ছোটবেলায় আমার খুব প্রিয় এক খেলার সাথীর নাম ছিল ‘ইরানী’। আমার এক ফুপুর জা এর মেয়ে। খুব ভালো গল্প বলতে পারার জন্যই এখনও খুব করে মনে পড়ে ইরানীর কথা।
Published : 16 May 2018, 04:55 PM
আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলে, চাঁদনী রাতে উঠানে আমরা সবাই মিলে কত শত গল্প করতাম! আমাদের সেই সময়ে ইরান, ইরাকের সাদ্দাম আর যুক্তরাষ্ট্রের বুশের খুব গল্প হত। আমরা তখন মিছিলও করতাম সাদ্দামের পক্ষে। মাটির কলসের ভাঙা মুখ দিয়ে মাইক বানাতাম আর কলাগাছ দিয়ে বানাতাম ক্যাসেট প্লেয়ার। সুতরাং, ইরানের ব্যাপারে আগ্রহটা আমার ছোটবেলা থেকেই অনেক বেশি ছিল।
আমার মাস্টার্স প্রোগ্রামের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের যোগাযোগ আর সংযুক্তি বাড়ানো। সেই সূত্রে অসংখ্য ভ্রমণ আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে নানা কর্মসূচি করি আমরা।
ইরানে যাওয়া তেমনই একটি প্রক্রিয়া। কোলনের ‘আইটিটি’ আর বনের ‘আর্টস ইনস্টিটিউটের’ যৌথ উদ্যোগে ছিল এ শিক্ষা সফর।
মার্চের ৬ তারিখ বউ সুন্দর করে প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দিল। সকালে যখন তাকে রেখে যাচ্ছিলাম, তার মুখের দিকে তাকানোটা সত্যি কষ্ট হচ্ছিল। এই প্রথম সে বাড়ির বাইরে, মার্চের ১ তারিখ এসেছে সে সুদূর জার্মানিতে! একা রেখে যেতে আমারও যে খারাপ লাগেনি, তা বলবো না। কিন্তু প্রয়োজনের কাছে উপায়ও কখনও কখনও অসহায়।
সকাল ৮টায় বন রেলস্টেশন থেকে ডুসেলডর্ফের দিকে রওনা হলাম আমরা। এই সেই ডুসেলডর্ফ, যেখানে আমি প্রথম বাংলাদেশ থেকে এসেছিলাম।
মাঝখানে ক্লোন স্টেশন থেকে আইটিটি এর বাকি বন্ধুরা উঠল। প্রয়োজনীয় চেকিং, বোর্ডিং শেষ করে, টার্মিনাল ‘সি’ এর ৪৫ নাম্বার গেইট দিয়ে ইরানের বেসরকারি বিমানসংস্থা ‘মাহান এয়ার’ এর বিমানে উঠলাম আমরা।
সাধারণত, বিমানের কেবিন ক্রুরা অনেক ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ আর ভারি সাজসজ্জা নিয়ে নিজেদের খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। কিন্তু মাহান এয়ার আমাকে কিছুটা হতাশই করল। এরা খুব সাধারণ, এক ধরনের ইউনিফর্ম দিয়ে কেমন যেন সাজহীন কেবিন ক্রু! বাহ্যিক রূপের কদর আমার কাছে খুব একটা না থাকলেও, মনে হলো ইরানের মেয়েরা সাধারণত এদের চাইতে একটু বেশিই সুন্দর হয়।
আমি দুপুরের খাবার খেয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে চোখ মেলে তাকিয়ে একটু চমকে উঠলাম। ঘুমানোর আগে দেখেছিলাম অনেক নারী যারা খুবই আধুনিক, এখন সবার শরীর চাদরে জড়ানো আর মাথায় হিজাব।
কিছুক্ষণ পরই পাইলট বললেন, আর অল্প সময়ে আমরা ল্যান্ড করবো। সবাই যেন বেল্ট বেঁধে তৈরি হই। আমি তখন বুঝলাম, ও এই ব্যাপার! ইরান তো আবার মুহতারাম খামেনি হুজুরের বিপ্লবের ইসলামি প্রজাতন্ত্র। তাই এদেশে ঢুকতে হলে, অনিচ্ছায় হলেও মাথার কিছু অংশ আর শরীর ঢাকতেই হবে।
ইমিগ্রেশন চেক করার পর, হঠাৎ এক পুলিশ কর্মকর্তা ফার্সি ভাষায় আমাকে যেন কী বলল। আমি বললাম, ‘বুঝি নাই’। বিরক্ত হয়ে সে আরেক কর্মকর্তাকে দেখিয়ে দিল। সেই কর্মকর্তাও ফার্সি ভাষায় আমাকে কী যে বলল, বুঝলাম না। খুব বাজে ব্যবহার মনে হলো, তার চোখ অন্তত তাই বলল। আমাকে ফের বের করে দিয়ে এক জায়গায় বসতে বলল কিছুটা ধমকের সুরে।
আমাদের কো-অর্ডিনেটর সুজানা চেষ্টা করল কথা বলতে। তাকেও বাজেভাবে পাঠিয়ে দিল সেই পুলিশ। বাইরে বের হয়ে দেখি মাহসা আছে সেখানে। মাহসা ইরানি নাগরিক এবং সে এই ট্যুরের একজন আয়োজক। এরপর মাহসা সব শুনে বলল, ‘অপেক্ষা কর। কিছু হবে না। আমি দেখি।’ মাহসার সঙ্গেও সেই পুলিশ খুব একটা ভালো ব্যবহার করল না।
অনেক পরে মাহসা আমাকে বলল, ‘বাংলাদেশিরা নাকি ড্রাগ আনে।’ আমি বললাম, ‘আমি তো এখন জার্মানি থেকে আসছি। হাউ ফানি! আর আমি তো ইরানে থাকতে আসিনি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে আসা!’
পরে সেই পুলিশের ডিউটি শেষ হবার পর নতুন পুলিশ এলো। সেই পুলিশকে মাহসা কী যেন বোঝালো। তারপর আরেকজন পুলিশ এসে আমার সব চেক করে, ভেতরে ডেকে নিয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম ইন ইরান!’
আমি কিছু না বলে, পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘আমার কী ভুল ছিল, জানতে পারি?’ মাহসা কথা বাড়াতে না দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে এলো। নিচে এসে দেখি সবাই আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, ফিরতি টিকেট থাকলে বন ফিরে যাই। মাহসা বুঝতে পেরে বলল, ‘সাহেদ! সরকার আর মানুষ ভিন্ন। বিশ্বাস করো আমাকে!’
এরপর আমাকে একটা ট্যুরিস্ট সিম কিনে দিল মাহসা। ফোর-জি সিম, ইরান সেল। সিম নিয়ে বাসে উঠার এক ঘণ্টা পর সিম চালু হলো। সে যে কী বাজে সিগন্যাল!
আর আমি ভুলে গিয়েছিলাম, এই দেশে নেট দুনিয়া সুনিয়ন্ত্রিত। ভুলে গিয়েছিলাম, যে দেশের সরকার যত অসৎ, যত দুর্বল, তাদের নিয়ন্ত্রণ কিংবা আইন তত কঠিন। কেবল হোয়াটসঅ্যাপ করা যায়, তাও মেসেজ দিলে দশ মিনিট পর ডেলিভারি হয়। জিমেইল, ফেইসবুক সব বন্ধ।
বউকে জানালাম আমার অবস্থান। তারপর চললাম তেহরানের শহিদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজের দিকে। বাসে ড্রাইভার ইরানি গান চালালো বেশ কিছু। রাতের ইরান শহর বেশ কিছুটা আধুনিক ঢাকার মতো। অনেক বড় বড় দালান। বৈদ্যুতিক আলোর চমক। তবে সবুজের খুব অভাব। চারদিকে শুধু শক্ত পাথরের দুনিয়া আর বালু।
আমার বারবার মনে হচ্ছিল, কেন এমন করল পুলিশ! হয়ত, শিয়া-সুন্নী বিষয়। কিংবা বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি। অথবা পৃথিবীর নিম্ন মানের সবুজ পাসপোর্টধারী আমি! এটা নিশ্চিত, কোনো সন্দেহ নেই, শুধু অপদস্থ করার জন্যই এটা করেছে তারা।
থাকার জায়গায় পৌঁছে, মধ্যপ্রাচ্যের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ফালাফেল’ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ড্রাইভার একটা গান শুনিয়েছিল। সুরটা কানে বাজছে। অর্থ না বুঝলেও সুর বুঝতে কেন যেন বাজে না আমার।
কিছুটা বিরহের গান। পরে জেনেছি, ও ছিল ইরানি শিল্পী ইফতেখার দাদেবালার ‘ম্যায়খোনেহ’ গান। এই শিল্পী এখানে ‘মাহাশতি’ নামে পরিচিত। ঘুমানোর চেষ্ট করতে লাগলাম। সকাল থেকে দৌড় শুরু হবে। ইরানকে জানার দৌড়।
লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, বন বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি
ই-মেইল: [email protected]
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |