চীনা আন্টি রি সিয়ক আমার পাশের দোকানি। আমরা অনেক দিন কুয়ালালামপুরের চায়নাটাউনে পাশাপাশি দোকান করি। আন্টি থাইল্যান্ডের তৈরি কাপড় বিক্রি করেন। আমার লেদার হ্যান্ডব্যাগের দোকান।
Published : 08 Nov 2018, 08:26 PM
২০১১ সাল থেকে আন্টির পাশে আছি, মানে আট বছর চলছে। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে জন্ম নেওয়া আন্টি রি সিয়ক এর বয়স এখন একাত্তর। ২০১১ সালে আমরা যখন আন্টির পাশে এসে দোকান খুলি তখনও আমার আব্বা পৃথিবীতে ছিলেন। আমার আব্বার জন্ম আন্টির আরো এক বছর পরে, মানে ১৯৪৮ সালে। শরীরে অসুখ লালনপালন করে সিদেসাধা জীবনযাপন করে আব্বা হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গেলেন, সেই ২০১৫ সালে। আর আমার পাশের চীনা আন্টি এখনও সুস্থ শরীর নিয়ে প্রতিদিনই ১২ ঘণ্টা ডিউটি করে যাচ্ছেন তার দোকানে।
শুধু নামমাত্র ডিউটিও নয়, ছোট্ট দোকানটিতে তিনি একাই কাপড় ডিসপ্লে ও বেচাকেনার কাজ করেন। বেচাকেনা করার মতো টুকটাক ইংরেজি জানেন, তা দিয়েই তেতাল্লিশ বছর ধরে পৃথিবীর নানান দেশের পর্যটকদের কাছে মাল বিক্রি করেন। কুয়ালালামপুর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দকৃত দোকানটির লাইসেন্সধারী মালিক এই চীনা আন্টি নিজেই। কিন্তু দোকানটি তিনি ভাড়াতে দিয়েছেন অন্য আরেকজন চীনাকে। ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ীর দোকানেই চাকরি করেন খোদ দোকানমালিক! অর্থাৎ মাস শেষে আন্টি দোকান ভাড়া ও বেতন দুটোই ওয়ালেটে ঢুকান। আন্টির ছেলেমেয়েরাও আয়-রোজগারে আছেন। মোটামুটি স্বচ্ছলতা আছে তার সন্তানদের। আন্টি তার আয় থেকে শুধু নিজে চলেন না, তার নাতি-নাতনিদের পড়ালেখার খরচও জোগান দেন। সম্প্রতি আন্টি ছেলের ঘরের এক নাতনিকে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন ইংল্যান্ডে। আরেকজনকে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন আবার।
হ্যাঁ, দেশের বাইরেই তো! আন্টিকে কখনও শুনিনি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে। সেই সময়ই বা কই তার। তবে বছর দু'বছরে একবার দলবেঁধে বিদেশে বেড়াতে যান আন্টি। ইতিমধ্যে তিনি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, চীন, হংকং, মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ ঘুরে দেখেছেন। এই বিদেশ ভ্রমণের আর্থিক সামর্থ্য ও পাসপোর্টের মান নিয়ে একটা বিষয় দীর্ঘদিন ধরে লিখবো লিখবো করে লেখা হয়নি।
আজ বলছি একটু। আন্টি ও তার বান্ধবীরা মালয়েশিয়ান, আর আমি বাংলাদেশি। উনারা হয়তো আমাদের চেয়ে কম টাকা আয় করেও বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন, আমরা সহজে পারি না। পরিচিত এক চীনা তরুণী যে মাত্র আড়াই হাজার রিঙ্গিত (পঞ্চাশ হাজার টাকা) বেতনে চাকরি করেন পাশের দোকানে। তিনিও গতবছর অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছেন। আগে পাশ্ববর্তী আরো কয়েকটি দেশেও ঘুরতে গিয়েছিলেন। অথচ তার কয়েক গুণ বেশি টাকা আয় করলেও অস্ট্রেলিয়া ঘুরতে যাওয়াটা আমাদের জন্য বিশাল ব্যাপার। এই লেখার মূল বিষয় যেহেতু আন্টিকে নিয়ে, তাই বিদেশ ভ্রমণ কেন করতে পারি না সে ভাবনার কথা না হয় পরে কোনও এক সময় লিখব।
আন্টিকে কিছুদিন পর পর প্রশ্ন করি, আন্টি কেন কাজ থেকে অবসর নেন না। আন্টি বলেন, 'অবসর নিলে ঘরে বসে থাকতে হবে। ঘরে বসে থাকাটা বড় বিরক্তিকর ব্যাপার। ঘরে বসে থাকলে শরীর অসুস্থ হয়ে যাবে। কাজ করলেই শরীর সুস্থ থাকে।'
নয় ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় আন্টি জীবনের প্রথম দিকে কাজ করেন সিঙ্গাপুরে। পরে প্রায় তেতাল্লিশ বছর ধরে আন্টি আছেন কুয়ালালামপুরের চায়নাটাউনে। তিনি ছাড়া বাকি সব ভাইবোন কুয়ালালামপুর থেকে দূরের নিজ গ্রামেই বাস করেন। বিয়ের পর থেকে আন্টি স্বামীর সাথে শহরমুখী হন। জীবনযাপনের জন্য সেই আটাশ বছর বয়সের টগবগে তরুণী যে শুরু করেছিল চায়নাটাউনে বেচাকেনার কাজ, আজ একাত্তর বছর বয়সেও সচল আছেন তিনি সমান তালে।
শুধু আমাদের এই আন্টি নয়, আরো বহু চীনা বয়স্ক নারীপুরুষ আছেন মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী চায়নাটাউনে। যারা প্রতিদিন সকাল থেকে রাত দশটা-এগার পর্যন্ত ডিউটি করেন। তাদের কেউ নিজে ব্যবসা করেন, কেউ কেউ চাকরি করেন। তাদের কারো চোখেমুখে বয়সের কারণে ক্লান্তির ভাব দেখা যায় না। যতদিন জীবন ততদিন কাজ, কাজেই শান্তি, কাজেই আনন্দ, কাজের অপর নামই জীবন; অন্তত কুয়ালালামপুর চায়নাটাউনে দেখা এই চীনাদের কাছে।
বাংলাদেশে আমাদের মুরুব্বিরা কাজ না করে ঘরে বসে বসে খান, তা কিন্তু নয়। তারাও ব্যস্ততায় দিন কাটান ঘরের এই কাজ, সেই কাজ নিয়ে। আমার মাকে দেখি কোনও কাজ না করতে শতবার বারণ করলেও, তিনি ঘরের নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। ঘরে উনার কাজের অভাব নেই। ছেলের বউয়েরা কোনও কাজ খুঁজে না পেলেও মা ঠিকই কাজ খুঁজে বের করেন; তবে ছেলে বউদের জন্য নয়, নিজে করার জন্য। প্রধান ব্যতিক্রম একটাই, চায়নাটাউনের চীনা মুরুব্বিরা সুস্থতার সাথে জীবনযাপন করছেন, আর আমাদের মুরুব্বিরা সুস্থ থাকেন কম। এর প্রধান কারণ আমাদের মুরুব্বিরা ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলেন না। অসুস্থ হয়ে ডাক্তার দেখিয়ে দুদিন ওষুধ খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই ডাক্তারের পরামর্শ মানেন না আর। আমাদের মুরুব্বিরা যদি সুস্থ থাকেন আমরা যে যেখানে থাকি, টেনশন মুক্ত থাকি। পরিবারের সদস্যদের সুস্থতায়, যেকোনও মানুষ চলার পথে স্বস্তি পায়।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |