Published : 18 Jul 2015, 11:15 PM
নির্যাতিতের এক বিমূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে রাজন। তার অসহায় আর্তনাদ প্রতি মূহুর্তে মনকে বিষন্ন করে তোলে। অত্যাচারী কতটা পাষন্ড হয়ে উঠতে পারে তা এই ভিডিও আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। রাজনের উপর পৈশাচিক, বর্বর নির্যাতন ও হত্যাকান্ড নির্যাতনের একটি ভয়ংকর দিকের উন্মোচন করেছে তা হলো – শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার। হত্যাকারী নরপশুদের একটি উক্তি ছিল, "মামু কইছে ওরে ঐ কাম করি ছাড়ি দে"। এই উক্তি থেকে সহজে বোঝা যায় জানোয়ারেরা কোন বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছে। রাজনের ময়না তদন্তের রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে হত্যা করার আগে ঐ নরপশুরা রাজনকে 'বলাৎকার'ও করেছিল কিনা। অথবা বলাৎকার করার আগেই রাজনের মৃত্যু হয়েছিল বলে হয়ত সেই সুযোগ তারা পায়নি, কিন্তু তাদের মনোভাবে এই পাশবিক ইচ্ছা যে ছিল সেটা স্পষ্ট।
মানবশিশুর অসহায়ত্বের একটি প্রধান দিক হলো, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া। পশুকুলে মাতৃহীন শিশু পশুগুলোকে অন্য পশুরা খাবারে ভাগ বসাতে না দেওয়ার জন্য শিশুটিকে গুঁতো মেরে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মানবশিশুর ক্ষেত্রে চিত্রটা একেবারেই অন্যরকম, অনেক সময় খাওয়া-আশ্রয় তো দেয়ই না বরং অন্য রকম সুযোগে নেওয়ার চেষ্টা করে তা হলো যৌন অত্যাচার। জীবনের প্রথম থেকেই শিশুরা বিভিন্নভাবে বহুমাত্রিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। মানুষের বিকৃত যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করার একটি সহজ মাধ্যম হলো শিশুরা। শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার করাটাকে এই বিকৃত রুচির মানুষেরা নিরাপদ মনে করে। কারণ তারা মনে করে শিশুরা হয়ত বিষয়টাকে বোঝে না বা তারা অন্যের কাছে বলবে না, আর বললেও মানুষ তা বিশ্বাস করবে না।
শিশুরা পরিবার থেকে সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র (শিশুশ্রমের স্থানগুলো) সহ প্রায় সর্বত্রই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বিশ্বে পায় ২০% মেয়েশিশু এবং ৮% ছেলেশিশু কোন না কোন ভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আফ্রিকার পরিস্থিতি সব থেকে খারাপ, সেখানে প্রায় ৩৪% শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে, অন্যদিকে ইউরোপে প্রায় ৯% এবং আমেরিকা ও এশিয়ায় ১০ থেকে ২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই চিত্রের খুব একটা হেরফের হয় নাই। প্রতিদিন বিভিন্ন মাত্রিক যৌন সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসের বলি হচ্ছে অনেক নারী ও শিশু। যদিও মিডিয়ায় শুধুমাত্র নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আসছে, কিন্তু বিপুল সংখ্যক পথশিশু ও শ্রমজীবি শিশু (বিশেষতঃ ছেলেশিশু) যে প্রতিনিয়ত যৌন লালসার শিকার হচ্ছে তা অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবিকার সন্ধানে শহরমূখী প্রবণতা শিশুদের অনেক বেশি অনিরাপদ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাবা-মা কাজের সন্ধানে বাইরে এলে তাদের শিশুকে দেখভালের তেমন কেউ থাকে না, এই অবস্থার সুযোগ নেয় নিপীড়নকারী। আবার অন্যদিকে দারিদ্রতার কারণে অনেক শিশুকে নিজেকেই জীবিকার সন্ধান করতে শহরে আসতে হয় যাদেরকে অধিকাংশক্ষেত্রেই অনিরাপদ আশ্রয় তথা বস্তি বা পথে জীবন কাটাতে হয়। এই সকল পথশিশু বা টোকাই ও শ্রমজীবি শিশুদের জীবন সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। অশিক্ষিত এই সকল পথশিশু ও শ্রমজীবি শিশুদের এক তৃতীয়াংশের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে এবং তারা পরিবার বা বন্ধুবান্ধব ছাড়াই শহরে বিশেষতঃ ঢাকায় চলে আসে।
সমীক্ষা বলছে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুরাই সব থেকে বেশি যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে বাস করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিচিত, আত্মীয়-স্বজন, পরিবারের সদস্য বা পারিবারিক বন্ধু, শিক্ষক ও গৃহশিক্ষক বালক ও প্রাপ্ত বয়স্কদের দ্বারাই তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। কিশোর, যুবক ও মধ্য বয়সী পুরুষেরা এই সকল অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৩০% শিশু নিকট আত্মীয় যথাঃ ভাই, বাবা, কাকা-জ্যাঠা-মামা-মেসো, কাকাত-জ্যাঠাত-মামাত-পিসতুতো ভাই ইত্যাদির দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অন্যদিকে, ৬০ ভাগ শিশু তাদের পারিবারিক বন্ধু, আয়া, বা প্রতিবেশিদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয় এবং ১০ ভাগ অপরিচিতের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। যদিও অধিকাংশ নির্যাতনই পুরুষমানুষের দ্বারা ঘটে থাকে, কিন্তু প্রায় ১০% ক্ষেত্রে দেখা গেছে মহিলারাও শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনে সামিল হয়েছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা পৃথিবীর সর্বত্র সকল সমাজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তৃত।
ধর্ষণ ও বলাৎকার যৌন-নির্যাতনের প্রধান পন্থা হলেও যৌন নির্যাতনের আরো অনেক বহুমাত্রিক রূপ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। প্রতিদিন খবরের মাধ্যমগুলোতে চোখ পড়লেই দেশ-বিদেশে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ নানাবিধ বিভৎস অপরাধের খবর দেখতে পাই। এসব বিভৎসতার প্রধান আক্রান্ত হিসাবে সাধারণতঃ মেয়েশিশু ও নারীদের খবর প্রকাশ পায়। কিন্তু ছেলেশিশুদের উপরও যে যৌনসন্ত্রাস চলে সেটা খুব একটা প্রকাশ পায় না। তার কারণ অবশ্য আমাদের সামাজিক মন-মানসিকতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটি ছেলে যৌননিগ্রহের সম্মুখীন হয়েছে এটা তার কথিত 'পুরুষত্ব' এর জন্য বড়ই অপমানের তাই বিষয়টাকে গোপন রাখে। পরিবারে, সমাজে, স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায় প্রায় সর্বত্রই মেয়েরা প্রতি মূহুর্তে যৌনসন্ত্রাসের শিকার হয়। কটুক্তি, ইভটিজিং, অশোভন আচরণ, অযাচিতভাবে শরীরের স্পর্শকাতর স্থান নিয়ে মন্তব্য বা ছুঁয়ে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা মেয়েদের বিরুদ্ধে নিত্য- নৈমিত্তিক ব্যাপার। সামাজিক অপমানের ভয়ে মেয়েদের উপরও যৌনসন্ত্রাসের সিংহ ভাগই প্রকাশ পায় না। কারণ আমাদের সামাজিক মানসিকতা হলো অপরাধীকে আড়াল করে আক্রান্তের উপরই দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া। সেকারণে চুড়ান্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে মেয়ে বা নারীদের উপর যৌনসন্ত্রাসের ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আসে
শহরের পথশিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের মাত্রাটা আরো ভয়াবহ। সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে ২০০ জন পথশিশুর ৭৯ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর নির্যাতনকারীর দ্বারা পথশিশুরা নির্যাতিত হয়ে থাকে। রাতে ঘুমানোর মুল্য হিসাবে এবং শারীরিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে শিশুদেরকে পুলিশ, সংশ্লিষ্ট ট্রেন বা বাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে যৌনতা বিক্রি করতে হয়, তাদের নিজেদের সাথীদের মধ্যে খাবারের বিনিময় করতে ও নিরাপদ সঙ্গ পেতে যৌনতা বিক্রি করতে হয়। এমনও দেখা গেছে, যদি পথশিশুদের বিভিন্ন দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে তাহলে বিজিত দলের সব থেকে বয়সে ছোট কিশোরকে বিজয়ী দলের কিশোররা ধর্ষণ করার জন্য পুরুস্কার স্বরূপ পেয়ে থাকে। না। একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, ঢাকা শহরে গৃহকর্মী হিসাবে কর্মরত ৪৩ জন বালকের ২০ শতাংশই তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে, বিড়ি ফ্যাক্টরীতে কাজ করে এমন তারা তাদের নিয়োগ কর্তার দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। চায়ের দোকান, হোটেল ও পরিবহন শ্রমিক হিসাবে কাজ করে এমন ৮৮ জন বালকের ৪৩% শতাংশই বলেছে তারা যৌন নির্যাতনের কারণে চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে।
যৌন সহিংসতা শিশুদের জীবনে শারীরিক ও মানসিকভাবে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব তৈরী করে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে সকল শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে তারা যারা যৌন সহিংসতার শিকার হয়নি তাদের চেয়ে অনেক বেশি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থতায় ভোগে, অবসাদ্গ্রস্থ হয়, আত্মবিশ্বাস হারায়। তারা মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে পারে না, নিঃসঙ্গতায় ভোগে। আবার অনেক সময় দেখা গেছে তারাই আবার পরবর্তী জীবনে যৌন নিপীড়নকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া শিশু বিশেষতঃ পথ শিশু বা যারা শ্রম বিক্রি করে থাকে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের নেশায় আসক্ত হওয়ার হার অনেক বেশি।
তথ্যসূত্রঃ