নামটা শুনছি অনেক দিন ধরেই। যাওয়ার ইচ্ছাও প্রবল। কিন্তু সময় আর সুযোগ এক হয়ে না ওঠায় যাওয়া হচ্ছিল না।
Published : 10 Dec 2016, 05:14 PM
বিশ্বমঞ্চে ইয়োগা, ইয়োগার বিশ্বায়ন
কংক্রিটের অরণ্যে স্রোতস্বিনী নদী
অযান্ত্রিক গ্রাম: অ্যামিশ ভিলেজ
এবার হঠাৎ সিদ্ধান্ত। নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের ফোরটি সেকেন্ড স্ট্রিট তো আর খুব দূরে নয়। অনলাইনে টিকেট কাটা হলো, এরপর যাত্রা।
সাবওয়ে স্টেশনের সামনে গাড়িটা রেখে, এফ ট্রেন ধরে ব্রায়ান্ট পার্ক। এরপর পায়ে পায়ে অল্প একটু পথ। ব্যাস, এইতো মোমের জাদুঘর।
পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটন আকর্ষণ নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের একদম লাগোয়া এই জাদুঘর। ২০০০ সালে পাঁচতলা জুড়ে জাদুঘরটি যাত্রা শুরু করে প্রায় দুইশ মোমের মূর্তি নিয়ে।
এরপর দিনে দিনে নিউ ইয়র্ক ঘুরতে আসা পর্যটকদের প্রিয় একটি জায়গায় পরিণত হয়েছে এটি। সরকারি বন্ধ কিংবা বড় দুর্যোগ ছাড়া সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলাই থাকে।
পৃথিবী খ্যাত জাদুঘরগুলোর কথা বলতে গেলে মাদাম তুসোর নাম চলে আসবেই। আগেই বলেছি, এটিকে আসলে মোমের দুনিয়াই বলা চলে। খ্যাতিমানদের মোমের মূর্তি তৈরি করে এখানে রেখে দেওয়া হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত শহরে আছে এই জাদুঘর। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে চারটি শাখা। নিউ ইয়র্ক ছাড়া জাদুঘরটি রয়েছে হলিউড,লাসভেগাস আর ওয়াশিংটন ডিসিতে। তবে জাদুঘরটির জন্মস্থান অবশ্য যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহর। এছাড়া ইউরোপের আমস্টারডাম, বার্লিন,ব্লাকপোল এবং ভিয়েনাতে আছে জাদুঘরটি।
এক কথায় এই জাদুঘর যেন রূপকথার রাজ্য। শুরু থেকেই বিস্ময় ছড়ানো! সুদৃশ্য রাজকীয় সিঁড়ি পেরিয়ে যখন বড় একটি হল ঘরে ঢুকলাম, বিভিন্ন অঙ্গণের বিখ্যাত ও আলোচিত অনেক মানুষ স্বাগত জানালো আমাদেরকে। তাদের প্রত্যেককে তৈরি করা হয়েছে মোম দিয়ে।
অতীত হয়ে যাওয়া, কিংবা বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান মানুষদের অবিকল মূর্তি তৈরি করে রাখা আছে জাদুঘরে। কেবল যে ইতিবাচক অর্থে বিখ্যাত তাই নয়, ইতিহাসে নানা কারণে সমালোচিত কিংবা কুখ্যাত হয়ে থাকা মানুষেরও জায়গা হয়েছে এখানে। রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্রনায়ক, লেখক, সাহিত্যিক, সঙ্গীত কিংবা খেলার জগতের তারকা, রূপালী পর্দার নায়ক থেকে শুরু করে ধর্মীয় নেতা সবাই আছেন এখানে।
শুরুর বড় হল ঘরটায় বসে আছেন স্টাইল আইকন অ্যানা উইনটোর। তার সাথে ছবি তুললাম। বিশ্ববিখ্যাত ভোগ ম্যাগাজিনের এডিটর ইন চিফ ছিলেন তিনি। ছবি তুললাম জেনিফার লোপেজের সাথেও।
জেমস বন্ড খ্যাত ডেনিয়েল ক্রেগ যেন আমাদের স্বাগত জানাতেই দাঁড়িয়ে আছেন। আলবার্ট আইনস্টাইনের পাশে ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’ উপন্যাসের স্রষ্টা আর্নেস্ট হেমিংয়ের দেখা পেয়ে গেলাম। সেখানে তার লাইব্রেরির চেয়ারে বসে অন্য অনুভূতি হলো।
পরের কক্ষে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সহাস্যে দাঁড়িয়ে, পাশে ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। বিল আর হিলারি ক্লিনটন দাঁড়িয়ে আছেন পাশাপাশি। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কদের অনেকেই আছেন। আছেন ক্ষমতাধর বৃটেনের রাণী এলিজাবেথ। সদ্য প্রয়াত কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ট্রোকে ঘিরেও মানুষের আগ্রহ দেখলাম।
এরপর কিছুদূর এগুতেই সুপার হিরোরা আমার মেয়েকে স্বাগত জানালো। মন ভরে উপভোগ করলাম ফোর ডি এনিমেটেড চলচ্চিত্র। দেখলাম কিভাবে সুপার হিরো হাল্ক, স্পাইডারম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকার মতো তারকারা দুষ্টু নিধন করে। এমনভাবে থিয়েটার হলটি তৈরি যেন আমরা ঘটনাস্থলেই উপস্থিত। পুড়ে যাওয়া কোন কিছুর ধোঁয়ার গন্ধ যেমন নাকে লাগছে, তেমনি পানির ঝাপটা এসেও ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেশ ভালো লাগলো।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, জাদুঘরে সংরক্ষিত মোমের মূর্তিগুলোর মাথায় প্রতিটি চুল আলাদাভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। কেবল একটি মূর্তির মাথাতেই চুল প্রতিস্থাপন করতে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ লেগে যায়। প্রতিটি মোমের মূর্তি বানাতে প্রায় আড়াইশ বার ওই ব্যক্তির শরীরের মাপ নিতে হয়। বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি তুলতে হয় প্রায় ১৮০টি। যদি ওই ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকেন,তাহলে জাদুঘরের স্টুডিও ভাস্কর তার কয়েক’শ ছবি বা ভিডিও খুব নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করেন।
মোম ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। তাই মোমের মূর্তি সেলিব্রেটির শরীর থেকে প্রায় দুই শতাংশ বড় করে বানানো হয়। লাল সিল্কের সুতা দিয়ে মূর্তিগুলোর অক্ষিগোলকের শিরা তৈরি করা হয়। আর প্রতিটি মূর্তি বানাতে খরচ হয় প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার।
প্রতিদিন যখন জাদুঘর খোলার সময় হয়, তার আগেই দুটি রক্ষণাবেক্ষণ দল মূর্তিগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখে। পরিপাটি করে সাজিয়ে তোলে। পরিচর্যার অংশ হিসেবে প্রায় নিয়মিতই মূর্তিগুলোর চুল ধোয়া ও মেকআপ করানো হয়।
জোসেফ গ্রোশোল্জ ছিলেন তাঁর বাবা। তিনি 'সাত বছরের যুদ্ধে'মারা যাবার ঠিক দু’মাস আগে মেরি তুসো জন্ম নেন। এরপর তার মা অ্যানি মেরি ওয়াল্দার সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে চলে যান। সেখানে ডা. ফিলিপ কার্টিয়াস নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ নেন তিনি।
চিকিৎসক ফিলিপ কার্টিয়াস ছিলেন মোমের ভাস্কর্য তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ। তুসো তাঁকে চাচা বলে ডাকতেন। সেই ডা. ফিলিপই তুসোকে মোমের ভাস্কর্য তৈরির যাবতীয় কলা-কৌশল শেখান।
১৭৭৭ সালে তুসো তাঁর প্রথম মোমের তৈরি ভাস্কর্যের জন্য ভলতেয়ারকে বেছে নেন। এছাড়া তখনকার অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে তিনি জঁ জাক রুশো এবং বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ভাস্কর্যও তৈরি করেন। ফরাসী বিপ্লবের সময় তিনি মূর্তির মাধ্যমে অনেকগুলো ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছিলেন।
সেই সময় গিলোটিনে নির্মমভাবে নিহতদের মুখোশ নির্মাণ শুরু করেন তুসো। ফরাসী বিপ্লবে নিহত ষোড়শ লুই,মেরি এন্টোনিটে,জিন পল মারাত এবং রোবসপিয়ের মতো ব্যক্তিদের মুখোশ তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর তৈরি করা মুখোশগুলো বিপ্লবের সময়ে প্যারিসের রাস্তায় পতাকা এবং শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হতো।
১৭৯৪ সালের কথা। ফিলিপ কার্টিয়াস মারা যান। তার মৃত্যুর পর তুসো যাবতীয় মোমের মূর্তির মালিক হন। মূর্তিগুলো প্রদর্শনীর জন্য পরের ৩৩ বছর ইউরোপের অনেক জায়গায় যান তিনি। ১৭৯৫ সালে তিনি ফ্রাঙ্কোস তুসোকে বিয়ে করেন। মূলত তখন তার নাম হয় মাদাম তুসো। তাদের সংসারে দুই সন্তান জোসেফ এবং ফ্রাঁসোয়া।
১৮৩১ সাল থেকে মাদাম তুসো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য লন্ডনের বেকার স্ট্রিট বাজারের উপর তলা ভাড়া নেন। এই জায়গাটি বেকার স্ট্রিটের পশ্চিম পাশে এবং ডোরসেট স্ট্রিট ও কিং স্ট্রিটের মধ্যবর্তী এলাকায় পড়েছে।
১৮৩৫ সালে লন্ডনের বেকার স্ট্রিটে অবস্থান করে তিনি একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। এই জাদুঘরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল ‘ভৌতিক কক্ষ’। এতে ফরাসী বিপ্লবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিসহ নতুন কোন খুনি ও ঘাতকদের মূর্তি রাখা হতো। দিনে দিনে এই জাদুঘরটিই হয়ে ওঠে আজকের বিখ্যাত ‘মাদাম তুসো’ জাদুঘর।
মাদাম তুসো ঘুমন্ত অবস্থায় ১৮৫০ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনে মারা যান। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। কালজয়ী এই নারীর স্মারক চিহ্ন ও তিল তিল করে গড়ে তোলা মাদাম তুসো জাদুঘরটি আজো হাজারো মানুষের প্রিয় গন্তব্যস্থল।
লেখক:ইয়োগা আর্টিস্ট, লেখক ও উপস্থাপক।
ইমেইল:[email protected]