কালুলুতে যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোর। দিনের আলো একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। মোরগের কক ককক কক শব্দে মনে হয় ঘুম ভেঙ্গে গেল।
Published : 11 Jan 2022, 07:19 PM
এতগুলো বছর অস্ট্রেলিয়ায় আছি কোনদিন মোরগের ডাক শুনিনি। গতকাল এসেছি কালুলু নামের এই জায়গায়। এক জার্মান বংশদ্ভূত পরিবারের বাসায় পেয়িং গেস্ট হয়ে গত এক রাত ছিলাম। একটি বিশাল ফার্ম হাউজের ভেতর একতলা একটি বাসা। বাসার চারপাশে মাঠের পর মাঠ আবাদি জমি। বাসার ভেতরে প্রচুর শৌখিন জিনিস দিয়ে সাজানো। করিডোরের দেয়ালে অনেক পারিবারিক ছবি টানানো আছে।
ফার্ম হাউজের মালিক সুঠামদেহী ভদ্রলোক। বুঝলাম ফার্ম হাউজের বর্তমান মালিকের বাবা-মা এই ফার্ম হাউজটি শুরু করেছিলেন। বর্তমান মালিকের আবার চার ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। সবাই বোধহয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকে। সবারই নিজেদের ঘর সংসার আছে। দেয়ালে টানানো একটা সুন্দর পারিবারিক ছবির দিকে চোখ আটকে গেল। ছবিটি একটা স্টুডিওতে তোলা। জার্মান ভদ্রলোকের পুরো পরিবারের ছবি। ভদ্রলোকের বাবা-মা, ছেলে-পুত্রবধু, মেয়ে-জামাই ও নাতি-নাতনি রয়েছে ছবিতে। একটি সুন্দর হ্যাপি ফ্যামিলি।
একটু পরই আমরা বেরিয়ে পড়ব ‘দ্য গ্রেট আলপাইন রোড’-এর উদ্দেশ্যে। কালুলু আমাদের মেলবোর্নের বাসা থেকে ৩০০ - ৩৫০ কিলোমিটার দূরে একটি নির্জন গ্রাম। এটি দ্য গ্রেট আলপাইন রোডের যাত্রাপথে আমাদের প্রথম স্টেশন। গ্রেট আলপাইন রোড ট্রিপ যেমন সুন্দর তেমনি ভয়ংকর। পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে চলেছে। তবে মোটরসাইকেল আরোহীরা বেশ বেপরোয়া চালায় এই রাস্তায়। ভদ্রলোক পরামর্শ দিলেন আমরা যেন খুব সাবধানে গাড়ি চালাই। আর কালবিলম্ব না করে একেবারে গপগপ করে আমরা নাস্তা করে ফেললাম। আমার স্ত্রী শিলা কফি বানিয়ে নিয়ে এলো। বেশ সুগন্ধি ধরণের এক কাপ ধূমায়িত কফি। কফি খেয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়ির দিকে রাখতে গেলাম। ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী এগিয়ে এলেন বিদায় দিতে। বাসার বাইরে বেগুনি রঙের জাকারান্ডা-সহ নানা রঙের ফুল ফুটে রয়েছে। দেখে মনটা ভরে উঠল। আহা! পরম শান্তি।
২.
প্রথমে মনে করেছিলাম কালুলু থেকে বের হলেই হয়ত ‘দ্য গ্রেট আলপাইন রোড’-এর দেখা পাবো। কিন্তু তা হলো না। কালুলু থেকে দূরে নীল পাহাড়ের সারি দেখা গেলেও এখনও আমরা প্রায় সমতলেই চলছি। মাঝে মধ্যে একটু আধটু বোধহয় পাহাড়ের উপরের দিকে উঠতে হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি। কারণ বাতাসের চাপের তারতম্যের জন্য আমাদের কানে তালা লেগে যাচ্ছে। আমাদের যাত্রাপথে ব্রাথান, বায়ার্নসডেল, ওমিও নামের কয়েকটি ছোট ছিমছাম শহর পড়ল।
ব্রাথান শহরে একটি গুহা আছে শুনেছি। গুগোল বলছে, সেটি নাকি আপাতত বন্ধ আছে। তাই আর সেদিকে পা বাড়ালাম না। সুইফটস ক্রিক নামের একটি জায়গায় আমরা আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি নিলাম। এখানেই দুপুরের খাবার সেরে নিতে হলো। গাড়িতে তেল এখনও ভালই আছে। দেখলাম সাইনবোর্ডে লেখা যে ওমিও পরে তেল পেতে হলে ‘ব্রাইট’ বলে আরেকটি জায়গায় যেতে হবে। আমার তৈরি করা আইটিনারি বলছে যে, আমরা আজ ‘ডিনার প্লেইন’ বলে এক জায়গায় থাকব। ডিনার প্লেইনের পরবর্তি বড় শহর হলো ব্রাইট। সুইফটস ক্রিক থেকে গাড়ি একটু একটু করে পাহাড়ি রাস্তায় চলা শুরু করল। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ শিলা এখন। আমাদের বাম পাশে উঁচু পাহাড় আর ডানে গভীর গিরিখাদ। বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছি এখন। ওমিও থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার চলার পর আমরা ডিনার প্লেইন ভিলেজ নামক একটি জায়গায় চলে এলাম।
এখন ডিনার প্লেইন ও মাউন্ট হোথাম জায়গাটি স্কি করবার জন্য আদর্শ স্থান। প্রতি বছর শীতকালে এখানে প্রচুর তুষারপাত হয়। পুরো এলাকাটি শ্বেত-শুভ্র হয়ে ওঠে। এখানে স্কি করার জন্য বেশ অনেকগুলো ক্লাব, দোকান, ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, হোটেল রয়েছে। যদিও আমরা গরমকালে এসেছি, তবু চারপাশের আবহাওয়া ও পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে এই অঞ্চলের প্রধান জীবিকা হলো স্কি করার আয়োজন। লক্ষ্য করলাম এখানে অনেকগুলো কেবল কার স্টেশন রয়েছে। এই কেবল কার দিয়ে স্কি চালকদের স্কি শেষে পাহাড়ের খাদ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আনতে হয়। সাধারণ মানুষও হয়ত চাপতে পারে এসব কেবল কারে, শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।
৩.
আজ যখন লিখছি তখন আমাদের গাড়ি গ্রেট আলপাইন রোড ধরে এগিয়ে চলছে মাউন্ট বাফেলোর উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ব্রাইট শহরে এসে পড়লাম। চারদিকে পাহাড়ঘেরা একটি উপত্যকা। সত্যিই ছবির মতো সুন্দর একটি শহর। গাছে গাছে এখন নতুন পাতা। সবই সবুজ রঙের, কিন্তু এত বিচিত্র রকমের সবুজ যে তাক লেগে যাবে। কোনটি সবুজ গাঢ়, কোনটি হালকা সবুজ, কোনটি কচি কলাপাতা সবুজ আরও কত কী! বসন্তকালের দিকে ব্রাইট শহরটি আরও সুন্দর করে সেজে ওঠে। এখানকার কিছু গাছের পাতা সবুজ ছাড়া হলুদ, কমলা, গাঢ় বেগুনি রঙের দেখলাম। আর গাছে গাছে সদ্য ফোটা ফুল। স্বর্গীয় দৃশ্য। আর উপরে নীল রঙের আকাশ যেন ঢাকনার মতো বসানো আছে। আকাশের নীলের দিকে তাকালে অদ্ভুত সুন্দরের কাছে হার মেনে দৃষ্টি বারবার ফিরে ফিরে আসে।
এই লুক আউট থেকে বহু দূরের পাহাড়, নিচের সমতল ও ভয়ংকর গিরিখাদ দেখা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ দৃশ্যটি যেন নীল ও ছাই রঙের থিমে আঁকা। সেই সঙ্গে নীল রঙা আকাশের ক্যানভাস। আমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি সেই জায়গার পাহাড়ের গা লক্ষ লক্ষ বছরে প্রাকৃতিক আবহাওয়ার কারণে সারি সারি উপর থেকে নিচে খাঁজ কাটার মতো সৃষ্টি হয়েছে। দমবন্ধ করা সুন্দর দৃশ্য। এত বিশাল জার্নির ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এক নিমিষেই। এখানে আসার সময় কিছু ন্যাড়া রকমের গাছ দেখলাম। ওইসব গাছের শরীর ধবধবে সাদা এবং কোন পাতা নেই। প্রচণ্ড শীতে তুষারপাতের কারণে গাছের পাতা ঝরে গেছে মনে হয়। পূর্ণ নীল রঙা আকাশের ক্যানভাসে সেই গাছের অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে আকাশের বুকে কোন শিল্পীর নিপুণ তুলিতে আঁকা একটি পত্রশূন্য বৃক্ষের প্রতিচ্ছবি।
৪.
ডিনার প্লেইন থেকে আজ সকাল সকাল রওনা দিলাম। আজকের গন্তব্য ‘মাউন্ট বিউটি’। বাংলায় বলতে গেলে ‘সুন্দরী পাহাড়’। শিলা গাড়ি স্টিয়ারিং-এ রাস্তার উপর কড়া নজর রেখেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৩০ মিটার উপরে পাহাড়ের গায়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলেছে। রাস্তার স্পিড লিমিট যদিও প্রতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, কিন্তু রাস্তার বাঁক একেকটা ২৭০ থেকে ৩৩০ ডিগ্রি। খুব সাবধানে পার হতে হচ্ছে প্রতিটি বাঁক। রাস্তার পাশে বিশাল খাদ। খাদের ধারে কোন রেলিং নেই। ফলে একমুহূর্তের অসাবধানতায় ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতে পারে।
মজার ব্যাপার হলো গাড়ির জানালা খুলে দিলে নানা রকম পাখির কিচ কিচ, কুউ কুউ, ভ্রুম ভ্রুম, গঅ গঅ শব্দ কানে ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে ক্ষীণ স্বরে ঝর্ণার কুলকুল ও গাছের পাতার শর শর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওদিকে জানালা খুলে রাখার কারণে গাড়ির জানালায় বাতাসের ঝাপটায় ধাক ধাক ধা ধা ধা শব্দে মধ্যম লয়ে ঝুমুর তাল চলছে। মনে হচ্ছে তানপুরা, বাঁশি ও পারকাসনের সমন্বয়ে একটি সুরমূর্ছণা সম্বলিত পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ছুটে চলছি আমরা। তাই মনে মনে এই রাস্তার নাম দিলাম ‘সুরমূর্ছণা পথ’। ইংরেজিতে বললে ‘দ্য মিউজিক্যাল রোড’। পাহাড়ি এই রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ। দূরে খাদের অন্য দিকে নীলচে পাহাড়ের সারি আর আকাশে শুভ্র ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘমালার সঙ্গে নীল আকাশ। যার এক কথায় বর্ণনা দেবার ক্ষমতা আমার নেই।
এতক্ষণ সুরমূর্ছণা পথে ভৈরবী রাগের সঙ্গে তানপুরার স্নিগ্ধ স্বর বাজছিল। একটুপর শুনতে লাগলাম তীব্র শো শো শব্দ। ঝর্ণার কুল কুল শব্দ হারিয়ে গেছে। মনে হলো তানপুরার স্নিগ্ধ সুর থেকে এখন পারকাসন ও সেতারে মেঘমল্লারের ঝংকার! সত্যিই তাই। সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা ‘ফেইন্টার ফলস’। গাড়ি দাঁড় করালাম। দেখতেই হবে এই ঝর্ণা। কেন তার মেঘমল্লারের বাদ্য। ক্যামেরা হাতে ঝর্ণার অমোঘ টানে ছুটে চললাম। অনেক উঁচুতে পাহাড়ের গা বেয়ে একজন যাবার মতো পাহাড়ি পথ। পাশে বড় বড় গাছ। সূর্য কমই আলো বিলাতে পারছে এখানে। কারণ গাছের পাতার জন্য সূর্য ঢুকতে পারছে না। পথের দুধারে পাশে ফার্ন জাতীয় গাছ আর বড়বড় ঘাস। সেসব পেছনে ফেলে উপরে উঠে দেখলাম সত্যিই মূর্ছা যাবার মতো ঝর্ণা। দুটো ঝর্ণা দুইদিক দিয়ে এসে মিশেছে। তারপর বয়ে চলছে নিচে। পাথরের উপর দিয়ে পানি খরস্রোতে বয়ে চলছে। যে জায়গায় মিশেছে সেখানে সুরলহরী সৃষ্টি হয়েছে। আর খুব খেয়াল করলে, সেখানে সূর্যের আলোর কারণে বর্ণালি দেখা যাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ চলচ্চিত্র। অনেকটা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-এর মতো।
আবার পাহাড়ের উপর দিকে উঠে যাচ্ছি আঁকাবাঁকা সুরমূর্ছণার পথ ধরে। প্রায় ১৫ কিলোমিটার গিয়ে দেখি একটি ছোট্ট শহর। এখানে বড় বড় দালান রয়েছে। মনে হলো ওগুলো হোটেল। আগেই বলেছি অস্ট্রেলিয়ায় এখন ডিসেম্বর মাস মানে পুরো মাত্রায় গ্রীষ্মকাল। জুন-জুলাইয়ের দিকে যখন শীতকাল হবে তখন এই অঞ্চলে বরফ পড়ে। পুরো জায়গা শ্বেত শুভ্র তুষারে ভরে ওঠে। স্কি করতে বহু লোক এখানে আসে। ওইসব হোটেলে সেই সময় জায়গা পাওয়া যায় না। আমি কল্পনার মানস চোখে দেখতে পাচ্ছি সেসব দৃশ্য।
একটু পর শিলা আবার ডাকলো। আজ যেন ওর কী একটা হয়েছে। শুধু লেক খুঁজে পাচ্ছে। ছুটে গেলাম ওর ডাকে। গিয়ে দেখি একটি নীল লেক। লেকের পানিতে কে যেন নীল রঙ গুলে দিয়েছে। টলটলে স্বচ্ছ নীল পানি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আমরা এখন প্রায় ১ হাজার ৭০০ মিটার উঁচুতে পাহাড়ের অরণ্যে। আর সেখানে এমন জলাধার। কী বিস্ময়! আমি ক্যামেরা হাতে ছবি তুলেই যাচ্ছি। হঠাৎ ঘড়িতে চোখ পড়তেই দেখি বিকেল চারটে বাজে। ফিরতে হবে তো! আজ তো রাত্রিযাপন ‘বিচওয়ার্থ’ নামের একটি ঐতিহাসিক শহরে। যেতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক লাগবে।
আগামীকাল ফিরে যাবো মেলবোর্নে নিজের বাসায়। চোখের তারায়, মনের কোণায় ও ক্যামেরার লেন্সে ফিরে যাবে সব স্মৃতি। জ্বলজ্বল করে জ্বলবে, জ্বলতে থাকবে বুকের মাঝে ‘দ্য গ্রেট আলপাইন রোড’।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |