করোনাভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস আগের চেয়ে ‘নড়বড়ে’ হয়ে গেছে বলে এক জরিপে উঠে এসেছে।
Published : 02 May 2021, 07:09 PM
গত মাসে সানেম পরিচালিত এই জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, মহামারীর মধ্যে ব্যবসা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশে নেমে এসেছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকে এই হার ছিল ৫৮ শতাংশ।
‘কোভিড-১৯ অ্যান্ড বিজনেস কনফিডেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই জরিপের তথ্য রোববার এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান।
রোববার ভাচুর্য়াল মাধ্যমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ধারাবাহিক এই জরিপের চতুর্থ পর্বের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা আবাসিক কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান।
মূল প্রবন্ধে সেলিম রায়হান বলেন, গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রথমবারের মতো দেশের ব্যবসা পরিস্থিতি জানার জন্য এই জরিপ পরিচালনা শুরু করা হয়।
সর্বশেষ জরিপটি গত মাসে পরিচালনা করা হয়। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের পরিস্থিতি জানতে সারাদেশের পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ীদের ওপর পরিচালিত এই জরিপে দেখা যায়, এই সময়ে ব্যবসা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
সেলিম রায়হান বলেন, মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাসে আগের চেয়ে ‘চোট’ তৈরি করেছে। আগের আত্মবিশ্বাসীদের অনেকের মনোবল নড়বড়ে হয়ে গেছে করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।
জরিপকালে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ কিংবা বিনিয়োগ সম্প্রসারণে অর্থলগ্নীতেও বেশিরভাগ আস্থা পাচ্ছেন না।
অথচ আগের প্রান্তিকগুলোর জরিপে মহামারীর প্রথম ধাক্কা সামলে তারা এখনকার চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার কথা জানিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় ঢেউয়ে মার্চ ও এপ্রিলে দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
সানেম গত বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক থেকে পোশাক, বস্ত্র, চামড়া, ওষুধ, খাদ্য এবং হালকা প্রকৌশলসহ আরো বেশ কয়েকটি খাতের ৫০০ এর বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের ওপর এই জরিপ পরিচালনা করছে।
সেলিম রায়হান বলেন, প্রথম জরিপে ‘বর্তমানে ব্যবসা পরিস্থিতি কেমন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে ৫১ দশমিক ০৬ শতাংশ উত্তরদাতা কোভিড পরিস্থিতিতেও ব্যবসা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকার কথা জানিয়েছিলেন।
এরপর গত বছরের অক্টোবর- ডিসেম্বর প্রান্তিকে দ্বিতীয় জরিপে ওই আত্মবিশ্বাস বেড়ে ৫৫ দশমিক ২৪ শতাংশে উন্নীত হয়।
এই বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রথম প্রান্তিকের জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৫৮ শতাংশ ব্যবসায়ী আত্মবিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেন।
জরিপের তুলনামূলক বিচারে দেখা যায়, আগের প্রান্তিকগুলোর তুলনায় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে কম সংখ্যক ব্যবসায়ী আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে পেরেছেন।
জরিপে যেসব প্রশ্ন করা হয় তার মধ্যে রয়েছে, মহামারীকালে কেমন চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো; সরকার ঘোষিত সোয়া লাখ কোটি টাকার ওপরে প্রণোদনা কী পেলেন বিনিয়োগকারীরা; সেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কত পেল; ব্যবসা শুরুর ব্যয় কমেছে কিনা।
জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে সানেম বলছে, করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কা সামলাতে পারলেও দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সক্ষমতা নেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর।
এর কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এখনো গড়ে ৭০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান সরকার ঘোষিত প্রণোদনার বাইরে। এ অবস্থায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
জরিপের তথ্য তুলে ধরে সানেম বলেছে, প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে নিলেও দ্বিতীয় ধাক্কা সামলাতে পিছিয়ে পড়বে দেশের বহু প্রতিষ্ঠান।
জরিপের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুফল পেয়েছে বৃহৎ শিল্পের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ছোট শিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠানই সঠিকভাবে অর্থ পায়নি। এর বড় কারণ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার কথা তুলে ধরে ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, “কোনো ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার টার্গেট থাকলে, সেই ঋণ যদি একজনকে দিয়ে দেয় তাহলে টার্গেট পূরণ হয়; কিন্তু অন্তর্ভূক্তিমূলক হয় না।”
তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নে প্রণোদনার অর্থ যোগান দেওয়ার আহবান জানান। এ জন্য সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মহামারী মোকাবিলার উপযোগী করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
একইসঙ্গে মহামারী প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সকলকে বাধ্য করতে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহবান জানান তিনি।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বড় বলে তারা সবার ‘কণ্ঠস্বর’ও হয়ে উঠে। তাই সরকারি প্রণোদনা বণ্টনের সময় কণ্ঠস্বর হিসেবে তারাই বেশি সুবিধা পেয়েছে।“
এখনো ৪১ শতাংশ ব্যবসায়ীর আত্মবিশ্বাস অবশিষ্ট থাকার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, অতি আত্মবিশ্বাস বিপদ ডেকে আনতে পারে। তার মতে, ভারতের এমন বিপর্যন্ত অবস্থা অতি আত্মবিশ্বাসের কারণেই।