জলাবদ্ধতার জন্য ওয়াসাকে দায়ী করে মেয়র সাঈদ খোকনের বক্তব্যের পাল্টায় নগর কর্তৃপক্ষের দায় বেশি বলে দাবি করেছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।
Published : 27 Jul 2017, 08:07 PM
টানা বর্ষণে একদিন আগে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় পানি জমে যাওয়া নিয়ে সমালোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসে এই দাবি করেন তিনি।
আগের দিন মানিক মিয়া এভিনিউতে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “জলাবদ্ধতা নিরসন মূলত ওয়াসার কাজ।”
জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজে ওয়াসাকে ‘তেমন পাওয়া যায় না’ বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিমের কাছে মেয়রের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওয়াসার দৈন্য নিয়ে উনি কথা বলেছেন। সম্মান রেখেই বলছি, উনি বলেছেন, অবশ্যই বলবেন; কিন্তু আমি উনার কথার সঙ্গে একমত না। এটা এক কথায় একটা ফ্ল্যাট অ্যান্সার।”
পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনে সিটি কর্পোরেশনের সম্পৃক্ততার উদাহরণ দেখিয়ে মেয়র সাঈদ খোকনের বক্তব্যকে ‘স্ববিরোধী’ বলেও মন্তব্য করেন তাকসিম।
নর্দমা নির্মাণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাজ করার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ম্যান্ডেট যদি ঢাকা ওয়াসার হয় একমাত্র, তাহলে আপনি কীভাবে ৫০০ কোটি টাকার ড্রেনেজের কাজ করলেন, কোন ম্যান্ডেটের বলে? তাহলে আপনার বক্তব্যই স্ববিরোধী হয়ে গেল না?
“সোয়াম্প ওয়াটার ড্রেনেজের সিংহভাগই করেছে সিটি কর্পোরেশন। এখনও ৩ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন সিটি কর্পোরেশনের, আর মাত্র ৩৬০ থেকে ৩৭০ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার। অতএব কার হাত কিসে বেশি?”
খালগুলোর বিষয়ে তাকসিম বলেন, এর দুটি বাদে অন্যগুলো তদারকির ভার তার সংস্থার উপর। ওই দুটো খাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাতে। বক্স কালভার্টের ১০ কিলোমিটার ওয়াসা এবং ৫ কিলোমিটার সিটি কর্পোরেশন তদারক করে।
“আমরা অবশ্যই সবাই মিলে সমন্বয় করেই কাজ করি। কিছু সময় ব্যত্যয় ঘটে হয়ত।”
দিল্লি, করাচি, কাঠমান্ডুসহ সমপর্যায়ের অনেক শহরের পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সংস্থার তুলনায় ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা কম নয় বলে দাবি করেন তাকসিম। তবে কিছু অন্তরায়ও তিনি তুলে ধরেন।
নগরীতে কমপক্ষে ১২ শতাংশ উন্মুক্ত জলাধার থাকা প্রয়োজন হলেও ঢাকায় তা না থাকায় এবং খাল ভরাটের কারণে কেবল ‘অবশিষ্ট খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার’ উপর ওয়াসাকে নির্ভর করতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তাকসিম।
তিনি বলেন, “সেখান থেকে পাম্প করে ড্রেন আউট করতে হয় পানি। আগের দুদিন যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে পাম্প দিয়ে টেনে টেনে পানিগুলো বের করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
“যেই মূহুর্তে কালকে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি হল, আগের প্রত্যেকটা বর্ষণে পাইপ টইটম্বুর ছিল, এ কারণে ওই বৃষ্টি হওয়ার পরে পাম্প চালানোর পরও সেই পানি টেনে বের করতে বেশ সময় লেগেছে।
“আগের সময়ে এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে পানি সরানো যেতো, গতকাল কিন্তু পানি বেড়েছেই। পানি কিন্তু যাচ্ছে কম। বাড়া পানিটা, যেটাকে বলি, আমরা জলজট, সেটা ঢাকায় প্রকট আকারে হয়েছে।”
নয়াপল্টনে নিজের বাসার নিচতলায়ও পানি উঠেছিল বলে জানান ওয়াসার এমডি।
“মেজর জায়গাতে পানি ক্লিয়ার হয়েছে গেছে তিন ঘণ্টার মধ্যে। মতিঝিলে নামেনি। নয়াপল্টন, আমি নিজে ওখানে থাকি, আমার বাসার ভেতরেও একতলায় পানি ছিল কালকে। সেখানে ৫টা-৬টার পর পানি নেমেছে। কাজেই পানির নামানোর ব্যবস্থা আমাদের আছে।”
জলাবদ্ধতার জন্য ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে পানি প্রবাহ বেশি থাকাকেও কারণ দেখান ওয়াসার এমডি।
“কালকে কিন্তু আমাদের ঢাকা শহরের চারিদিকে লেভেল অব ওয়াটার, সেটা নরমাল লেভেলের চেয়ে অনেক হাই ছিল। তার মানে আমাদের সমস্ত স্লুইচ গেটগুলো বন্ধ ছিল। পানির নিচে ছিলাম, সে কারণে গেটগুলো দিলে উল্টো পানি ঢুকত। সে কারণে আমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পাম্পিংয়ের উপর নির্ভর করতে হয়েছে।”
তাকসিম বলেন, ঢাকা উত্তরের অংশে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পানি নেমে গেলেও দক্ষিণে আরেকটু বেশি সময় লেগেছে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পানি নেমে যাওয়াকে নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা এবং ওয়াসার কর্মতৎপরতার প্রমাণ হিসেবে দেখান তিনি।
“আমাদের স্বাভাবিক প্রস্তুতি ছিল, আছে। একদম পুরোপুরি আছে। আর সিস্টেম যদি না-ই থাকত তাহলে যেই পরিমাণ পানি জমেছিল... সেই পানি সবই বেরিয়ে গেছে। অতিরিক্ত সময় লেগেছে তা ঠিক। অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বিশেষ অবস্থা সে ট্যাকল করতে পারেনি।”
ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা এই অবস্থায় পৌঁছার জন্য নানা কারণকে দায়ী করেন ওয়াসা এমডি।
“নগরায়নের সমস্যা, আনপ্ল্যানড সিটি গ্রোথ, ড্যাপকে সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। ড্যাপ যদি বাস্তবায়ন হত, তাহলে ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চলগুলো কেন ভরাট হয়ে গেল, বিল্ডিং হয়ে গেল। খালের যে ক্ষমতা, বক্স কালভার্টের কি সেটা একই রকম আছে? অবশ্যই না।”
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান, অতিরিক্ত প্রকৌশলী আকতারুজ্জামান, ড্রেনেজ সার্কেলের প্রকল্প পরিচালক কস্যা চিং উপস্থিত ছিলেন।
জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই প্রকল্প পাসে ‘শিগগিরই উদ্যোগ’
রাজধানীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে পরিকল্পনা কমিশনে জমা থাকা দুটি প্রকল্পে পাসের জন্য শিগগিরই উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
ঢাকা পানি সম্মেলন নিয়ে বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আগের দিনে ঢাকার জলজট সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একথা জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, “আমি নিজেই ঢাকায় বসবাস করি। প্রতি ঘণ্টায় যদি ৪০ থেকে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় তাহলে সেটির (নিষ্কাশনের) ড্রেন সিটি করপোরেশনের আছে। এর অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেই ড্রেনেজ ব্যবস্থার উপর অন্য রকম চাপ পড়ে।
“আর এবারকার চাপটা ছিল অন্যরকম। নদীতে যে পানি নিষ্কাশন করে দেব সে ব্যবস্থাও ছিল না। কারণ নদীর লেভেলও উপরে ছিল। একটা রিস্ক ছিল যদি নদী সংলগ্ন ড্রেন খুলে দিই, তাহলে আরও ব্যাপক দুর্যোগের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা ছিল। পানিটা নিষ্কাশন করতে হয়েছে পাম্প করে।”
এই ‘অস্বাভাবিক বৃষ্টির’ জন্য ‘আসলেই সেরকম প্রস্তুতি ছিল না’ বলে স্বীকার করে নেন মন্ত্রী মোশাররফ; যদিও তার অধীন সংস্থা ওয়াসার এমডির ভিন্ন কথা এসেছে।
মন্ত্রী বলেন, “অলরেডি প্লানিং কমিশনে পানি নিষ্কাশনে দুইটি প্রজেক্ট জমা আছে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি এই প্রজেক্টগুলো পাস করার ব্যবস্থা নেব। প্লানিং কমিশনও এই সমস্যাটা দেখছে। যত দ্রুত সম্ভম এ ব্যাপারটি ড্রিল করব।”
আগের দিন রাজধানীর জলাবদ্ধতার নিয়ে মোশাররফ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী বছর এই পরিস্থিতি আর দেখতে হবে না বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “অনেকেই এটাকে (বক্তব্যকে) অন্যরকমভাবে চিন্তা করতেছেন। এটা পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট কি না? আমি পলিটিক্স করি সত্যি কথা, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্ত এর বাইরে আমি তো একজন প্রকৌশলীও, এ বিষয়ে এক্সপার্ট। কথাটা তো আমি না বুঝে বলিনি। এটিকে অন্যভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রস্তুতি আছে বলে আগামী বছর এ ধরনের সমস্যা থাকবে না।”
জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় কেন আগে প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি- এ প্রশ্নে মোশাররফ বলেন, “করতে পারিনি, হয়নি। আমরা এটার গুরুত্ব বুঝি নাই। কারণ আমাদের অতীতে এই ধরনের পরিস্থিতি কখনও হয় নাই। এবার হয়েছে, আমরা আরও সতর্ক হয়ে গেছি।”