Published : 19 Jun 2016, 01:11 AM
ভারতীয় পুলিশ সম্পর্কে এখানকার চলচ্চিত্রে বাড়াবাড়ি হতো বলেই ধারণা ছিলো। মনে হতো ওখানকার পুলিশ কর্মকর্তারা সব 'ফেরেশতা'; অ্যাকশন ধরে রাখতে পুলিশের ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম তুলে ধরা হয় সিনেমায়। সাম্প্রতিক ভারত সফরকালে এক সন্ধ্যা মিটিয়ে দেয় আমার সব কৌতূহল।
ছোটভাই রবি হোসাইনকে সঙ্গে নিয়ে এক বিকেলে ঘুরতে যাই হাওড়া ব্রিজ এলাকায়। হুগলি নদীর পারে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের সৌন্দর্য উপভোগ করি দুজনে। লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে দুজন অনেকক্ষণ দেখলাম আশ্চর্যের ব্রিজটি। সেই ১৯৯২ সাল থেকে ঝুলে আছে ভারতের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু। এরপর ঘুরে দেখি পাশের হাওড়া রেলস্টেশন। সন্ধ্যা নামতেই ব্রিজে আলো জ্বললো। দুজনে হেঁটে এপার থেকে ওপারে যেতে থাকি।
ব্রিজের ওপর দ্রুত যানবাহন চলার দৃশ্যটা মোবাইলে ধারণ করি। মাত্র দুবার ক্লিক করলাম। হুট করে ডান পাশ থেকে একজন এসে মোবাইলটি ছোঁ মেরে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে! তাকিয়ে দেখি তিনি পুলিশ। ধমক দিয়ে বললেন, 'ব্রিজে ছবি তোলা নিষেধ জানেন না?'
আমি হতভম্ব। সরি বললাম। তাতেও কাজ হয় না। নিয়ে গেলেন পুলিশ বক্সে। সঙ্গে সঙ্গেই কেউ একজনকে ফোনে নালিশ। বললেন, 'একটু পর রাষ্ট্রপতি আসবে এদিক দিয়ে। আর আপনি এখন ছবি তুললেন!'
তার কথা শুনে মনে হলো, আমার ছবি তোমায় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ভেঙে গেলো! অথচ সেটাও ফাও কথা। ভয় হচ্ছে। নিজের ওপর রাগও হচ্ছে। কেন যে ক্যামেরায় ক্লিক মারতে গেলাম! পুলিশের ফাঁদে পড়া মানেই তো বড় যন্ত্রণা। ভারতীয় সিনেমায় এদের চরিত্র ভাবতেই শিউরে উঠি। অনেক অনুনয়ও কাজে আসে না।
মোবাইল পকেটে পুরে পুলিশ সদস্য বললেন, 'আপনার ফাইন (জরিমানা) হয়েছে। থানায় যেতে হবে। এখন কী করবেন করুন।' আমার বুঝতে বাকি রইলো না তিনি কী বোঝাতে চাইছেন। সেরকম জবাবও দিতে পারছি না; যদি পাসপোর্ট জব্দ করে! একপর্যায়ে কিছু ভাংতি টাকা তাকে ধরিয়ে দিতে চাইলাম। নিলেন না। রেগে আগুন। ভাবলাম, টাকা দিতে গিয়ে আবার ঘুষ প্রদানের দণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছি না তো? ভারতীয় পুলিশ কী আর বাংলাদেশিদের মতো!
তিনি জানালেন, ব্রিজে ছবি তোলার দণ্ড ৫০০ টাকা।
নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো। পাশে রবি, তবু ভীষণ একা মনে হচ্ছে। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। উপায়ান্তর না দেখে তাকে বলি, জরিমানা দিব। কিন্তু মানি রিসিপ্ট চাই। না। তাতে তিনি আরো উত্তেজিত। এবার বললেন, 'থানায় চলুন।' আমি তাতে সায় দিই। থানাতেই মীমাংসা হোক। তাকে বললাম, 'থানায় যেতে রাজি। মানি রিসিপ্ট দিলে হাজার টাকা জরিমানা দিতেও আমি রাজি।'
আমার একের পর এক জেরার মুখে পড়ে তিনি বারবার তার জুনিয়র অফিসারকে ডাকেন। একপর্যায়ে বললেন, 'দাঁড়ান। আমি ফোন করে জরিমানা একটু কমাতে পারি কি না দেখি।' তিনি ফোনে কী যেন একটা নাম্বার টাইপ করলেন। ডায়াল করে কানে ধরলেন।
বলতে শুরু করলেন- 'স্যার, একজন সাদা আরেকজন কালো টি-শার্ট পরিহিত। একজন ঢাকার সাংবাদিক…'
আমি ডান দিকে কাত হয়ে দেখতে চাইলাম তিনি সত্যিই কাউকে ফোন দিলেন কি না। দেখলাম তার ফোনে কোনো কলিং দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে তার ফোন বেজেও উঠলো! আমি নিশ্চিত হই যে তিনি কোথাও ফোন করেননি। সবই গলাবাজি। এবার সাহস নিয়ে পাল্টা জেরা শুরু করলাম। তার হাতে ২০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে মোবাইলটি নিলাম। ছবি দুটো তার সামনেই ডিলিট করলাম।
এবার তাকে বলি, 'আপনি কাউকে ফোন করেননি। আমরা আপনার দেশের অতিথি। অথচ নাজেহাল করলেন।' চুপ করে রইলেন। উঠে দাঁড়ালো আমার সামনে। তার বুকের বাঁ পাশটায় চাপড়ে দিয়ে বললাম- পুলিশে চাকরি করেন ভালো। এই অন্তরটা পরিশুদ্ধ করেন। এ কথা শুনে আমার চোখে চোখ রাখলেন। তাকে খুব অসহায় মনে হলো।
তাকে এবার বললাম, আমি যে ছবি তুলেছি কোনো প্রমাণ আছে?
তার উত্তর- আপনি তো ডিলেট করে দিয়েছেন।
কথা আর বাড়াতে চাইলাম না। বিদায়বেলায় এটুকুই বলি- কিছু মনে করবেন না। আমার অপরাধটা গৌণ। আপনার টাকা দরকার আমি বুঝেছি। ২০০ টাকা দিয়েছি। ভালো থাকুন। এবার আর চোখ তুলে তাকালেন না। আমার হাতটা টেনে ২০০ টাকা ফেরত দিতে চাইলেন। আমি নিতে চাইনি, অনেকটা জোর করেই টাকাটা ফিরিয়ে দিলেন।
আমার দেশের পুলিশের এই দোষ আছে। তবে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখে পড়িনি। কলকাতায় এসেই চেনা হলো পুলিশের জাত কী জিনিষ। তবে এই নাটকীয় ঘটনার শেষাংশে পুলিশকেই এমন অসহায় দেখে বেশ দরদ হলো। অথচ শুরুর ঘটনাটি মনে পড়লে ভীষণ ঘৃণা হয়। একজন বিদেশিকে ওরা এতটা নাজেহাল করতে পারে!
খাকি পরলেই পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে- এটাই নিজের চোখে দেখলাম। বাংলাদেশ ভারতের পুলিশের অভিন্ন চরিত্র দেখে সেটাই আবার মনে পড়লো- রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।
লেখক : সাংবাদিক, [email protected]