ইউক্রেইনে আগ্রাসনের পাল্টায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ বা সীমিত করার যে ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিয়েছে, তাতে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় কতটা প্রভাব পড়বে, সেই প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।
Published : 10 Mar 2022, 08:08 AM
রাশিয়ার তেলের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা দিলে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল মস্কো। তারপর মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের ওই পদক্ষেপ আসে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়া থেকে তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন। যুক্তরাজ্য এ বছরের মধ্যেই রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভরতা ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি দুই তৃতীয়াংশ কমানোর কথা বলেছে।
এর জবাবে রাশিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক হুঁশিয়ার করেছেন, রুশ তেলের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ বিশ্ববাজারের জন্য একটি বিপর্যয় ডেকে আনবে।
জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম ইতোমধ্যে অনেকটা বেড়েছে। এখন রাশিয়া যদি সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দেয়, তাতে আরেক দপা দাম বাড়বে।
বিষয়টা শুধু জ্বালানির দামে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিশ্বজুড়ে ভোগ্যপণ্যের দরে সেই ধাক্কা লাগবে, প্রভাব পড়বে মানুষের জীবন মানে।
সেই প্রভাব আসলে কতটা ব্যাপক হবে, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
কী পরিমাণ তেল রপ্তানি করে রাশিয়া?
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া।
প্রতিদিন প্রায় ৫ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে দেশটি, যার অর্ধেকের বেশি যায় ইউরোপে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেলের ওপর কম নির্ভরশীল। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি তেলের ৩ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে।
গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন খুব বেশি নেই। ফলে গ্যাসের চেয়ে তেলের বিকল্প উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়া উচিত বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বেন ম্যাকউইলিয়ামস।
তিনি বলছেন, রাশিয়া থেকে বেশ ভালো পরিমাণে তেল আসে ঠিক, তবে অন্য উৎস থেকেও প্রচুর চালান পাওয়া সম্ভব।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়াতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তেলের দাম কমানোর জন্য উৎপাদন বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র এর আগে যে অনুরোধ করেছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি আরব।
ওপেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশ। আন্তর্জাতিকভাবে অপরিশোধিত তেলের প্রায় ৬০ শতাংশের যোগান আসে ওপেক থেকে। ফলে তেলের দামের ক্ষেত্রে ওপেকের বড় ভূমিকা রয়েছে।
রাশিয়া ওপেকভুক্ত নয়, তবে উৎপাদকদের আয় নিয়ন্ত্রণে তেলের উৎপাদন সীমিতকরণে ২০১৭ সাল থেকে ওপেকের সঙ্গে কাজ করছে।
ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের কথাও ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ভেনেজুয়েলা এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান তেল সরবরাহকারী ছিল। কিন্তু এখন ভেনেজুয়েলার তেল সবচেয়ে বেশি যায় চীনে।
গ্যাস বন্ধ হলে দাম বাড়বে, ইতোমধ্যে যা অনেক বেড়েছে; সরবরাহ বন্ধ হলে আরও বাড়বে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানি করা প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৪০ শতাংশ দেয় রাশিয়া। পাইপ লাইনে সরবরাহ বন্ধ হলে ইতালি এবং জার্মানি সবচেয়ে বেশি ভুগবে।
এ অবস্থায় কাতার, আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়ার মতো গ্যাস রপ্তানিকারকদের কাছে যেতে পারে ইউরোপ, তবে দ্রুত উৎপাদন বাড়ানো এসব দেশের পক্ষে কঠিন।
যুক্তরাজ্যের গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৫ শতাংশের যোগান দেয় রাশিয়া। তবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার গ্যাস আমদানি করে না।
তবে সরবরাহে ঘাটতির কারণে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম এখনও বেশ চড়া।
এক কথায় বলা যায়- বিকল্প পাওয়া সহজ হবে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বেন ম্যাকউইলিয়ামস বলেন, ইউরোপের জন্য রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প পাওয়া কঠিন, কারণ বড় বড় যে পাইপ এখন ইউরোপে গ্যাস দিচ্ছে, সেগুলো রাশিয়া থেকেই এসেছে।
জ্বালানি বিষয়ক ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা ব্রুগেল বলছে, রাশিয়া যদি পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়াতে পারে। পাশাপাশি জ্বালানির অন্যান্য উৎসগুলো থেকেও উৎপাদন বাড়াতে পারে। তবে খুব অল্প সময়ে এর কোনোটাই করা সম্ভব না।
বিশ্লেষক সিমোন ট্যাগলিয়াপিত্রা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির নতুন কোনো প্রকল্প শুরু করতে প্রচুর সময় লাগে, ফলে স্বল্প সময়ের সমাধান এটা হবে না।
ফলে আগামী শীতের জন্য অন্য কোনো জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে হবে পারে ইউরোপকে। যেমন জরুরি পরিস্থিতিতে ইতালি ও জার্মানি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র খুলতে পারে, সেরকম পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ইউরোপের নির্ভরতা কমিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে ইইউ। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহে বৈচিত্র্য আনা এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা করা।
ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে জ্বালানি ও বিদ্যুতের বিল বাবদ অতিরিক্তি অর্থ গুনতে হবে ভোক্তাদের।
যুক্তরাজ্যে গৃহস্থলীর বিদ্যুৎ বিল যাতে লাগামছাড়া না হয়ে যায়, সেজন্য ‘প্রাইস ক্যাপ’ দেওয়া আছে এখন। আগামী এপ্রিলে এই ‘প্রাইস ক্যাপের’ সীমা বাড়ানো হলে বিল ৭০০ পাউন্ড বেড়ে ২ হাজার পাউন্ডে উঠতে পারে। আসছে শরতে আবার তা বাড়ানো হলে সেটা ৩ হাজার পাউন্ড হতে পারে।
বিবিসি লিখেছে, যুক্তরাজ্যে পেট্রোল ও ডিজেলের দামও বেড়েছে। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে এক লিটার পেট্রোল ১৭৫ পেনি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালের পর পেট্রোলের দাম এখন সর্বোচ্চ। আমেরিকান অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, গত এক সপ্তাহে পাম্পগুলোতে পেট্রোলের দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে।
ম্যাকউইলিয়ামস বলেন, “আমি মনে করি, রাশিয়ান তেল-গ্যাস বন্ধ রয়েছে এমন একটি পৃথিবীতে যদি থাকি, তাহলে আমাদের ব্যবহার কমানোর পথে যেতে হবে।
“এখন, প্রশ্ন হল, আমরা কি মানুষকে বলতে পারব যে তোমরা তোমাদের ঘরের থার্মোস্ট্যাট এক ডিগ্রি কমিয়ে রাখ, যাতে গ্যাস খরচ বাঁচে?”