বছর চারেক বিরতিতে আরেকটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলে এসেছে প্রায়। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডের সেই আসরের আবহে উত্তেজনা বাড়ছে প্রতি দিন; প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে উন্মাদনা। খেলা মাঠে গড়ানোর আগে সময়ের আয়নায় ফিরে দেখা যাক আগের ১০ আসর। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালের টুর্নামেন্টটি অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ জয়ের সূচনার।
Published : 05 Feb 2015, 07:38 PM
২০১১: বাংলাদেশেও বিশ্বকাপ, শিরোপা ভারতের
২০০৭: অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক শিরোপা, বাংলাদেশের সেরা সাফল্য
২০০৩: অস্ট্রেলিয়ার টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা
১৯৯৬: শ্রীলঙ্কার আভিজাত্যে উত্তরণের কাহিনী
১৯৯২: পাকিস্তানের ক্রিকেটীয়-রূপকথা
১৯৮৭: উপমহাদেশে প্রথম বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যের সূচনা
১৯৮৩: অঘটনের তৃতীয় বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ভারত
ল্যান্স ক্লুজনারের ‘ট্র্যাজেডির নায়ক’ বনে যাওয়ার, ‘সুপার সিক্স’ নামের অদ্ভুতুড়ে এক ফরম্যাট প্রচলনের, সর্বকালের সেরা ওয়ানডে হিসেবে প্রায় সর্বজনস্বীকৃতি ম্যাচের বিশ্বকাপও তা। তবে এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্রিকেটপাগলদের কাছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সমার্থক এসবের কোনোটিই না। বরং সেটি এখনো মানসপটে চিত্রিত ‘বাংলাদেশের বিশ্বকাপ’ হিসেবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে প্রথমবারের মতো ১৯৯৯ বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্র মেলে যে বাংলাদেশের!
প্রথম অংশগ্রহণে হতাশ কিন্তু করেনি বাংলাদেশ। প্রথম দুই খেলায় নিউ জিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারে তারা। তবে তৃতীয় ম্যাচে আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে তখনকার সতীর্থ স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে পায় প্রত্যাশিত জয়। আগে ব্যাটিং করে ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৮৫ রান তোলে বাংলাদেশ। মিনহাজুল আবেদীনের অপরাজিত ৬৮ রান ইনিংসটি টেনে নেয় অত দূর। এরপর স্কটল্যান্ডকে ১৬৩ রানে অলআউট করে ২২ রানের জয় পায় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের প্রথম জয়।
দ্বিতীয় জয়টি আরো বিখ্যাত। গ্রুপের শেষ ম্যাচে তখনও পর্যন্ত অপরাজিত পাকিস্তানকে যে হারিয়ে দেয় আমিনুল ইসলামের দল! নিজেরা ৯ উইকেট ২২৩ রান তোলার পর পাকিস্তানকে ১৬১ রানে অলআউট করে ৬২ রানের সেই ঐতিহাসিক জয়। ১০ ওভারে ৩১ রান দিয়ে তিন উইকেট নেওয়ায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ খালেদ মাহমুদ।
১৯৯৯-বিশ্বকাপে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে স্মৃতি ল্যান্স ক্লুজনারের। পেস বোলিংয়ে ৯ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়েছেন। তবে সেটি ছাপিয়ে যায় ইনিংসের শেষ দিকে নেমে তার ঝড়ো গতির ম্যাচ জেতানো ইনিংসগুলোয়। দুই অর্ধশতকসহ ২৮১ রান হয়তো এমন কিছু মনে হচ্ছে না। কিন্তু ১৪০.৫০ গড়, ১২২.১৭ স্ট্রাইকরেট এবং ম্যাচ জেতানোর প্রভাব বিবেচনায় ক্লুজনার ছিলেন অতুলনীয়। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক টুর্নামেন্টে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি আর কেউ।
তবে সেই ক্লুজনারও কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাকে পারেননি বিশ্বকাপ জেতাতে। আর প্রোটিয়াদের হোঁচট এমনভাবেই যে, সেই থেকে ‘চোকার’ শব্দটি জুড়ে যায় তাদের নামের আগে। তবে ক্লুজনার ও দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ট্রাজেডিতে যাওয়ার আগে একটু বিশ্বকাপের শুরুর দিকে চোখ বোলানো যাক। প্রথম তিন বিশ্বকাপের আয়োজক ইংল্যান্ডে সেবার বিশ্বকাপ ফেরে তিন বিশ্বকাপ পর। অংশগ্রহণকারী দেশ সেই আগের বিশ্বকাপের মতোই ১২টি; টেস্ট খেলুড়ে ৯ দেশের সঙ্গে আইসিসি ট্রফি থেকে আসা বাংলাদেশ, কেনিয়া ও স্কটল্যান্ড। ১২ দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করা পর্যন্ত ফরম্যাটটি পুরনো। এরপরই অদ্ভুত এক ফরম্যাট, গ্রুপে ছয় দল নিজেদের সঙ্গে প্রত্যেকে খেলবে একবার করে। সেখান থেকে সেরা তিনটি দল যাবে পরের রাউন্ডে। দুই গ্রুপের ছয়টি দল নিয়ে এই পর্বের নামই ‘সুপার সিক্স’।
সুপার সিক্স পর্ব কিন্তু দলগুলো শূন্য হাতে শুরু করবে না। সুপার সিক্সে নিজ গ্রুপ থেকে সঙ্গী হয়ে উঠেছে যে দুই দল, তাদের বিপক্ষে ম্যাচে পাওয়া পয়েন্ট নিয়ে এই পর্ব শুরু করে দলগুলো। এরপর অন্য গ্রুপ থেকে ওঠা তিন দলের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে হয়েছে তাদের। এ দুয়ে মিলিয়ে পয়েন্ট তালিকার সবার উপরে থাকা চারটি দল খেলে সেমি-ফাইনাল।
‘এ’ গ্রুপে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা ও স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সঙ্গে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া। আশ্চর্যজনকভাবে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে যায় চ্যাম্পিয়ন ও স্বাগতিকরা। দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও জিম্বাবুয়ে ওঠে সুপার সিক্সে। ‘বি’ গ্রুপ থেকে তাদের সঙ্গী হয় পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজ-বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ডকে বিদায় নিতে হয় গ্রুপ পর্ব থেকেই।
অদ্ভুতুড়ে ফরম্যাটের কারণে সুপার সিক্স শুরুর সময় পয়েন্ট টেবিলে সবার ওপরে ছিল জিম্বাবুয়ে! ‘এ’ গ্রুপ থেকে তাদের সঙ্গী হিসেবে সুপার সিক্সে আসা দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের বিপক্ষে জয়ের কারণে সবার ওপরে থাকে জিম্বাবুয়ে। অবশ্য সেখানে টানা তিন ম্যাচ হেরে আর সেমি-ফাইনাল খেলা হয়নি তাদের। ভারত পয়েন্টশূন্য অবস্থায় ওঠে সুপার সিক্সে। সেখানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারালেও তাই শেষ চারে ওঠা হয়নি তাদের।
সুপার সিক্সে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটিমাত্র ম্যাচ জিতলেও শীর্ষে থেকে সেমি-ফাইনালে ওঠে পাকিস্তান। এই পর্বের এক জয় নিউ জিল্যান্ডকে তোলে শেষ চারে। আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গী হয়ে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরণ ছিল সবচেয়ে চমকপ্রদ। শেষ চারে খেলতে হলে অসিদের প্রয়োজন ছিল শেষ ম্যাচে প্রোটিয়াদের হারানো। হার্শেল গিবসের সেঞ্চুরিতে আগে ব্যাটিং করা দক্ষিণ আফ্রিকা তোলে ৭ উইকেটে ২৭১ রান। জবাব দিতে নেমে বেশ বিপদে ছিল অস্ট্রেলিয়া। ব্যক্তিগত ৫৬ রানের সময় স্টিভ ওয়াহর তুলে নেওয়া সহজ ক্যাচটি যদি মুঠোবন্দী করতে পারতেন গিবস, তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় নিশ্চিত হয়ে যায় অনেকটা। কিন্তু অতি উচ্ছ্বাসে মুঠোবন্দী করার আগেই বল শূন্যে ছুঁড়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ ফেলে দেন গিবস। ‘ম্যাচটাই তুমি হাত থেকে ফেলে দিলে বাছা’- অমর এই ক্রিকেটীয় বাণীটি নাকি স্টিভ ওয়াহ তখন দিয়েছিলেন গিবসকে। সত্যি সত্যিই অনবদ্য সেঞ্চুরি করে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচ জেতান অধিনায়ক।
চার দিন পর সেমি-ফাইনালে মঞ্চস্থ হয় এই দুই দলের ধ্রুপদী দ্বৈরথ। যেখানে ম্যাচের বাঁকবদল হয় মুহূর্তে মুহূর্তে। অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাটিং করে ২১৩ রানের বেশি করতে পারেনি। শন পোলকের পাঁচ উইকেটে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ তখন দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে। ব্যাটিংয়ের অনেকটা সময় জুড়েও তাই ছিল। শেন ওয়ার্নের দুর্দান্ত বোলিংয়ে (১০ ওভারে ২৯ রান দিয়ে চার উইকেট) আবার ম্যাচে ফেরে উত্তেজনা।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ক্লুজনার আছেন যে! ১৪ বলে ৩১ রানের টর্নেডো ইনিংসে দলকে জিতিয়েই ফেলেছিলেন প্রায়। ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের করা শেষ ওভারে তাদের প্রয়োজন ছিল ৯ রান। প্রথম দুই বল চার মেরে প্রয়োজনীয়তাটা মামুলি বানিয়ে ফেলেন ক্লুজনার। চার বলে চাই মোটে এক রান। তৃতীয় বলে রানআউট হতে হতেও বেঁচে যাওয়া, চতুর্থ বলে রক্ষা হয়নি আর। অ্যালান ডোনাল্ডের বোকার মতো দৌড়ে দক্ষিণ আফ্রিকাও অলআউট ২১৩ রানে। ম্যাচ টাই। কিন্তু আগের পর্ব পর্যন্ত নেট রান রেটের এগিয়ে প্রোটিয়াদের কাঁদিয়ে ফাইনালে ওঠে অসিরা। দক্ষিণ আফ্রিকার গায়ে লেগে যায় ‘চোকার’ তকমা আর ক্লুজনারের আসনটা হয়ে যায় ট্র্যাজেডির মহানায়কের।
সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ওয়ানডের বিপরীতে অন্য সেমি-ফাইনাল ছিল ম্যাড়ম্যাড়ে। সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরিতে নিউ জিল্যান্ডকে সহজেই ৯ উইকেটে হারিয়ে দেয় পাকিস্তান।
ওয়ার্ন ও অস্ট্রেলিয়ার এই জয়জয়কারের মধ্যেও ক্লুজনার ও দক্ষিণ আফ্রিকার দীর্ঘশ্বাসের স্পর্শ না থেকে পারেই না!
সবচেয়ে বেশি রান:
খেলোয়াড় (দেশ) | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
রাহুল দ্রাবিড় (ভারত) | ৮ | ৪৬১ | ১৪৫ | ৬৫.৮৫ | ২/৩ |
স্টিভ ওয়াহ (অস্ট্রেলিয়া) | ১০ | ৩৯৮ | ১২০* | ৭৯.৬০ | ১/২ |
সৌরভ গাঙ্গুলী (ভারত) | ৭ | ৩৭৯ | ১৮৩ | ৫৪.১৪ | ১/১ |
মার্ক ওয়াহ (অস্ট্রেলিয়া) | ১০ | ৩৭৫ | ১০৪ | ৪১.৬৬ | ১/২ |
সাইদ আনোয়ার (পাকিস্তান) | ১০ | ৩৬৮ | ১১৩* | ৪০.৮৮ | ২/০ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
খেলোয়াড় (দেশ) | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি রেট |
জিওফ অ্যালট (নিউজিল্যান্ড) | ৯ | ২০ | ৪/৩৭ | ১৬.২৫ | ৩.৭০ |
শেন ওয়ার্ন (অস্ট্রেলিয়া) | ১০ | ২০ | ৪/২৯ | ১৮.০৫ | ৩.৮২ |
গ্লেন ম্যাকগ্রা (অস্ট্রেলিয়া) | ১০ | ১৮ | ৫/১৪ | ২০.৩৮ | ৩.৮৩ |
ল্যান্স ক্লুজনার (দ.আফ্রিকা) | ৯ | ১৭ | ৫/২১ | ২০.৫৮ | ৪.৬১ |
সাকলায়েন মুশতাক (পাকিস্তান) | ১০ | ১৭ | ৫/৩৫ | ২২.২৯ | ৪.৫২ |