১২ মার্চ ২০২০। একটি মাইক্রোবাসে চেপে আমি ও আমার পরিবারের সবাই মিরপুর থেকে উপস্থিত হলাম হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। উদ্দেশ্য আমার পিএইচডি কোর্সে যোগ দিতে নিউজিল্যান্ড যাত্রা। চোখের জলে পরিবারের সব সদস্যকে বিদায় বলে বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করলাম।
Published : 27 Jun 2020, 02:31 PM
নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমানে চেপে দোহা, কাতারের পথে যাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে নিউজিল্যান্ডে বিমানযোগে যাবার মূল রুট হলো ঢাকা-সিঙ্গাপুর-অকল্যান্ড। কিন্তু আমি টিকেট কেটেছিলাম ঢাকা-দোহা-অকল্যান্ড রুটে। কারণ করোনাভাইরাসের ভয়।
১২ মার্চের আগেই সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করেছিলো করোনাভাইরাস। সিঙ্গাপুরে প্রথম রোগী সনাক্ত হয়েছিল ২৩ জানুয়ারি এবং চীনের পর করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর ছিল অন্যতম। আর বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী সনাক্ত হয়েছিল ৮ মার্চ। এমন এক পরিস্থিতিতে মাথায় বিভিন্ন বিমানবন্দরে (ঢাকা, দোহা, অকল্যান্ড) করোনাভাইরাস টেস্টের ভয়, ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনের ভয় নিয়ে নিউজিল্যান্ডের পথে বাংলাদেশ ছাড়লাম।
সিঙ্গাপুর হয়ে অকল্যান্ড আসতে যেখানে মোট সময় লাগতো ১৬ ঘণ্টার একটু বেশি সেখানে দোহা থেকে অকল্যান্ড পৌঁছতেই সময় লেগেছিলো ১৬ ঘণ্টার বেশি। আর ঢাকা থেকে দোহা পৌঁছতে সময় লেগেছিলো ৬ ঘণ্টার বেশি। যাত্রা বিরতিতে দোহা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখলাম অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছে না, যদিও আমি ঢাকা থেকে শুরু করে দোহা পর্যন্ত মাস্ক পড়াই ছিলাম।
আরও অবাক হলাম নিউজিল্যান্ডে যাবার উড়োজাহাজে উঠার জন্য নির্ধারিত লাউঞ্জে যাবার পর। দেখলাম, যারা নিউজিল্যান্ডে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে তারা কেউই মাস্ক পড়ে নেই। তখন ভেবে পাচ্ছিলাম না আমার কী করা উচিত, মাস্ক পড়ে থাকা উচিত নাকি খুলে ফেলা উচিত। আমি তখন কতক্ষণ মাস্ক পড়ে ছিলাম আবার কখনো কখনো মাস্ক খুলে অপেক্ষা করছিলাম। একটু বলে রাখি ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কিংবা কাতারের দোহা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কোথাও আমাকে করোনাভাইরাস টেস্টের মুখোমুখি হতে হয়নি।
ভাইরাসের ভয়ে সিঙ্গাপুর না গিয়ে দোহা হয়ে আসতে যেয়ে অতিরিক্ত ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ভ্রমণ করে ১৪ মার্চ নিউজিল্যান্ড সময় ভোর সাড়ে পাঁচটায় এসে পৌঁছলাম অকল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। উড়োজাহাজ থেকে নেমে একটু দূরে যাবার পর দেখি প্যান্টের যে পকেটে মানিব্যাগ ছিল সেটি নেই। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম, কারণ মানিব্যাগে ৫০০ ডলারের বেশি মুদ্রা ছিল। দৌড়ে আবার উড়োজাহাজ পর্যন্ত গেলাম। গিয়ে দেখি সব যাত্রী নেমে গেছে।
উড়োজাহাজে ঢুকতে চাইলাম, কিন্তু আমাকে আর ঢুকতে দেয়া হলো না। পরে জেনেছি এটাই নাকি নিয়ম। যারা উড়োজাহাজ গেটে দায়িত্বে ছিল তারা জিজ্ঞেস করলো আমার সিট নাম্বার কত? বললাম এবং তারা ফোন করে উড়োজাহাজের ভিতরে অবস্থানরত কাকে যেন বললো যে, ওই সিট নাম্বারে একটি মানিব্যাগ পড়ে আছে কিনা, খুঁজে দেখতে? প্রায় ২-৩ মিনিট অপেক্ষার পর একজন বিমানবালা আমার মানিব্যাগটি নিয়ে হাজির হলো। যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। একেতো করোনাভাইরাসের ভয়, আবার মানিব্যাগ হারিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে মানিব্যাগ ফিরে পেয়ে বড় লাগেজ সংগ্রহ করতে মুভিং বেল্টের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
অকল্যান্ড বিমানবন্দরের ভিতরে ঢুকে ব্যাগ সংগ্রহ করে মন খারাপ করে দাঁড়ালাম ইমিগ্রেশনের লাইনে। একমাত্র আমিই মাস্ক পড়া ছিলাম, কারণ ওই সময় নিউজিল্যান্ডের কেউ মাস্ক পড়া শুরু করেনি। যেহেতু দেখলাম কোনো নিউজিল্যান্ডার মাস্ক পড়ছে না তাই আমিও আমার মাস্কটা খুলে লুকিয়ে ফেললাম। কারণ আমি মাস্ক পড়া বিধায় আমাকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ভেবে ভুল না করে বসে। ইমিগ্রেশন অফিসার অ্যারাইভাল সিল দেবার পর ঢুকতে গিয়ে দেখি এয়ারপোর্ট কর্মীরা একটি কোভিড-১৯ ফর্ম ধরিয়ে দিচ্ছে এবং বলছে যদি তোমার সমস্যা থাকে তাহলে তুমি করোনাভাইরাস টেস্ট করতে পারো।
আমি কী আর টেস্ট করি, নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়লাম অকল্যান্ড বিমানবন্দরের ভিতরে। বিমানবন্দর থেকে বের হবার আগে আবার ফাইনাল চেক। আমার ব্যাগ দুটো (একটি সাইড ব্যাগ ও আরেকটি বড় লাগেজ) চেক করে ওকে বলার পর অকল্যান্ড বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে লোকাল বিমানবন্দরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। কারণ আমার গন্তব্য অকল্যান্ড নয়, আমার থাকার শহর পালমারস্টোন নর্থ।
পালমারস্টোন নর্থ যাবার লক্ষ্যে অকল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে পায়ে হেঁটে হাজির হলাম। নতুন দেশ, কিছু চিনি কিংবা জানি না, একা একা সব করতে হচ্ছে। ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে এসে বড় লাগেজটা উড়োজাহাজে পাঠিয়ে সাইড ব্যাগটি নিয়ে ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে অবস্থান করে দেখি উড়োজাহাজ ছাড়তে প্রায় দুই ঘণ্টা বাকি।
ওই সময় ঘটলো আরেক কাহিনী। সাইড ব্যাগটি সোফায় রেখে একটু দূরে যেয়ে ফ্রি ওয়াইফাই এর সুবিধা নিয়ে মনের সুখে বাংলাদেশে কথা বলছিলাম। কথা বলা শেষ করে সোফার কাছে গিয়ে সাইড ব্যাগটি ধরবো এমন সময় নিউজিল্যান্ডের পুলিশ আমাকে আমার ব্যাগ ধরতে নিষেধ করলো। কারণ পুলিশ ভেবেছিলো ব্যাগটি কেউ রেখে চলে গেছে এবং এর কোনো মালিক নেই। পরে পুলিশকে অনেক কষ্ট করে বুঝিয়ে, ব্যাগ খুলে সব দেখিয়ে প্রমান করতে পেরেছিলাম যে ব্যাগের মালিক আমি। এ থেকে শিক্ষা নিলাম, বিদেশে গেলে ব্যাগ রেখে কোথাও যাওয়া যাবে না।
নিউজিল্যান্ডে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী সনাক্ত হয়েছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি আর বাংলাদেশে ৮ মার্চ। আর ১৪ মার্চ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে মোট করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ছিল ৬ আর বাংলাদেশেও ৬। এমন এক পরিস্থিতিতে ভয়ে ভয়ে পা রাখলাম নতুন দেশে। ভয় ছিল নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে কোনো ঝামেলায় না পড়ি, ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনের ভয় তো ছিলই। তবে অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়া ভোরের অন্ধকার আর সকালের ঠান্ডা হিমেল বাতাসের মধ্যে ১৪ মার্চ পা রাখলাম নিউজিল্যান্ডে। তখন অর্থাৎ মার্চে বাংলাদেশে গরম শুরু হয়ে গেছে আর সেখান থেকে এসে নামলাম শীতের রাজ্যে।
বিমানে অকল্যান্ড থেকে পালমারস্টোন নর্থ পৌঁছতে সময় লাগলো প্রায় এক ঘণ্টা। ১৪ মার্চ ছিল শনিবার আর এখানে শনি ও রোববার বন্ধ থাকায় এ দুইদিন বাসাতেই ছিলাম। ১৬ মার্চ মেসি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে নিজের উপস্থিতি জানালাম। ওইদিন বিকেলে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন ঘোষণা দিলেন যে, করোনাভাইরাসের কারণে ১৬ মার্চ রাত ১২টার পরে যেসব বিদেশি নিউজিল্যান্ডে প্রবেশ করবে তাদেরকে ১৪ দিনের সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে মাত্র ২ দিন আগে নিউজিল্যান্ডে প্রবেশ করে সেলফ কোয়ারেন্টাইনের কষ্ট থেকে বেঁচে গেলাম। আর ১৯ মার্চ রাত ১২টার পর তো একমাত্র নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী ছাড়া সব বিদেশিদের জন্য নিউজিল্যান্ডে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হলো যেটা এখনো অব্যাহত আছে।
২১ মার্চ নিউজিল্যান্ড করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে ৪ ধরণের সতর্কতার ঘোষণা দেয় এবং ২৫ মার্চ থেকে নিউজিল্যান্ড পুরোপুরি লকডাউনে চলে যায়। অর্থাৎ পিএইচডি করতে এসে আটকা পড়ে গেলাম লকডাউনে। নিউজিল্যান্ডে ৭ সপ্তাহ অত্যন্ত কঠোরভাবে পালিত হয় লকডাউন। অবশ্য সুখের কথা হলো গত ২১ মে থেকে নিউজিল্যান্ডে কোনো করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগী সনাক্ত হয়নি। সে সুবাদে ৮ জুন থেকে নিউজিল্যান্ডকে করোনাভাইরাসমুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ নিউজিল্যান্ডে মাত্র ৫০ লাখ মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে এক হাজার ৫১৫ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। মারা যান মাত্র ২২ জন। আর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অন্যান্য সবাই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। নিউজিল্যান্ডই বিশ্বে প্রথম দেশ যে কিনা নিজেকে করোনাভাইরাস মুক্ত বলে ঘোষণা করলো। তাই এখন আশা করতেই পারি করোনাকালীন সময়ে এসে পৌঁছলেও ভালোভাবে পিএইচডি সম্পন্ন করতে পারবো। সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী।
লেখক: যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পিএইচডি গবেষক, মেসি ইউনিভার্সিটি, নিউজিল্যান্ড
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |