বাজেটের আকার বড় হওয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা এসেছে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের কাছ থেকে।
Published : 01 Jun 2017, 11:19 PM
আগামী বছর আমাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বা মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কাটা রয়েই গেল, বাজেটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।
ব্যাপক আলোচনা থাকলেও অনেক পণ্য ছাড় পাওয়ায় ভ্যাটের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ টাকার বেশি থাকলে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার সমালোচনা করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এই ব্যয় মেটাতে নতুন অর্থবছরে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছেন তিনি। এর মধ্যে কর হিসেবে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা আদায় করা হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে; আর তার ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ, অর্থাৎ ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব আসবে আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে।
সংসদে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরপরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সিপিডির সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, “আমাদের মূল বক্তব্য ছিল, এবারের বাজেট যেন মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়কে না বাড়িয়ে দেয়, কমাতে যদিও না পারে।
“বাংলাদেশের কৃষিখাতে, শিল্পখাতে উৎপাদন খরচ যেন না বাড়িয়ে দেয়, যদিও কমাতে না পারে। আমাদের মনে হয়েছে, এই বাজেটে এই দুটির কোনোটি রক্ষিত হয়নি।”
ব্যাংক খাত এবং বিমানের টিকেটের উপর আবগারি শুল্কের বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, যারা করের আওতার রয়েছেন, সেখান থেকে আহরণের চিন্তা অনেক বেশি হয়েছে।
“যারা বেআইনিভাবে টাকা উপার্জন করল, যারা দেশের থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেল, যারা এখনও করের আওতার ভেতরে নেই বা যারা অনেক কম ট্যাক্স দেয়- তাদেরকে ধরার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ বা উদ্ভাবনী কৌশল আমরা দেখলাম না।”
পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ টাকার বেশি থাকলে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেছেন, “এটা একদমই নীতিবহির্ভূত। আমরা আর্থিক খাতের বিস্তৃতি বাড়াতে চাচ্ছি। এই সিদ্ধান্ত সেই লক্ষ্যের পরিপন্থি হচ্ছে।”
ভ্যাটের ক্ষেত্রে টার্নওভার সীমা ৮০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে দেড় কোটি টাকা করার সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, “এটা ঠিক হয়নি। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এই সীমা অনেক কম।”
দেবপ্রিয় বলেন, “ভ্যাট আইন চালু করার পর আমরা মনে করেছিলাম, সম্পূরক শুল্ক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কের ক্ষেত্রে আরও কিছু সমন্বয় হবে, যাতে ভ্যাটের পুরো চাপটা জনগণের উপর আসবে না। আমাদের আশানুরূপ সমন্বয় হয়নি বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।”
নতুন ভ্যাট আইন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে কি না- এই প্রশ্নে জায়েদ বখত বলেন, ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ রাখা হলেও ছোট ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভ্যাট অব্যাহতির সীমা (টার্ণওভার) ৩০ লাখ থেকে ৩৬ লাখ টাকা বৃদ্ধি, ভোজ্যতেলসহ কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাটভুক্ত তালিকায় আনাসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দে্রওয়া হয়েছে।
“এ সবের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তকে রিলিফ দেওয়া হয়েছে। ভ্যাটের কারণে বাজারে জিনিসপত্রের দাম খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না।”
অর্থমন্ত্রীর এই বাজেট ২০০৯-১০ অর্থবছরে আওয়ামী লীগের বিগত মেয়াদের প্রথম বাজেটের তুলনায় তিন লাখ কোটি টাকার বেশি।
সেই বাজেটের আকার ছিল ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ১ লাখ কোটির নিচ থেকে বাজেটের আকার এখন ৪ লাখ কোটির টাকারও বেশি।
এই সময়ের ধারাবাহিকতায় বাজেটের আকার বৃদ্ধিকে স্বাভাবিকই দেখছেন পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।
তিনি বলেন, “আমাকে অনেকে সবাই জিজ্ঞেস করছে, এত বড় বাজেট কেন? এটা কি রাজনৈতিক বাজেট কি-না?
“আমাদের অর্থনীতি বাড়ছে, আমাদের চাহিদা বাড়ছে। অর্থনীতি বড় হলে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো লাগে, অর্থনৈতিক কাঠামোর চাহিদা বাড়ছে। সুতরাং বাজেট তো বড় রাখাই ভাল, আকাঙ্ক্ষা বড় রাখাই ভালো। এটাকে খুব উচ্চাভিলাষী কিছু আমি মনে করি না।”
তার মতোই মত দেন আহসান মনসুর ও জায়েদ বখত।
আকার বড়র চেয়ে বাস্তবায়নের উপরই বেশি জোর দিচ্ছেন খলীকুজ্জমান।
“কার্যকর বাস্তবায়ন যেন যথাসময়ে হয়, সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে। আশা বাড়ালাম, কিন্তু তার পক্ষে কাজ করলাম না, তাহলে তো আর আগানো যাবে না। বাস্তবায়ন একেবারে শুরুর দিক থেকে করতে হবে, সারা বছর বসে থেকে বছরের শেষে এসে হুড়মুড় করে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করলাম, সেটা যেন না হয়।”
৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার নির্ধারণের কথা বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত; মন্ত্রীর সঙ্গে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একইসুরে কথা বললেও এর পাশাপাশি বিনিয়োগের অবকাঠামো উন্নয়নের পরামর্শ এসেছে খলীকুজ্জমানের কাছ থেকে।
জায়েদ বখত বলেন, “আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন বড় বাজেটের প্রয়োজন আছে। কেননা, বিনিয়োগে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে তা কাটানোর জন্য অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করার জন্যই বড় বাজেট প্রয়োজন।”
বড় বাজেটে রাজস্ব আদায় করাকে চ্যালেঞ্জ মনে করেছেন তিনি।
“এবারের বাজেটের মেইন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। বিশেষ করে ভ্যাট থেকে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি যেটা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে, সেটা পূরণ করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।”
জায়েদ বখত বলেন, “এবার বছরের শুরু থেকেই লক্ষ্য পূরণে উদ্যমী হতে হবে এনবিআরকে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাজস্ব আদায়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।”
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে করের পরিমাণে ৩৪ শতাংশ বাড়ানোর সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, “৩৪ শতাংশ কর এক বছরে... তিন ভাগের একভাগ বাড়ানো.. এটা সহজ ব্যাপার না।
“এটার জন্য যে ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন, নীতি সংস্কার এবং অন্যান্য সক্ষমতার পরিস্থিতির বিচার-বিবেচনায় এটা আমাদের কাছে এটা অনেক বেশি অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে বাস্তবতার সাথে।”
সরকারি ব্যয় বরাদ্দে প্রায় ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সমালোচনা করছে সিপিডি, অর্থায়ন করতে পারার পরিকল্পনার বিপরীতে সরকার পরিসংখ্যানের ফাঁদে পড়ে গেছে বলে মনে করছে তারা।
দেবপ্রিয় বলেন, “মোট যে সরকারি ব্যয় প্রায় ২৬ শতাংশ বাড়বে। মানে পুরো সরকারের ব্যয় চার ভাগের একভাগ বেড়ে যাবে ১২ মাসের ভেতরে। অথচ, আমরা গত পাঁচ বছরের হিসাব যদি আপনারা নেন তাহলে সেখানে কোন বছরই গড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি আমরা লক্ষ্য করিনি। সেই ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি কীভাবে ২৬ শতাংশে যাবে, এটার কোন সেই ধরনের বাস্তবতা বা কর্মপরিকল্পনা আমাদের সামনে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিভাত হয়নি।”
উন্নয়ন পরিকল্পনায় আরও বেশি রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মতভাবে, সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা নিয়ে, স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে।
বৈদেশিক সহায়তার ব্যবহার বাড়ানোর উচ্চ লক্ষ্যমাত্রাও বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন সিপিডির ফেলো।
বাজেট প্রণয়ন এবং প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর উপস্থাপিত আটটি অনুমানের মধ্যে তিন-চারটি ‘বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়’ বলেও মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়।
“যেমন তিনি মনে করছেন যে, রেমিটেন্স খুব ভালো থাকবে, আগের মতোই ভালো থাকবে। কিন্তু আমরা জানি, গত দুই-তিন বছর ধরে রেমিটেন্স আসা নেতিবাচক হয়ে গেছে তার লক্ষ্যমাত্রা থেকে।”