টাঙ্গাইল-২ আসনে তানভীর হাসান ছোট মনির ‘নৌকার প্রার্থী হচ্ছেন’ বলে খবর ছড়িয়ে তার সমর্থকদের মিষ্টি বিতরণে আতঙ্কিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন ভূঞাপুর ও গোপালপুরের অনেকে।
Published : 22 Nov 2018, 08:49 PM
তারা বলছেন, অস্ত্র চোরাচালান, হত্যাসহ নানা অভিযোগের মুখে থাকা এই ব্যক্তি মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হলে এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হবে।
ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-২ আসনে বর্তমানে সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের খন্দকার আসাদুজ্জামান। নৌকা নিয়ে তিনি এ নিয়ে তৃতীয়বার নির্বাচিত হলেন।
কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুব্জ আসাদুজ্জামানের এবার মনোনয়ন ফরম কিনলেও প্রার্থী না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। সে জন্য তার ছেলে খন্দকার মসিউজ্জামান রোমেলও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক তানভীর হাসান ছোট মনিরের পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক আশরাউজ্জামান স্মৃতি, গোপালপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদারও মনোনয়ন ফরম তুলেছেন।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী এখনও চূড়ান্ত না হলেও ছোট মনিরই নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন দাবি করে কয়েকদিন ধরে মিষ্টি খাওয়া চলছে ভূঞাপুর ও গোপালপুরের বিভিন্ন পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়ে। আওয়ামী লীগ নেতা ছোট মনির টাঙ্গাইল জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক।
গোপালপুরের এক ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোট মনির ও তার লোকজন মনোনয়ন পাওয়ার কথা বলে এলাকায় মিষ্টি বিতরণ শুরু করেছে। তা দেখে গোপালপুর-ভূঞাপুরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সাধারণ মানুষ ভীষণ চিন্তিত।”
নানা ঘটনায় আলোচিত এই ছোট মনির। ২০১৬ সালে জার্মানি থেকে খেলনা পিস্তলের নামে অস্ত্র চোরাচালানের সময় শাহজালাল বিমানবন্দরে দুই জার্মান নাগরিক প্রেপ্তার হন। পরে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে অস্ত্র ও ড্রোন চোরাচালানে ওই দুই জার্মান ছোট মনিরের নাম বলেছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
ছোট মনিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র চোরাচালান ছাড়াও টাঙ্গাইল শহর ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে খান পরিবার ও সিদ্দিকী পরিবারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সিদ্দিকী পরিবারের বাহিনীতে ছিলেন ছোট মনির ও তার ভাই বড় মনির। দুই পরিবারের দ্বন্দ্বে খুনোখুনির জন্য আলোচিত ছিল টাঙ্গাইল।
আবদুল কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ ছাড়ার পর সিদ্দিকী পরিবার কোনঠাসা হয়ে পড়লে জার্মানি পাড়ি জমান ছোট মনির।
কিন্তু ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যায় টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা আসামি হয়ে গ্রেপ্তার হলে কোনঠাসা হয়ে পড়ে খান পরিবার। তখনই টাঙ্গাইলে ফিরে আসেন ছোট মনির।
স্থানীয় একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক সময় আমানুর রহমান খান রানা এলাকার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করত। তার অনুপস্থিতিতে ছোট মনির এখন সন্ত্রাসী কাজের নিয়ন্ত্রণ করে। সে উঠতি বয়সী নেশাখোর তরুণদের নিয়ে চলাফেরা করে। ছোট মনির এমপি হলে সাধারণ মানুষের চলাফেরা কষ্টকর হয়ে যাবে।”
অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে ছোট মনিরের মোবাইলে বৃহস্পতিবার অসংখ্যবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
টাঙ্গাইল-২ আসনের এক ইউনিয়নের সাবেক এক চেয়ারম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খন্দকার আসাদুজ্জামানের পরিবার একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবার। তিনি সচিব ছিলেন, জাতীয় চার নেতার সঙ্গে তিনিও কারাগারে বন্দি ছিলেন। পরিষ্কার ইমেজের মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত। তার ছেলেও শিক্ষিত মানুষ। তাকে বাদ দিয়ে যাকে চিন্তা করা হচ্ছে, তাতে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হবে, গোপালপুর-ভূঞাপুরের রাজনীতিতে পেশী শক্তির আবির্ভাব ঘটবে।”
আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা বলেন, “নেত্রী বলেছিলেন সৎ, ক্লিন ইমেজের শিক্ষিত লোককে দেওয়া হবে। কিন্তু এর কোনোটাই ছোট মনির নামের এই লোকটার মধ্যে নেই। তাকে মানুষ ভালোভাবে নেয় না।”
খন্দকার আসাদুজ্জামানের ছেলে মনোনয়ন প্রত্যাশী রোমেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এলাকায় আমাদের সুনাম রয়েছে। আমার বাবা তিনবার সাংসদ থাকার সময় বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন। তাছাড়া বাবার চারটি নির্বাচনে আমি সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছি। তাই টাঙ্গাইল-২ এ নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার মত সব যোগ্যতাই আমার রয়েছে।”
গোপালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হালিমুজ্জামান তালুকদার বলেন, “আমাদের এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করুক, ভাল প্রার্থী মনোনয়ন পাক, এটাই আমাদের চাওয়া।”
গোপালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হালিমুজ্জামান তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এই আসনে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হিসেবে দুজনের নাম বলতে হবে। একজন হাতেম আলী তালুকদার, অন্যজন খন্দকার আসাদুজ্জামান।”
হাতেম আলী তালুকদার ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বিজয়ী হন। ১৯৯১ সালে সালাম পিন্টুর কাছে পরাজিত হন তিনি। এরপর ১৯৯৬ সালে পিন্টুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা করে আসন উদ্ধার করেন খন্দকার আসাদুজ্জামান।
২০০১ সালে ২২০০ ভোটে পিন্টুর কাছে হারলেও ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি আসাদুজ্জামান।
টাঙ্গাইলের এই আসনটিতে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু।
শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া পিন্টু ১০ বছর ধরে কারাগারে। তার নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা অনিশ্চিত। ২০০৮ সালে টুকুই বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন।