মহামারী নিয়ন্ত্রণে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি তৎপরতায় ভাটা পড়ায় পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
Published : 17 Jul 2021, 01:41 AM
তারা বলছেন, ভাইরাস যতক্ষণ একজন থেকে আরেকজনে ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে ততক্ষণ সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হল চক্র ভাঙা, অর্থাৎ একজনকে আক্রান্ত করার পর ভাইরাস যেন তার থেকে আরেকজনকে সংক্রমিত করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা।
আর সেজন্যই সবাইকে টিকার আওতায় আনা দরকার। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের বেশিরভাগ অংশকে টিকার আওতায় আনা না যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের কোনো বিকল্প বিশেষজ্ঞরা দেখছেন না।
এ কাজটি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে সচেতনতা ও সহায়তা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন তারা।
কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার পর সবার আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই।
করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর গত ষোল মাসের মধ্যে এখনই সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি পার করছে বাংলাদেশ। দৈনিক শনাক্ত রোগী আর মৃত্যুর সংখ্যাও পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়।
শুরুর দিকে ভাইরাসের প্রকোপ মূলত ঢাকা ও শহরকেন্দ্রিক থাকলেও গত এপ্রিলে দেশের সীমান্ত জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়তে থাকে।
ভারতে প্রথম শনাক্ত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারে এখন দেশজুড়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বিপর্যয় সামলাতে গ্রামে গ্রামে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন না করলে সংক্রমণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
“স্বাভাবিকভাবেই একটা সময়ে যে কোনো ভাইরাস আস্তে আস্তে তীব্র বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, আবার মিউটশনের মাধ্যমে আস্তে আস্তে শক্তিও হারাতে পারে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আমরা করোনাভাইরাসের নির্জীব হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।”
সানিয়া তাহমিনা বলেন, “আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন মেইনটেইন করা যে যাচ্ছে না, এর ফল গত ঈদের পরে কিন্তু আমরা দেখেছি এবং এখনও দেখছি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে টিকা দেওয়া ও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
“আর লকডাউন এত বেশি ঢিলেঢালাভাবে হয়েছে যে, ১৪ দিনেও সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ এবার আমরা দেখিনি। এখন আবার সবকিছু খুলে দিয়েছি। আর দীর্ঘদিন এসব মেনে চলাও সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত দেশে রেকর্ড ১ লাখ ৫২ হাজার ১১৪ জন কোভিড রোগী রয়েছেন। তাদের মধ্যে আইসোলেশনে রয়েছেন ৭৪ হাজার ৬২৭ জন। এর বাইরে ১ লাখ ৯ হাজার ৬০৪ জন কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন দাবি করলেন, সংক্রমণ ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ ছড়িয়ে পড়লে ‘পৃথিবীর কোথাও’ আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন সেভাবে বাস্তবায়ন হবে না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যখন সংক্রমণ ৫ থেকে ১০ শতাংশ হয়, তখন হয়ত আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন করা যায়। কিন্তু উচ্চ সংক্রমণের ক্ষেত্রে যথার্থভাবে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা যায় না।
“যখন সংক্রমণের হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হয়ে যায়, তখন কে আইসোলেশনে থাকবে, কে কোয়ারেন্টিনে থাকবে- সেটা কী বলা যায়? এখন বাংলাদেশের সব জেলাতেই সংক্রমণ বেশি, তাহলে কাকে কোয়ারেন্টিন করবেন, কাকে আইসোলেশন করবেন? সবাই তো সাসপেক্ট।”
তিনি বলেন, “৫ লক্ষ লোক যদি সাসপেক্ট হয়, তাদেরকে আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিন করার ক্যাপাসিটি কি আমাদের আছে? পৃথিবীর কোনো দেশই এটা পারবে না।”
অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনাও মনে করেন, সক্ষমতার অভাবেই দেশে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
“আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি নাগরিকের নিজস্ব বিষয়। এখন সরকারের যে সক্ষমতা এবং যে পরিমাণ লোকবল; সেটা শুধু স্বাস্থ্যবিভাগ দিয়ে নয়, তাদের খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সেবা, নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রতিটি সেক্টরে একই সাথে সমন্বয় করে আইসোলেশন নিশ্চিতের কাজ করার লোকবল বা মানসিকতা কোনটাই নেই আমাদের।”
তবে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, বর্তমান সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতেও যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, “প্রতিটি ওয়ার্ডে আইসোলেশন সেন্টার করতে হবে। অধিকাংশ লোক বাসাতেই থাকতে পারে। গ্রামে যে কুঁড়েঘরে থাকছে, তাকে খাবারটা তার বাসার উঠানে দিয়ে আসতে পারেন। গ্রামে যেখানে ঘনবসতি, সেখানে এগুলো করতে হবে। “
এক্ষেত্রে সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
“যারা জীবিকার জন্য বাইরে যাচ্ছেন, তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকেই নিজের ঘরে আইসোলেটেড থাকতে পারছেন না, কারণ একই ঘরে অনেক মানুষ থাকেন। অনেকের ঘর নাই।
“তাদের জন্য কমিউনিটিতে আইসোলেশন কেন্দ্র, যেটাকে আমরা বলছি ফিল্ড হাসপাতাল বা অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে আক্রান্তদের আলাদা করতে হবে।”
ডা. মুশতাক হোসেনের মতে, এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে স্থানীয় সরকারের নেতা, স্থানীয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ধর্মীয় ব্যক্তিদের কাজে লাগাতে হবে।
“আরও চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবক দরকার। সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা অনেক বেশি। আরও বেশি লোকজন যেন কোভিড রোগীদের সেবায় এগিয়ে আসে, সেজন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।”
দেশের হাসপাতালে রোগীর তুলনায় আসন কম থাকায় সংক্রমণ প্রতিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করাও তাগিদ দেন তিনি।
বাড়াতে হবে নমুনা পরীক্ষা
শনাক্ত রোগী বাড়তে থাকায় এখন দিনে ৪০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। তবে সংক্রমণের বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে নমুনা পরীক্ষা আরও বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই গ্রামে এই সময়ে, পাশের গ্রামে আরেক সময়ে নমুনা পরীক্ষা করা যাবে। এভাবে কাজ করুক। কিন্তু এগুলা কিচ্ছু তো হচ্ছে না। শুধু যারা মাস্ক পরে না, তাদের গালাগালি করা হচ্ছে।
“সংক্রমণটা আটকাতে হলে যাদেরই সন্দেহ হবে, টেস্ট করতে হবে। টেস্ট করে শনাক্ত হলে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন করতে হবে। আর বাকি সবাইকে মাস্ক পরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।”
সোয়া এক বছরেও প্রান্তিক মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা না পৌঁছানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনের ভাষ্য, সংক্রমণ বাড়ায় নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে গ্রামে অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হচ্ছে।
“এটা কিন্তু শহরে রাখা হয়নি। গ্রামে রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ টেস্টটা করে। এ কারণেই এখন নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে।”
তবে মুশতাক হোসেনের মতে, নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়লেও মানুষের ভয় কমেনি। সেজন্য গ্রামে সহযোগিতা বাড়াতে বলছেন তিনি।
“সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে অনেক টেস্ট করতেই আসছে না। মানুষ ভাবে, সে পজিটিভ হলে, তাকে বন্দি করে রেখে দেবে। ওই ভয়টা দূর হবে তখন, যখন সে সামাজিকভাবে সহায়তা পাবে।
“যদি দেখে পজিটিভ হলে সমাজ খাবার দেয়, কিছু লাগলে সেটার ব্যবস্থা করে, তাদের বের হতে হয় না, রোজগারের চিন্তা করতে হবে না- তখন মানুষ টেস্ট করাতে আগ্রহী হবে। শনাক্তও হবে, আইসোলেশনেও থাকবে, মেডিকেল অ্যাডভাইসও পাবে। তখন সংক্রমণটা বাড়বে না। মৃত্যুও কমবে।”