মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য চার জাপানি নাগরিককে এ অনুষ্ঠানে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার’ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
Published : 27 Apr 2023, 09:41 PM
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোচ্চার সমর্থন জানানোয় জাপানিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নতুন প্রজন্ম আগামী দিনেও দুই দেশের ‘দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব এবং ঈর্ষণীয় অংশীদারত্ব’কে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই তার প্রত্যাশা।
বৃহস্পতিবার টোকিওর আকাসাকা প্যালেস গেস্ট হাউসে চার জাপানি নাগরিককে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার’ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি আত্মবিশ্বাসী, জাপানের জনগণ অতীতের মতই আমাদের প্রয়োজনে সরকারের পাশাপাশি সবসময় আমাদের পাশে থাকবে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে বিদ্যমান আমাদের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব এবং ঈর্ষণীয় অংশীদারিত্বকে আগামী বছরগুলোতে আমাদের নতুন প্রজন্ম এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
যে চারজনকে বাংলাদেশের তরফ থেকে সম্মাননা জানানো হয়, তারা হলেন– জাপান রেড ক্রস সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এমিরেটাস তাদাতেরু কোনো, অধ্যাপক গ্যালপ পেমা, রাজনৈতিক নেতা হিদেও তাকানো (মরণোত্তর) এবং ফটো সাংবাদিক তাইজো ইচিনোসে (মরণোত্তর)।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন চার জাপানির সম্মানে প্রশংসাপত্র পাঠ করেন। সম্মাননা গ্রহীতাদের পক্ষে অধ্যাপক গ্যালপ তার অনুভূতি প্রকাশ করেন।
শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেন, “আমি এই মহৎ অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই, যেখানে আমরা শুধুমাত্র আমাদের বন্ধুদের সম্মান করছি না, বরং জাপানের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনও উদযাপন করছি।”
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা মানবতার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন এবং প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, সেইসব মহান ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সবাইকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে যেসব জাপানি নাগরিকরা ছিলেন, তারাও আজ আমাদের সাথে আছেন। এটা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি শুভ উপলক্ষ।”
জাপানের জনগণ সে সময় বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের তালিকায় আটজন সম্মানিত ব্যক্তি রয়েছেন, যাদেরকে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ এবং ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর 'ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার' দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
“আজ সন্ধ্যায় আমরা টোকিওতে বাংলাদেশের আরো চারজন মহান বন্ধুকে সম্মান জানাতে এসেছি, যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, নৈতিক ও বস্তুগত সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং সহায়তা নিশ্চিত করেছিলেন। তারা নৃশংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং আমাদের অসহায় মানুষদের জন্য মানবিক ত্রাণ, চিকিৎসা সুবিধা পাঠিয়েছিলেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “সেটা ছিল একটা কষ্টের সময়, যা কথায় প্রকাশ করা যায় না। তখন বাংলাদেশ দখলদার বাহিনীর হাতে ছারখার হয়েছিল। সেই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের জাপানি বন্ধুরা আমাদের দুর্দশা বুঝতে পেরেছিলেন এবং মানবতার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।”
তিনি স্মরণ করেন, “তারা (জাপানিরা) দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু পিছিয়ে পড়েননি। হুমকির মুখে তাদের নিঃস্বার্থ আচরণ আমাদেও চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। সবচেয়ে অবিস্মরণীয় ছিল জাপানি স্কুলের শিশুদের দান, যারা আমাদের নাগরিকদের সাহায্য করার জন্য তাদের টিফিনের অর্থ সঞ্চয় করে দান করেছিল।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে জাপানের জনগণের সমর্থনকে স্মরণ করে, যা নিশ্চিত করেছে যে, আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সঠিক ছিল, যাকে পদদলিত করা যায় না।… আপনারা ন্যায়বিচার, সম্মান, মর্যাদা এবং মানবাধিকারের জন্য আমাদের দাবির বিষয়ে সাড়া দিয়েছিলেন।
“আপনাদের সোচ্চার কণ্ঠ আমাদের কণ্ঠে শক্তি যোগ করেছিল এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তা আরো জোরালো হয়েছিল। আপনারা আমাদের উদ্দেশ্য সমর্থন করে সমাবেশ করেছেন এবং একটি নিষ্ঠুর বর্বর শক্তির বিরুদ্ধে একটি মানব ঢাল গড়ে তুলেছিলেন। উদীয়মান সূর্যের দেশে, আমরা মর্যাদা ও মানবতাপূর্ণ একটি জাতির চিত্র দেখতে পাচ্ছি।"
শেখ হাসিনা বলেন, তার বাবার উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সম্পর্ক আরও জোরদার করতে ১৯৯৭, ২০১০, ২০১৪, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে জাপান সফর করা ছিল তার জন্য সম্মানের।
“আমি আজ খুশি যে, আমার মেয়াদে, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আমাদের বন্ধুত্ব একটি 'ব্যাপক অংশীদারত্ব' থেকে গভীরতা ও মাত্রায় বিকশিত হয়েছে, 'কৌশলগত অংশীদারত্ব' হয়ে ওঠেছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও জাপান সাম্য, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চা, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের বিষয়ে অভিন্ন মহৎ ধারণা ও নীতি অনুসরণ করে।
“আমরা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করছি, যিনি আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূলকথা ঘোষণা করেছিলেন– ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরীতা নয়’ যা জাপানেও চর্চা করা হয়।
“আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রয়াসে জাপানের টেকসই অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং সমর্থনকে স্বীকৃতি দিই।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক জাপান সফর একটি সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
“সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ, অমানবিক নির্যাতন সহ্যকারী ২ লাখ নারী, ১৫ অগাস্ট শহীদ সকল ব্যক্তি, জাতীয় চার নেতা, সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের সকল বিদেশি বন্ধু, যারা আমাদের মুক্তির লক্ষ্যে অবদান রেখেছিলেন, তাদের সকলের প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই।”
তিনি বলেন, "বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সত্যিকারের সোনার বাংলা এবং বাংলাদেশকে সম্ভাবনার দেশে পরিণত করার জন্য আমরা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছি। আমরা আত্মবিশ্বাসী, জাপান অতীতের মতই আমাদের পাশে থাকবে।"
প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানাও অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি খুব স্বস্তি বোধ করছেন, কারণ, তিনি এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য জাপানি বন্ধুদের সম্মান জানাতে পেরেছেন।
“এটা একটা বড় ব্যাপার যে, আমরা আমাদের বন্ধুদের ভুলে যাই না,” বলেন শেখ হাসিনা।