লন্ডন ও নিউ ইয়র্কের নর্দমার পানিতে পাওয়া গেছে পোলিওভাইরাস। একই ধরনের ভাইরাস জেরুজালেমেও শনাক্ত হয়েছে। নিউ ইয়র্কে পোলিও আক্রান্ত একজন পক্ষাঘাতগ্রস্তও হয়েছেন।
Published : 16 Aug 2022, 12:06 AM
হাতেগোণা দুএকটি দেশ ছাড়া বিশ্ব যখন পোলিও মুক্ত ঠিক সেই সময় যুক্তরাজ্যের লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক এমনকী জেরুজালেমেও নতুন করে পোলিওভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে।
ভয়ঙ্কর রোগ
পোলিও গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার বাবা-মাকে আতঙ্কিত করে রেখেছিল। সাধারণত পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুরা এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে শরীরে তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। যদিও কারো কারো বেলায় জ্বর ও বমি হয়।
আক্রান্ত প্রতি ২০০ জনের মধ্যে একজন আজীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে আবার ১০ শতাংশ এ রোগের কারণে মারা যায়।
পোলিওর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ নেই। তবে ১৯৫০ এর দশকে পোলিও টিকা আবিষ্কার হয়। ওই টিকা অত্যন্ত কার্যকর। টিকার মাধ্যমে পোলিও সম্পর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য। বিশ্বজুড়ে পোলিও টিকার ব্যাপক প্রচলনের ফলে এ রোগ বলতে গেলে নির্মূল হয়ে গেছে।
বিশ্বের এখন শুধু আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মারাত্মক সংক্রামক এ রোগটি রয়ে গেছে। কিন্তু এ বছর মালাউই ও মোজাম্বিকে পোলিও শনাক্ত হয়; ১৯৯০ এর দশকের পর যা প্রথম। আক্রান্তরা অন্য দেশে থেকে এ রোগে সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানা যায়।
ভিন্ন দুই ধরন:
পোলিওভাইরাসের দুইটি ধরন রয়েছে। একটি যেটি প্রকৃতিতে বিরাজমান ভাইরাস। অন্যটি বিরল ধরন। যেটি টিকা থেকে উদ্ভূত। নাম ‘ভ্যাকসিন- ডেরাইভড পোলিওভাইরাস (ভিডিপিভি)।
এই ধরনটি মুখে খাওয়ার পোলিও টিকা ওপিভি তে দুর্বল কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় থাকা পোলিওভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
পোলিওর ওই ধরনটি যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য কম টিকা গ্রহণ করেছে এমন বা টিকা গ্রহণ করেনি এমন মানুষের মধ্যে সঞ্চালনের সুযোগ পায় অথবা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যক্তির দেহে সেটি প্রবেশের সুযোগ পায় তখন ওই দুর্বল ভাইরাসটি এমন একটি আকার ধারণ করতে পারে যা অসুস্থতা এবং পক্ষাঘাত সৃষ্টি করতে সক্ষম।
দ্বিতীয় এ ধরনটিই লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে নর্দমার পানিতে শনাক্ত হয়েছে। নিউ ইয়র্ক রাজ্যে পোলিও আক্রান্ত হয়ে একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
জেনেটিক্যালি একই ধরনের ভাইরাস জেরুজালেমেও শনাক্ত হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এই তিন জায়গায় পোলিওভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে কী সম্পর্ক আছে তা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছেন বলে জানায়, ‘দ্য গ্লোবাল পোলিও এরাডিকেশন ইনিশিয়েটিভ’ (জিপিইআই)।
কারণ, ওই তিন নগরীতে টিকা থেকে উদ্ভূত পোলিওভাইরাসের ধরণ পাওয়ার খবর বলতে গেলে আগে কখনও শোনা যায়নি। কিন্তু বিরল হলেও অন্যান্য দেশে পোলিওভাইরাসের এই ধরনটি যে কোনো সময় শনাক্তের হুমকি আছে। যেমন: ২০২১ সালে নাইজেরিয়ায় ৪১৫ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।
মুখে খাওয়ার পোলিও টিকায় ভাইরাসটি দুর্বল কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় থাকে। ফলে কোনো শিশু টিকা খাওয়ার পর তার মুখে ভাইরাস কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত জীবন্ত অবস্থায় থাকে। এখন ওই শিশু যদি টিকা গ্রহণ করেনি এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যায় তখন তার থেকে পোলিওভাইরাস অন্যদের দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং তাদের শরীরে রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাস পুনরায় শক্তিশালী হয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
যদিও যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে এখন আর মুখে খাওয়ার পোলিও টিকা ব্যবহার করা হয় না, যেখানে জীবন্ত ভাইরাস থাকে। কিন্তু অনেক দেশেই পোলিও নির্মূলে এখনও মুখে সেবনের টিকাই ব্যবহৃত হয়। আর মানুষের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণের কারণে ভাইরাস যে কোনও জায়গায় ছড়াতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
কেন এখন?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনও প্রকৃতিতে থাকা পোলিওভাইরাস বা টিকা থেকে উদ্ভূত ভাইরাস উভয় বেলাতেই পোলিওর প্রাদুর্ভাব হওয়ার মূল কারণ কম টিকা গ্রহণ করা জনগোষ্ঠী।
কোভিড-১৯ মহামারীর আগে বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই জনগণের মধ্যে টিকা গ্রহণে অনীহা দেখা দিয়েছিল। মহামারী শুরু হওয়ার পর তার তাণ্ডবে অনেক দেশে টিকা দেওয়ার নিয়মিত কার্যক্রম ভয়ঙ্করভাবে বিঘ্নিত হয়েছে বলে জানায় জাতিসংঘ।
২০২০ সালে টিকা থেকে উদ্ভূত পোলিওভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ১,০৮১ জন রোগী শনাক্ত হয়। যা তার আগের বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
বিশ্বজুড়ে পোলিও টিকা কার্যক্রম আবার জোরেশোরে শুরু হয়েছে। তারপরও এ বছর এখন পর্যন্ত পোলিও আক্রান্ত হয়েছেন এমন ১৭৭ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে।
বর্জ্যজলে পোলিওভাইরাস শনাক্ত হওয়া নিশ্চিতভাবেই বাবা-মার জন্য সতর্কবার্তা। কারণ, এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এখনও রয়ে গেছে। তাই আপনার সন্তানকে টিকা দিন।