রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে ভোটের মাত্র পাঁচ দিন আগে ধানের শীষ প্রতীক পাওয়া বিএনপির অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মন্ডলের প্রতিপক্ষ এখন তার দলেরই আরেক নেতা সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা।
Published : 27 Dec 2018, 07:08 PM
মন্ডলেরই আবেদনে উচ্চ আদালতের আদেশে প্রার্থিতা হারানো বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নাদিমের বিরোধিতায় অনেকটাই ফাঁকা মাঠ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. মনসুর রহমানের সামনে।
বিএনপির কর্মীরা দ্বিতীয় প্রার্থীর সঙ্গে মাঠে না থাকায় কেবল মাইকিংয়ের উপর ভর করতে হচ্ছে রাজশাহী জেলা বিএনপির সহসভাপতি মন্ডলকে।
বৃহস্পতিবার পুঠিয়া-দুর্গাপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনে কিছু পোস্টার লাগাতে দেখা গেছে তার সমর্থকদের।
ওই আসনের দলীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, মাত্র পাঁচ দিন আগে ভোটের মাঠে আসায় এবং দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী সঙ্গে না থাকায় ‘একাই ঘুরতে হচ্ছে’ ধানের শীষের প্রার্থীকে।
রাজশাহী জেলা বিএনপির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলের একজন নতুন মনোনয়ন পেয়েছে। আমাকে তো কিছু বলেনি। আমাদের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে নেই।”
গত ২ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের শেষ দিনে খেলাপি ঋণসহ কয়েকটি কারণে নাদিম মোস্তফার মনোনয়ন বাতিল করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা।
তখন তার পরিবর্তে এই আসনে নজরুল ইসলামকে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করেছিল বিএনপি। কিন্তু পেশায় আইনজীবী সাবেক সাংসদ নাদিম মোস্তফা নির্বাচন কমিশনে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পেলে ওই আসনে তাকেই আবার চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি।
দলীয় হাই কমান্ডের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন অধ্যাপক নজরুল। শুনানি শেষে ১৭ ডিসেম্বর নাদিমের পরিবর্তে নজরুলকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশ আসে উচ্চ আদালত থেকে।
এই প্রেক্ষাপটে ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বিএনপির দলীয় প্রতীক বরাদ্দ পান নজরুল।
এলাকাবাসী জানান, এর আগে আনুষ্ঠানিক প্রচারের শুরু থেকেই বৃহৎ পরিসরে ভোটের মাঠে নামেন সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা। আসনের বিভিন্ন প্রান্তে পোস্টার টানানোর পাশাপাশি গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করেন তিনি।
বুধবার পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বিএনপির প্রথম প্রার্থী নাদিম মোস্তফার ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারের অধিকাংশই ছিঁড়ে পড়ে গেছে বা বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে। কোথাও কোথাও পোস্টারের কিছু অংশ দেখা গেলেও পুরো পোস্টার নেই।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রচারের তিন দিন বাকি থাকতে প্রতীক পেয়েও দলীয় নেতাকর্মীদের তোপের মুখে কেবল মাইকিংয়ের মাধ্যমে ভোটের প্রচার সারছেন নজরুল ইসলাম মণ্ডল। কোথাও কোথাও বিএনপির নেতাকর্মীরাও তার মাইকিংয়ে বাধা দিয়েছেন। এর বাইরে কিছু এলাকায় বৃহস্পতিবারও তার সমর্থকদের পোস্টার টানাতে দেখা যায়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রচারণা শুরুর পরে বিএনপির নেতাকর্মীরা কয়দিন ভালোই দৌড়াদৌড়ি করল। আবার কয়দিন ধরে দেখছি একেবারে ঠাণ্ডা। শুনছি নাদিম নাকি বাদ হইয়ে গ্যাছে ভোট থ্যাকি। তাই ওর নেতাকর্মীরাও আর মাঠে নাই।”
নজরুলের বিপক্ষে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীর অবস্থানের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় বিএনপি নেতাদের ভাষ্যে।
দুর্গাপুরের মাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাসান ইমাম ফারুক সুমন বলেন, “এবার সব বিভেদ ভুলে গিয়ে আমরা নাদিমের জন্য মাঠে নেমেছিলাম। কিন্তু আদালত থেকে তারই মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। নাদিমের পরিবর্তে যাকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছে, তার জন্য নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে চাইছেন না।”
দুর্গাপুরের দেলুয়াবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নজরুল ইসলামকে আমরা প্রার্থী হিসেবে মানি না। তার জন্য আমার ভোটও করব না।”
আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আল মামুনসহ কিছু নেতাকর্মী বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে আছেন বলে সেখানকার একজন নেতা জানিয়েছেন।
নাদিমের ‘ফোনালাপ’: নজরুলকে ‘বসাইয়া দাও’
ভোটের দুই দিন আগে রাজশাহী-৫ আসনের প্রার্থী অধ্যাপক নজরুল ইসলামের ওপর আক্রমণের বিষয়ে বিএনপি নেতা নাদিম মোস্তফার কথিত ফোনালাপ নিয়ে পুরো এলাকা সরগরম এখন।
নাদিমের ফোনের অপর প্রান্তে দুর্গাপুরের দেলুয়াবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম ছিলেন বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
ওই কথোপকথনের শুরুতে সালাম ও কুশল বিনিময় করেন নাদিম ও রেজাউল। এরপর রেজাউল বলেন, “দুর্গাপুরে বাজারে নজরুল এসেছিল।”
তখন নাদিম মোস্তফা বলেন, “কোথায় আসছে?”
“দুর্গাপুর বাজারে…”, জবাব দেন রেজাউল।
তখন নাদিম মোস্তফা বলেন, “শালাকে মারতে পারলে ভালো হয়। কতজন আছে, কতজন আছে?”
রেজাউলের উত্তর: “মাত্র কয়েকজন আছে। মারলে তো কালকেই মারতে পারতাম। মারতে দেয়নি… এক মিনিট দাঁড়াইতে দেইনি দুর্গাপুর বাজারে…।”
কথার শেষে নাদিম মোস্তফা বলেন, “এখন সুযোগ পাইলে, সুযোগ পাইলে বসাইয়া দাও।”
বসাইয়া দেওয়া বলতে হত্যা করা নাকি আহত করা, সেটা স্পষ্ট হয়নি এলাকাবাসীর কথায়। তবে নাদিমের ঘনিষ্ঠ নেতা রেজাউল প্রার্থী নজরুলের ঘোরবিরোধী বলে জানিয়েছেন তারা।
কথোপকথনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া নিতে নাদিম মোস্তফাকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
‘ফাঁকা মাঠে’ নৌকা
প্রার্থিতা নিয়ে বিএনপির বিরোধের মধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন এই আসনে আওয়ামী লীগের নতুন মুখ মনসুর রহমান।
তবে নিজ দলের কিছু ‘বিতর্কিত’ নেতা-কর্মীর কর্মকাণ্ড নৌকা প্রতীকের এই প্রার্থীর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে ভাবছেন অনেকে।
গৌরীহার গ্রামের ভোটার আকবর আলী বলেন, “বিএনপি তাদের প্রার্থী সাথে না থাকায় আওয়ামী লীগের মাঠ ফাঁকা। কিন্তু খারাপ লোকেরা নৌকার হয়ে কাজ করলে সেটিও ভালো চোখে দেখছেন না সাধারণ ভোটাররা।”
পুঠিয়া ও দুর্গাপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বৃহস্পতিবার প্রচারের শেষ দিনে মনসুরের বিপুল সংখ্যক পোস্টার দেখা গেছে। এছাড়া নির্বাচনী মাইকিং চলেছে হরদম। শেষবারের মতো কিছু এলাকার ভোটারদের কাছেও যান নৌকার প্রার্থী।
দুর্গাপুর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের তরুণ ভোটার আইয়ুব আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদান করব। তবে যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করব। উন্নয়নের পক্ষে আমার সমর্থন থাকবে।”