যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৃতির প্রত্যেকটি পরিবর্তন খুব তীব্রভাবে চোখে পড়ে। যখন প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে পা রেখেছিলাম, তখন প্রচণ্ড শীত। সেই শীতে গাছগুলো পত্রশুন্য, এক একটি কঙ্কাল যেন ! মনের ভেতর এক ধরনের হাহাকার তোলে।
Published : 29 Oct 2016, 08:03 PM
বসন্তের আগমনে হঠাৎ করেই চোখে পড়লো, কঙ্কালসার গাছে সবুজের কুঁড়ি। দেখতে দেখতে স্বগর্বে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। গাছগুলো ভরে উঠতে শুরু করে সবুজ পাতায়।
গ্রীষ্মের আগমনে একেবারে ভিন্ন এক রূপ। সেই মরা গাছগুলোই জীবন্ত হয়ে ওঠে, পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়। যেদিকে তাকাই সবুজ আর সবুজ। গাছে গাছে নানান রঙের ফুল-ফল।
প্রকৃতি নিজেকে সাজানোর উৎসবে মেতে ওঠে। আর এসব পরিবর্তন একেবারে খুব দ্রুত ঘটে। যেমন হঠাৎ একদিন দেখতে পেলাম, গাছের পাতাগুলো রঙ বদলাচ্ছে। দিন কয়েক পরে পাতা ঝরে পড়তে শুরু করেছে। অর্থাৎ ফল সিজন এসে গেছে।
বাংলাদেশকে বলা হয় ষড়ঋতুর দেশ। কারণ ছয়টি ঋতু দিয়ে সাজানো সবুজ-শ্যামলা দেশটির প্রকৃতি। তবে বেশিরভাগ দেশে কিন্তু ঋতু চারটি। বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে।
ব্রিটিশ রীতি অনুযায়ী ঋতুগুলো হচ্ছে স্প্রিং,সামার,অটাম এবং উইন্টার। তবে যুক্তরাষ্ট্রে অটামকে বলা হয় ফল।
অগাস্ট মাসে সামারের নানা আয়োজন থাকে। এরপর শুরু হয় পাতা ঝরার দিন। ফল সিজন। গাছে গাছে আগুন লাগে। একেক গাছে একেক রঙ। রঙিনের উৎসবে হলুদের প্রাধান্য বেশি। সবুজ পাতারা হলুদ বর্ণ ধারণ করে একে একে ঝরে পড়ে। রাস্তা, মাঠ, পার্কে বিছিয়ে থাকে শুকনো পাতা।
পায়ে পায়ে মাড়িয়ে গেলে মর্মর ধ্বনি ওঠে। গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ার দৃশ্য বিষণ্ন করলেও এক ধরনের মায়ায় ডুবিয়ে দেয়। নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে। ফল সিজনের পরে উইন্টারের আগমন। কখনো আকাশে মেঘের ঘনঘটা, কখনো প্রচণ্ড শীতল বাতাস গায়ে কাঁপুনি ধরায়, আবার কখনো রৌদ্রের হাসি। এরপর এই সময়টা টেনে নিয়ে যায় শীতে। শুরু হয় তুষার উৎসব।
প্রকৃতি আমার ভালো লাগে। আর তাই প্রকৃতির প্রত্যেকটি পরিবর্তন নিজের মতো করে উপভোগ করি আমি। সেই পরিবর্তন এবং আবহাওয়ার আচরণের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা সাজাই। নিজেকে মানিয়ে নেই, উপভোগ করি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যেক ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন উৎসব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এসব কিছুই পরিকল্পনা করা হয় আবহাওয়ার আচরণের উপর। এই বিষয়টি আমার খুব ভালো লাগে। আনন্দ দেয়। কেননা আমার ভাবনার সাথে মিলে যায়।
সামারের বিদায় ঘণ্টা যখন বাজছিল, তখন থেকেই ফল সিজনকে ঘিরে আমার প্রস্তুতির শুরু । বিশেষ করে ঝরা পাতার গান কান পেতে শুনবো বলে।
আমার বাসার আশপাশের গাছে হলুদ রঙ লেগেছে। ঝরে পড়তে শুরু করেছে পাতারা। প্রত্যেকটি পার্কে গাছগুলো রূপ বদলাচ্ছে। অদ্ভূত এক অনুভূতি হয়। লাল-মেরুন-হলুদ-সবুজের বিভিন্ন শেড। গাছের নিচে বাদামি ঝরা পাতা। কাঠবিড়ালিদের উৎসব। নির্ভয়ে দুই পায়ে মানুষের মতো দাঁড়িয়ে খেয়ে নিচ্ছে নিজেদের খাবার। পাখিগুলো উড়ে যায় নিজেদের মতো করে। তাদেরকে বিষণ্ন মনে হয়।
তবে যখন ভেবেছি কিছুদিন পর গাছগুলো একেবারে পত্রশুন্য হয়ে যাবে, দেখা যাবে এক একটি কঙ্কাল, তখন অবশ্য মায়া লাগবে। তবে যে ঋতুর যে বৈশিষ্ট্য, তাতো ঘটবেই। এ নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই। প্রতিটি সময়ই প্রকৃতির। প্রতিটি সময় প্রকৃতি তার মতো করেই সাজায়। পেন্সিলভেনিয়া যাত্রাটি খুব ভালো লেগেছে,প্রকৃতির রূপ বদল উপভোগ করতে পারায়।
কেবল তাই নয়। যখনই রাস্তায় নামি, আমি ঝরা পাতার গান শুনি। আমার ভালো লাগে। সেই গানটির মতো,
"ও ঝরা পাতা ও ঝরা পাতাগো,
তোমার সাথে আমার রাত পোহানো কথাগো
তোমার সাথে আমার দিন কাটানো কথা।"
কবি আবুল হাসানের এই কবিতা ও জলের গান যেন আমার কথাই বলেছে। ঝিরঝিরে বাতাসে আমি পাতাদের কবিতা শুনি। ঝরা পাতার কাব্য মনে দোলা দেয়। আমি পরের সময়টার জন্য অপেক্ষা করি। আসছে হাড় কাঁপানো শীত।
লেখক: ইয়োগা আর্টিস্ট, লেখক এবং উপস্থাপক।
এই লেখকের আরও পড়ুন: