Published : 13 Feb 2016, 11:28 AM
মাত্র ষোলটি সিঁড়ি ভাঙলেই এই কক্ষে যাওয়া সম্ভব। অথচ আমাদের লেগেছিল তের দিন! সময়টা যত না দীর্ঘ, গল্পটা তার চেয়েও বেশি। এমনই এক গল্প, যার বাঁকে বাঁকে শিহরণ জাগানো শব্দমালা।
৪ আগস্ট ২০১৫। আমার প্রথম লেখায় একটি কচিপ্রাণ বাঁচানোর তাড়না। ৫০০ জন বন্ধু চাওয়াটা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু মাত্র ৫০ হাজারের চাহিদাটা মোটেও তত না। জনপ্রতি ১০০ টাকা হিসাব করেই পাশে চেয়েছিলাম এই বন্ধুদের।
বছর তিনেক আগেই ফেসবুকে আমার বন্ধু তালিকায় পাঁচ হাজারের কোটা পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অনুসারীও দেখার মতো। সব বন্ধুরা ১০ টাকা করে দিলেও আমার চাওয়াটা মিটে যায়।
ভার্চুয়াল জগতে তরতরিয়ে বন্ধু যতই বাড়ুক না কেন, বাস্তবের জমিনে তাদের সবাইকে আপনি পাশে পাবেন, এই মিথ্যে আশাটা ভুলে যান। আমিও তাই সবার দিকে চেয়ে থাকিনি। চেয়েছি মাত্র ৫০০।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমি কিন্তু পুরো ৫০০ জন পাইনি! তবে পেয়েছি চাওয়ার থেকেও বেশি কিছু। এবং সেটি খুব কম সময়েই। আর, শেষপর্যন্ত সব আলো একদিকেই মিলেছিল।
শাহাদাতের কথা ভুলে গেছেন? সাত বছরের ছোট্ট শিশুটির কথাই বলছি। যে নতুন জীবনের পথে হেঁটেছে দূর থেকে আপনিও শুদ্ধ হাতটি বাড়িয়েছিলেন বলে।
আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সালমা আপার দাঁত কেলানো হাসি। কী যে আনন্দে তাঁর চোখমুখ ভরে উঠেছিল সেদিন! অথচ তাঁর মুখটা মলিন হয়ে যেতেই পারত। তা হয়নি। মায়ের মন আনন্দে নেচেছে একপ্রাণ বাঁচাতে শতপ্রাণের তাড়না দেখে।
একজন মায়ের বুকটা শূন্য হতে দিইনি আমরা। হৃদয় দিয়ে আমরা জয় করেছি আরেকটি হৃদয়। মানবতা বুঝি এমন করেই বাঁচে।
ফুটো হৃদয় নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল শাহাদাত। চলতে চলতে সাত বছর এগোলেও ফুটো হৃদয় আর ভরে না। দিন যত যায়, শাহাদাতের গতি ততই কমে। হাসে না, খেলে না। স্কুলে যায়, অথচ সহপাঠীদের সঙ্গে দুষ্টুমিতে মাতে না! এক কোণে চুপটি করে বসে থাকে। ক্লাশের বেঞ্চে বই-খাতা-কলম নিয়ে ঠিকই বসে নিয়ম করে, অথচ মাথায় বইয়ের কিছুই ঢোকে না।
অনেক পথের বাঁক পেরিয়ে সালমা নিশ্চিত হলেন, তাঁর ছেলের হার্ট (হৃদযন্ত্র) ফুটো! হার্ট ফুটো হলে কী হয়, সেটা জানেন নাকি তিনি? জানেন না। ধারণা করেন, বাড়ির পাশের কবিরাজ বা বৈদ্যের কাছে গেলেই কাজ শেষ!
কিন্তু না। ফুটো হৃদয় যে কোনো সময় জীবনের আলো নিভিয়ে দিতে পারে! বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মুখে এমন কথা শুনে সালমার মাথায় যেন বিনামেঘে বজ্রপাত। দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ছেলে বুঝি গেল!
এই অবস্থা থেকে উতরে ওঠার কোনো স্বপ্নই তাঁর ছিল না। শাহাদাতের বাবার সামর্থ নেই। তিনি নিজেই মানসিক ও শারীরিক অসুস্থ। তাদের সংসার চলে টেনেটুনে। কোনদিন আধপেটা, কোনদিন তাও না!
সেই ঘরের ছোট্ট মানিকের জীবন সংকটে!
বলতে গেলে অনেক কথা। একান্নবর্তী সংসারে অনেক চড়াই-উতরাই বেড়ে ওঠা মানুষের গল্পের অতীতটা এমন ট্র্যাজেডিতেই লেখা থাকে। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের গল্পই এমন। কিন্তু সালমাদের মা-ছেলের সংসারটা যেন এতকিছুর মধ্যেও অন্যরকম।
শাহাদাতকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার আহ্বান ছিল খবরের কাগজে। খুব বেশি মানুষ কিন্তু এগোয়নি। 'মানুষ মানুষের জন্য'- তিন শব্দের এই শিরোনাম ছাপার অক্ষরে দেখতে দেখতে পাঠক ক্লান্ত। কিন্তু একজন মানুষ যতক্ষণ শুধুমাত্র পাঠক, তখন তার থেকে একবুক গরম নিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছু আশা করা বোকামি। আশা করবেন তাঁর কাছ থেকে, যিনি শুধু মানুষ নন, শুধু পাঠক নন; যাঁর আছে একটি শীতল মন।
৮০৬ নাম্বার কক্ষে ঢুকতে যদিও তের দিন লেগেছিল, শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত সময়টা ছিল ২২ দিনের। সেই দিনগুলি ঝরাপাতার মতোই জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু যে দাগ কেটে গেছে, সেটি কখনো মুছবে না। মুছতে পারে না।
আমার ৫০০ বন্ধু চাওয়ার আওয়াজ আপনাদের কানে বেজেছিল। আপনারা আমাকে এতটাই নাড়িয়েছিলেন, আমার স্বপ্নটা মাটি থেকে আকাশ ছুঁলো। ৫০ হাজার টাকা এক করে সালমা আপার হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছা থেকেই সেদিন ওই লেখাটা পোস্ট করেছিলাম। অথচ শেষপর্যন্ত আপনারা শাহাদাতের অপারেশন এবং পরবর্তী ওষুধ পথ্যের ব্যয়টাও বহন করেছেন।
এক ঘণ্টার মধ্যেই আমি যে পরিমাণ সাড়া পেয়েছি, তাতেই কচিপ্রাণ বেঁচে ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা লেখা ছিল। আপনাদের অনবদ্য ভালোবাসায় তেরতম দিনে শাহাদাতকে হাসপাতালের বিছানায় শোয়াতে সক্ষম হই। তার দুদিন পরই একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির কারবারে ছোট্ট শাহাদাতের শূন্য হৃদয় পূর্ণ করার দিনলিপি শুরু হয়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের নবম তলায় ৮০৬ নম্বর কক্ষে সেই সন্ধ্যায় আমি এতটাই বিমোহিত ছিলাম যে, জীবনের পথে-প্রান্তরে ওই সন্ধ্যাটা নাড়া দেবে নিশ্চিত। শাহাদাত বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে সালমা আপা বসে আছেন। ছিলেন শাহাদাতের মামা জাফর ভাই। সঙ্গে ছিল অগণিত মানুষের প্রার্থনা।
আজও কথা হলো জাফর ভাইয়ের সঙ্গে। শাহাদাত ভালো আছে। সে হাঁটে, দৌড়ায়। স্কুলে যায়, খেলাধুলা, দুষ্টুমি- সবই করে। কত ভালে লাগে; দুই রকমের শাহাদাতের গল্প বলতে পেরে। সবকিছুই হয়েছে আপনাদের কল্যাণে। আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উপযুক্ত ভাষা আমার নেই।
আপনারা শুরুর দিন থেকেই পাশে ছিলেন। আছেন এখনও। শাহাদাত ফুটো হৃদয় নিয়ে জন্মেছিল বলে নিজেকে হয়তো শাপ দিতে পারে; আমি কিন্তু তাকে ধন্যবাদের বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিব।
আমি শতভাগ নিশ্চিত- এই শিশুটি যদি ফুটো হৃদযন্ত্র নিয়ে না জন্মাত, হয়তো এরপর ৭০০ শিশু শীতে উষ্ণতা পেত না! আমরা এখন শিশুদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন আঁকি। নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তুলতে নিজেরাই পণ করি। কিন্তু সবকিছুর অন্তরালে সেই শাহাদাতই।
রুম নাম্বার ৮০৬ বহুদিন স্বপ্ন দেখাবে। স্বপ্নের পথ যতই দীর্ঘ হউক, পথের শেষটা দেখতে চাই আপনাকে পাশে রেখেই।
শাহাদাতই আমার প্রেরণা। আমার স্বপ্নের নায়ক। দ্য রিয়েল হিরো।
>> লেখক : সাংবাদিক, [email protected]