অনেকের মতো একসময় আমিও স্বপ্ন দেখতাম তুষারপাত দেখবো। বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারতের মানালিতে গেলেই নাকি শ্বেতশুভ্র বরফের দেখা মেলে।
Published : 18 Dec 2016, 03:45 PM
কতবার যে পরিকল্পনা করেছি, অন্তত সেখানে গিয়ে হলেও ধবল বরফ দেখে আসবো। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। অথচ এখন এই ‘সাদা’র সাথেই আমার নিত্য বসবাস।
শীতকালে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে দেখি, চারপাশ ছেয়ে আছে ঘন সাদায়। অর্থাৎ রাতভর তুষারপাত হয়েছে। মনটা অদ্ভূত এক ভালোলাগায় ভরে ওঠে।
চারপাশটা যেন হঠাৎ করেই বদলে যায়। চেনা ভূবন অচেনা হয়ে ওঠে। তবে এই অচেনা ভূবন কতটা অচেনা হবে, তা নির্ভর করে কত ইঞ্চি বা ফুট তুষারপাত হলো তার ওপর। বেশি তুষারপাতে চারপাশটা বেশি বদলে যায়।
তুষারপাত আমার অনেক ভালো লাগে। কারণ চারপাশকে দেখলে মনে হয় পৃথিবীটা যেন একটি বড় আকারের সাদা ভাস্কর্য। গাছপালা, বাড়ি, গাড়ি সবকিছু ঢেকে যায় তুষারে। যখন আকাশ থেকে গুড়ি গুড়ি তুষার ঝরে পড়ে, সেই দৃশ্য মন ভোলানো। তখন তা গায়ে মাখতে বেশ লাগে। অল্প অল্প করে চোখের সামনে পথ-ঘাটে জমে যায় তুষারের স্তুপ।
মেঘ থেকে নিঃসরিত পানি বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে নিম্ন তাপমাত্রায় জমে বরফ হয়ে যায়। বিশেষ অবস্থায় তা ভূমিতে পড়তে শুরু করে। আর এই ঝরে পড়াকেই বলে তুষারপাত। আর ক্রিসমাসের সময়টায় তুষারপাত একটু বেশিই হয়।
তুষারপাতের সময় আমার প্রথম কাজ হয় যত দ্রুত সম্ভব মেয়ে অপর্ণাকে সাথে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসা। এরপর আমরা দু’জনে মেতে উঠি বরফ উৎসবে। বিশেষ করে অপর্ণা তুষারের স্তুপ দিয়ে তৈরি করে ‘স্নোম্যান’ সহ নানা ভাস্কর্য।
এদেশের ছেলে-মেয়েরা সুযোগ পেলেই শ্বেতশুভ্র তুষার নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। অনেক ঢালু পাহাড়ি জায়গায় স্কিয়িং করা, আইস স্কেটিং কিংবা তুষারের মাঝে লুটোপুটি খাওয়ার উৎসব চলে।
তবে এখানে কিছু মানুষের পেশা তুষারপাতের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিষ্কার করা। তাদের সাথে থাকে প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম। গাড়ি বের করা গেলেও এসময় রাস্তায় তা চালানো একেবারে সহজ নয়।
বৃষ্টি হলে তুষারের স্তুপ গলে যায়। তখন বিপদ কম। তবে তাপমাত্রা যদি আরও কমতির দিকে থাকে, তাহলে সেই তুষারগলা পানি হয়ে যায় বরফ। যা রাস্তার সাথে লেপ্টে থাকে। বিশেষ করে চোখে দেখা যায় না এমন ‘ব্ল্যাক আইস’ হয় ‘মারাত্মক’। এই রাস্তা হয়ে যায় খুবই পিচ্ছিল। এর উপর দিয়ে গাড়ি চালানো এবং হেঁটে যাওয়া দুটিই খুব কঠিন।
তুষারপাতের পর সেগুলো গলতে শুরু করলে রাস্তা হয়ে ওঠে কাঁদা কাঁদা। তখন ভালো লাগায় ছেদ পড়ে। তার উপর অতিরিক্ত তুষারপাত হলে তা নাগরিক জীবনে তৈরি করে নানা ধরনের ভোগান্তি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেকোন পরিস্থিতিকে সামনে রেখে নানা ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে এখানে। মোবাইল ফোনে, টেলিফোনে প্রতিনিয়ত ওয়েদার আপডেট দেয়া হয়। সিটি কর্তৃপক্ষ কখন কি করতে হবে, সময়মতোই জানিয়ে দেয়।
তুষারপাতের পূর্বাভাস থাকলে আগে থেকেই শহরজুড়ে ছিটিয়ে দেয়া হয় লবণ। তুষারপাতের পর তা দ্রুত গলে যেতে সহায়তা করে। আবার তুষারপাতের পরই দ্রুত রাস্তায় নেমে পড়ে পরিচ্ছন্নতা দল। সাথে থাকে অদ্ভূত ছোট বড় গাড়ি। দ্রুতই রাস্তাকে মানুষের চলাচলের উপযোগী করার চেষ্টা করা হয়।
প্রতি বছরই তুষারপাত হয়। চারিদিক ঢেকে যায় সাদা, সাদা আর সাদায়। এরপরও যখনই তুষারপাত হয়, তখনই মনে হয় যেন নতুন। প্রতিবারই মানুষ এই অদ্ভূত সাদাকে নিজেদের মতো করে বরণ করে নেয়। এর সৌন্দর্যে মগ্ন হয়। উপভোগ করে। দুর্ভোগটাকে বড় করে দেখে না। কষ্টের চেয়ে তুষারপাতে মানুষের আনন্দটাই যেন বড় হয়ে ওঠে।
লেখক: ইয়োগা আর্টিস্ট, লেখক ও উপস্থাপক।
ইমেইল: [email protected]
আশরাফুন নাহার লিউজার আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!