জার্মানিতে আমার দুইবার দাঁতের মাড়িতে অপারেশন হয়েছে। পুরোটাই বিনামূল্যে।প্রথমবার অপারেশনের ব্যাপ্তিকাল ছিল আনুমানিক বিশ মিনিট, পরের বার চল্লিশ মিনিট।
Published : 28 May 2017, 11:40 AM
লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়াতে আমি সব কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম, দাঁত ও মাড়ির মধ্যে কী পরিমান কাটা-ছেড়া, ঘষা-মাজা হচ্ছে।
অবাক ব্যাপার হচ্ছে, ডাক্তাররা অপারেশন শেষ করে দাঁতের মাড়িতে তুলা গুঁজে দিয়েই বাসায় চলে যেতে বললেন। কোন রকম ঔষধপত্র ছাড়া! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এতবড় অপারেশন, কোন ঔষধ দেবেন না?অ্যান্টিবায়োটিক? গ্যাস্ট্রিক? ব্যাথার ওষুধ?
আমাদের দেশে আবার ব্যাথার ঔষধের সাথে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক । প্রেসক্রিপশনে সব সময় এরা পাশাপাশি ঘুমায়। আমার পীড়াপীড়িতে ডাক্তার আপা শেষে একটা মাত্র ইবুফ্লাম নামের ব্যাথার ঔষধ লিখে দিলেন। আমি ভাবলাম, এত ঔষধ খরা যদি জার্মানিতে চলে, তাহলে এখানকার ফার্মেসি ব্যবসা কীভাবে চলছে?
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হওয়ার পর কোন মেডিসিন রিপ্রেজেন্টেটিভও দেখা গেলনা। দেশে থাকতে দেখতাম, চেম্বার থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে হাতে কালো সুটকেস, গলায় টাই পরা কিছু অসহায় ভদ্রলোক ছুটে চলে আসতো ডাক্তার কীঔষধ দিলেন, তার কোম্পানির ঔষধ দিলেন কীনা, সাথে প্রমাণ রাখতে চট করে মোবাইলটা বের করে প্রেসক্রিপশনের একটা ছবিও তুলে রাখেন।
মেডিসিন রিপ্রেজেন্টেটিভদের দেখলে আমার আবার খুব মায়া লাগতো।শুধু রুটি-রুজির জন্য নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নিজেদের বয়সের থেকে কম বয়সী ডাক্তারদের স্যার স্যার বলে তেল মারতো। ডাক্তারদেরও দেখতাম, খুব গম্ভীর ভাব নিয়ে সেই তেল মালিশটা উপভোগ করতো।
জার্মানিতে মেডিকেল টেস্ট প্রায় সবটাই বিনামূল্যে। আমার দাঁতের মাড়ির অপারেশনের পূর্বে কয়েকবার বিভিন্নভাবে মাড়ির এক্স-রে নেওয়া হয়েছিল।টেস্ট রিপোর্টের কোন হার্ড কপি নেই, সফ্ট কপি থাকতো ডাক্তারের কম্পিউটারে। এ ধরনের টেস্ট রিপোর্ট রোগীর হাতে যাবার সুযোগই নেই। ডাক্তারের কাছে আমার জন্য খোলা ফাইলে সব ধরনের ডায়াগনোসিসের রিপোর্ট সংযুক্ত করা আছে।
আগামী দশ দিন পর অথবা এক বছর বা পাঁচ বছর পর ওই ডাক্তার জীবিত থাকলে তার কাছে যাওয়া মাত্রই আমার নাম ও জন্ম তারিখ মিলিয়ে আমার সব তথ্য তিনি মিলিয়ে নিতে পারবেন। একবার জ্বর নিয়ে হাউজ ডাক্তারের কাছে গেলাম, শরীর চেক-আপ করে রক্তের কিছু নমুনা নিয়ে প্যাথলজি টেস্ট করা হলো, সবটাই ছিল বিনামূল্যে। বাংলাদেশে এই টেস্টগুলো করতে কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা লাগতো।
জার্মানিতে দোকানগুলো লক্ষ করেছি। সুপার মার্কেটগুলোক্রেতাদের জমজমাট উপস্থিতি থাকলেও ফার্মেসিগুলোথাকে ক্রেতাশূন্য। হোক সে সকাল, বিকাল অথবা সন্ধ্যা।ক্রেতা মাত্র দুই-একজন থাকে কী থাকেনা।বিক্রয়কর্মীরা অলস সময় পার করে।
কিছুদিন আগে দেশে গিয়েছিলাম মাত্র দুই মাসের জন্য।ঔষধের দোকানগুলো দেখে আমি হতবাক!মানুষ চাল-ডাল, মুড়ি-বাতাসা কেনার মত করে ঔষধ কিনছে। পাশের মুদি দোকানদার ক্রেতা পাচ্ছেনা, হা করে বসে আছে কখন একজন ক্রেতা আসে। অথচ ফার্মেসিতে এতটাই মানুষের ভিড় যে সামান্য একটা ঔষধ কিনতে হলে আধা ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করা লাগে।
আমার পরিচিত আত্মীয়-স্বজন, বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকেই দেখেছি, এরা চারভাগ পেটের পুরা একভাগই ঔষধ দিয়ে ভরে রাখে। মা মাঝে মাঝেই বলতো, “আজকে মাজায় ব্যাথার ডাইক্লোফেন বড়ি নিয়ে আসিস তো।গালের ভেতর ছুলে গেছে, রিবোফ্লাভিন নিয়ে আসিস তো।দাঁতে ব্যাথা, নুপ্রাফেন আর ফাইক্লক্স নিয়ে আসিস তো।”
আমার মা অষ্টম শ্রেণি পাস, অথচ দীর্ঘদিন ঔষধ সেবনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে জটিল জটিল দাঁত ভাঙ্গা সব ঔষধের নাম দিব্যি মুখস্ত করে ফেলেছে।
আমি কোন রাজনৈতিক আলোচনা এখানে করবনা। প্রতিটা নাগরিকের জন্য একজন ডাক্তার সেবার ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। উন্নত দেশগুলোতে কিন্তু প্রতিটা নাগরিকের জন্যই একজন করে ডাক্তার নিযুক্ত করা আছে।এর মানে এই নয় যে সেই ডাক্তার রোগী চাহিবা মাত্র সেবা দেওয়ার জন্য তটস্ত হয়ে রোগীর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে।
জার্মানিতে প্রতিটা নাগরিকের জন্য একজন নির্দিষ্ট ডাক্তার নিয়োগ করা আছে। এই ডাক্তারকে বলা হয় ‘হাউজ ডাক্তার’। প্রতিটা রোগীর জন্ম থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব রোগের বায়োডাটা ও রোগের ইতিহাস- সবকিছু ডাক্তারের কাছে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। যে কোনো ছোট-বড় সমস্যা অনুভব করলে প্রথমে এই ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয়।
এই ডাক্তারগুলো সাধারণত মেডিসিনের ডাক্তার হয়ে থাকে। প্রথমে ডাক্তারের কাছে গিয়ে রোগের সমস্যাজনিত কারণ ব্যাখ্যা করার পর নিজে যদি সেবা দিতে পারেন, তখন তিনি নিজেই মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেন। নতুবা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে সুপারিশসহ পাঠিয়ে দেন।
জার্মানিতে প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য বীমা করা বাধ্যতামূলক। এখানে যেসব চিকিৎসা সেবার কথা বিনামূল্যে বলা হয়েছে, আসলে তার সবটাই পরিশোধ করে এই বীমা কোম্পানি। সদ্য প্রসূত বাচ্চা শিশু থেকে শুরু করে বার্ধক্যজনিত মৃত্যুর দিন পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য বীমা থাকা আবশ্যক। যদি কারো স্বাস্থ্য বীমা এক মাসের জন্যেও স্থগিত থাকে, তার জন্য চাকরি করা কিংবা অন্যান্য নাগরিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
জার্মানিতে মূলত দুই ধরনের স্বাস্থ্যবীমাকারী প্রতিষ্ঠান আছে-সরকারী ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারী প্রতিষ্ঠান-ই বেশি নির্ভরযোগ্য। একজন ত্রিশ অনুর্ধ্ব নাগরিককে স্বাস্থ্যবীমা বাবদ প্রতিমাসে ৯০ ইউরো (৮ হাজার টাকা) ও ত্রিশোর্ধ্ব বা চাকরিজীবী নাগরিককে বীমা কোম্পানিভেদে ১৬০ থেকে ১৮০ ইউরো প্রতিমাসে (১৪ হাজার টাকা) পরিশোধ করতে হয়। তবে চাকরিজীবী ব্যক্তির স্বাস্থ্যবীমা চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান-ই পরিশোধ করে থাকেন। ফলে পরিশোধের দুঃশ্চিন্তা থাকেনা।
তবে স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির কিছু বিধি-নিষেধ থাকে, যেমন- শরীরের সৌন্দর্য বর্ধন জাতীয় কোনো চিকিৎসার ভার এরা বহন করেনা। যেমন- নতুন দাঁত লাগানো বা দাঁতে বেস লাগানো বা দাঁত ইমপ্লান্ট করানো।
সবার জন্য সাধারণ চিকিৎসা সেবা খুবই সাধারণ ব্যপার মনে হলেও অনেক সময় জটিল ও দামী চিকিৎসাও কিন্তু সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশে যখন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে হঠাৎ করেই জটিল রোগ ধরা পড়ে, তখন ওই পরিবারের সমস্ত সঞ্চয়টা ধ্বংসের পথে আগুয়ান হয়।চিকিৎসা কোথায়-কীভাবে করবে, টাকা-পয়সা কীভাবে যোগাড় করবে, এসব নিয়ে হরেক রকম দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়। অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারাও যায়, দীর্ঘদিন বিনাচিকিৎসায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়।
নিম্নবিত্ত মানুষদের বিপদ আরও চরম মাত্রায় পৌঁছে।এদেড়কে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়। চিকিৎসার খরচ যোগাতে রাস্তায় নামতে হয়।মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। আজকে বাংলাদেশে এমন কোন ব্যবস্থা থাকলে হয়তো জটিল ও দামী রোগগুলো নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা করতে হতোনা।
সব পেশার মানুষের আয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে সব ধরনের চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী বা কৃষক- সবার জন্য সরকারীভাবে স্বাস্থ্য বীমা বাধ্যতামূলক থাকলে হয়তো মানুষ অসুখ-বিসুখের সুচিকিৎসা নিয়ে ভাবতো না। দুশ্চিন্তাও করতে হতোনা।
লেখক: সাইন্টিফিক রিসার্চার, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সাইন্স, হালে, জার্মানি।
ইমেইল: [email protected]
ছবি: ইন্টারনেট
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |