ে গেছে
রানি ভিক্টোরিয়ার নৌবাহিনী সমস্ত এবোরিজিনদের তুলে নিয়ে গেছে
তুরস্ক সৈকতে যুদ্ধের ময়দানে।
আমি কেবল চারদিকে প্রিয়জনদের প্রতীক্ষার দীর্ঘশ্বাস খুঁজে পাই।
মৃত সৈনিকের নামাঙ্কিত বারটি স্মৃতিস্তম্ভ
ঢেউয়ের আঘাতে বারবার ভেঙে যায় আবার গড়ে ওঠে।
কিশোর বেলায় একটি কিশোরী জানালা দিয়ে
কাগজে মোড়ানো একঝাঁক বেল ফুল দিয়েছিল।
আমি তার মর্ম বুঝিনি।
আজ মধ্যপঞ্চাশে মেলবোর্নের নির্জন সমুদ্রসৈকতে
ভীষণ সদৃশ সাদা কাকাতুয়া দেখে
বেলফুলের কথা মনে এল।
মনে এল জানালার গরাদের ওপাশে একজোড়া সজল চোখ
রেস্তোরাঁর বারান্দায় কাগজে মোড়ানো ফিস অ্যান্ড চিপস খুলতেই
কৈশোরের সেই একঝাঁক বেলফুল সাদা কাকাতুয়া হয়ে উড়ে গেল
তারই একটি কাকাতুয়া নিঃসঙ্গ খাবার টেবিলে ফিরে এসে সঙ্গ দেয়
তার প্রতিটি পালকের ভেতর বেল ফুলের পাপড়ির পেলবতা
আমি যদি পাখিটিকে স্পর্শ করি
তবে কি সেই বেলফুলের মধ্যে লেগে থাকা যুগান্তরের উষ্ণতা খুঁজে পাব
যুদ্ধের স্মৃতিকাতর পাখিটি আমার খাবার টেগিবলে বসে কি কথা বলতে চায়?
সে কি যুদ্ধের বিপরীতে শান্তির কথা বলতে চায়
নাকি বলতে চায়, বেল ফুরের ভেতর প্রথম নিবেদন বুঝতে না পারার বেদনা
বিশ্বযুদ্ধের বেদনার চেয়েও গভীরতর।
ওরল্যান্দো
ভরা পূর্ণিমার রাতে হাস্নাহেনার শাখা
ফুলে ফুলে ভরে উঠলেই
বড়আপা বাড়ি আসত।
অথবা বড়আপা বাড়ি আসলেই
চাঁদ উঠত
ফুল ফুটত।
আজ আর এত বছর পর
শৈশবের এই অংকটার কার্যকারণ মনে নেই।
তবে সেই উৎসবের দৃশ্যটি
হীরার মতো আজও জ্বলজ্বল করে।
সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে মফস্বল শহরের
মুলিবেড়ার রান্না ঘরে মা ব্যস্ত
লাকড়ির চুলার লাল আলো মায়ের মুখে এসে পড়ছে
সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরে বাবা উঠানে পায়চারি করছেন
বড় মেয়ে আসার আনন্দে তার জামা আরও বেশি উজ্জ্বল মনে হয়।
জ্যোৎস্নার আলোয় বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে
বড়আপা দুলাভাই ছোটআপা বড়দা দলবেঁধে হাঁটছেন
পেছনে আমাদের ছোট একটি দল।
বড়দের কথার মাথামুণ্ডু না বুঝে
আমরা সব জোনাকির পিছনে ছুটাছুটি করি।
মাথাভরতি কোঁকড়ানো চুল নিয়ে মেজদা যখন
বার পোস্ট থেকে গোল দিয়ে ফিরত
তখন তাকে বিশ্বজয়ের নায়ক মনে হত।
সেই মেজদা যখন অনেকগুলো জোনাকিপোকা পকেটে ভরে ফিরে আসত
তখন রুপকথার মতো একটি মায়াবি পরিবেশ সৃষ্টি হত।
তার বিজয়ের আনন্দে
আমার আর ছোটভাইয়ের জামার বুক পকেট না থাকার কারণে
জোনাকিপোকা বন্দি করতে না পারার বেদনা অতিক্রম করে যেত।
আজ উনিশ বছর পর ওরল্যান্দো এসে পুরনো বন্ধুকে পেয়ে
মনে হল অনেক দিন পর বড়আপা বাড়ি এসেছে।
আমরা যখন অন্ধকার বিভুঁই গ্রাম থেকে সেতু পেরিয়ে
আলো ঝলমলে ডাউন টাউনের দিকে ছুটছিলাম
তখন মনে হচ্ছিল আমার শৈশবের পুরো পরিবারবর্গ
জোনাকিপোকা নিয়ে সমবেতভাবে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্রিজ শট
আইনশৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনীর একজন নিষ্ঠুর সদস্য
ফুটপাত থেকে একজন ছিন্নমুল নারীকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে
তার অসহায় চোখের দিক তাকাল
এবং তার নির্দোষ পারিবারিক গল্পের ভেতর জড়িয়ে গেল।
আর উদ্যত হাতে ঔপনিবেশিক ব্যাটন
প্রহারবিহীনভাবে ফ্রিজ হয়ে গেল।
এই স্থিরচিত্রটি ধারণ করতে গিয়ে
একজন ফ্রিল্যান্স ফটোজার্নালিস্টও সেই গল্পের সঙ্গে যুক্ত হল
শিশুকালে একজন ভীত সন্ত্রস্ত নারী
একজন প্রহার উদ্যত পুলিশ
একজন ফটোজার্নালিস্ট,
রাস্তা পার হতে চাওয়া একজন ভাস্করের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত হল।
আর আমি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতর বসে
পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে করতে
ভীষণ রাজনীতির ভেতর প্রবেশ করলাম।
উদ্বাস্তু
কেন যে বৃক্ষ হলাম না
এ জগতে বৃক্ষ ছাড়া সকলেই উদ্বাস্তু
নদীর ধারে থাকার কথা ছিল আমার
কথা ছিল ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থেকে পাখির ডাক শোনার
বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর।
কথা ছিল দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে থাকার।
প্রকৃতির পাঠশালা থেকে গ্রেফতার করে
আমাকে স্কুলের কারাগারে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছে
আমি কেন যে বৃক্ষ হলাম না
বৃক্ষ হলে আর কোনো দণ্ডই
আমার উপর কার্যকর হত না।
স্কুলের কারাগারে আমার প্রতিদিনের ইচ্ছের
ডালপালাগুলো কেবলই ছেটে দেওয়া হয়
কেবলই ছেটে দেওয়া হয়।
আমাকে আর বড় হতে দেওয়া হয় না
বামণ বানিয়ে রাখা হয়
আমার কেবল বয়স বাড়ে
দৈর্ঘ্য বাড়ে না
প্রস্থও বাড়ে না।
স্কুলে দীর্ঘ কারাবাসের পর পুনরায় গ্রেফতার করে
কর্মস্থলের কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
কেন যে বৃক্ষ হলাম না
বৃক্ষ হলে দাঁড়িয়ে থেকেই পাতা
আর শিকড়ের মাধ্যমে উপার্জন হত।