আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে নিজের অবস্থান জানালেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার পুরো নির্বাচন কমিশনের বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশন কে এম নূরুল হুদা।
Published : 08 Apr 2018, 01:57 PM
রোববার ঢাকায় এক আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হওয়া উচিত। বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে সেনা মোতোয়েন করা হয়েছিল।
“আমি ব্যক্তিগতভাবে একবারও বলিনি যে সেনা মোতায়েন হবে না। তবে এটা আমার একার সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। ইসির আরো পাঁচজন সদস্য আছেন, তারা মিলেই এটা সিদ্ধান্ত নেবেন।”
সিইসি বলেন, তিনি জাতীয় নির্বাচনে সেনা চাইলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে নন।
“স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা উচিত বলে আমি একদম মনে করি না।”
নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে।
সিইসি ছাড়াও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। তাদের কথাতেও সেনা মোতায়েনের প্রসঙ্গ আসে।
দেশের ৩০০ আসনের নির্বাচনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর ৫ লাখেরও বেশি সদস্য প্রয়োজন হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫ দিন মোতায়েন ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
২০০১ সালের আগে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত কোনো গনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ছিল না। তারপরও ১৯৭৩ থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে।
বিএনপি বরাবরই চাইছে, সেনা সদস্যদের ভোটের মাঠে নামানো হোক ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে। জাতীয় নির্বাচনের স্থানীয় সরকারের ভোটেও তারা সেনা চায়। তবে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ও স্থানীয় ভোটে সেনা মোতায়েন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থান এর বিপরীতে।
বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান গোলটেবিল আলোচনায় বলেন, “আমাদের দেশের সেনাবাহিনী পৃথিবীর অনেক দেশেই নির্বাচন পরিচালনা করে, কিন্তু আমাদের দেশে পারবে না- এটা কেমন কথা?
“সেনাবাহিনী নির্বাচনের সময় মাঠে থাকলে ক্ষমতাসীনদের অসুবিধা হবে, বিশৃঙ্খলা করতে অসুবিধা হবে... তাই তারা নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে। নির্বাচন কমিশন যদি ভোটারদের পক্ষ না নেয়, তাদের পক্ষ নেয় তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই।”
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক খান বলেন, “একটা কথা বার বার বলা হচ্ছে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে। আমি জানি না এই কনফিউশনটা কেন সৃষ্টি হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে। কীভাবে হবে সেটা কমিশন জানে।”
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য এ নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষাবাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করা যাবে ১৮৯৮ সালের প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩১ ধারায় এবং সেনা বিধিমালায় ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ শিরোনামে তার ব্যাখ্যা রয়েছে।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে ভোটার তালিকা আইনে সংশোধন করে, যার লক্ষ্য ছিল বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোটার তালিকায় এনে তাদের ভোট দেওয়ার পথ তৈরি করা।
কিন্তু এরপর আট বছরে হয়ে গেলেও প্রবাসীদের ভোটার করার পদ্ধতি ও তাদের ভোটদান পদ্ধতি নিয়ে বিধিমালা না হওয়ায় বিষয়টি আর এগোয়নি।
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ১৮ লাখের বেশি। আর প্রবাসে থাকা বাংলাদেশির সংখ্যা মোটামুটি কোটির ঘরে। তাদের ভোটাধিকার দিতে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য থাকলেও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা কাজটি সহজ বলে মনে করেন না।
আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক খান বলেন, “প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে নীতিগত বাধা যেমন রয়েছে, তেমনি এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিরও অভাব রয়েছে। বিষয়টি দলীয় ফোরামের আলোচনায় তুলব আমি। নির্বাচন কমিশন যদি এটা আমাদের কাছে নিয়ে আসে আমরা সহযোগিতা করব।”
তিনি বলেন, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে অনেক গল; থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশেও নির্বাচন নিয়ে কথা উঠেছে। তারপরও নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পদ্ধতির ওপর বিশ্বাস রাখতে হয়।
বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান সংবিধান ও আইন পরিবর্তন করে হলেও প্রবাসীদের ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করতে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
কিন্তু পাশাপাশি তিনি বলেন, “প্রবাসীরা তো দূরে থাক যারা দেশে ছিলেন, গত নির্বাচনে তারাও ভোট দিতে পারেননি। এই যখন বাস্তবতা তখন প্রবাসীদের ভোটাধিকারের আগে দেশে অবস্থানকারী জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ভাবা দরকার।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকারের আগে দ্বৈত নাগরিক ও প্রবাসীদের মধ্যে কারা ভোট দিতে পারবেন- তা আইনের মাধ্যমে স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
নির্বাচন আয়োজনে যুক্ত কর্মকর্তাদের ভোটাধিকারের বিষয়টি সামনে এনে তিনি বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কাজে যুক্ত প্রায় ১২ লাখ ভোটার এখনও ভোট দিতে পারেন না। তাদের ভোটাধিকারের বিষয়টি আগে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, “বিদেশে অবস্থানকারীদের ভোট গ্রহণ করা সত্যিই জটিল ও কষ্টসাধ্য। যেসব পদ্ধতির কথা আলোচনায় আসছে, তার প্রত্যেকটি সঙ্গে অনেক বাধা জড়িত।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, সরকার কিংবা জাতীয় সংসদ চাইলে ইসি প্রবাসীদের ভোটাধিকার দিতে প্রস্তুত। শিগগিরই ইসিতে এ বিষয়ে আলোচনা হবে।
বর্তমানে নির্বাচনে প্রক্সি ভোট ও পোস্টাল ভোট দুটোই চালু আছে জানিয়ে সিইসি নূরুল হুদা বলেন, “এটা হয় একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আগামী নির্বাচনের আগে এ পদ্ধতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচার প্রচারণা চালানো হবে।”
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের নির্বাহী সদস্য আব্দুল আওয়ালের সভাপতিত্বে এ আলোচনায় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবদুল আলিম প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
অন্যদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোমেন চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত নাসিম ফেরদৌস, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সমশের মুবিন চৌধুরীসহ নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।