ট্যাংকার দুর্ঘটনায় সুন্দরবনে তেল দূষণের প্রেক্ষাপটে শেলা নদীতে নৌযান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ নাকচ করে দিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
Published : 14 Dec 2014, 05:04 PM
অবশেষে শেলায় নৌ চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধের সুপারিশ
সুন্দরবনে শেলা নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ
তেলদূষণ: ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা, তদন্ত কমিটি
রোববার সচিবালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, “শেলা নদীতে স্থায়ীভাবে নৌ চলাচল বন্ধের দাবি জানিয়েছিল পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। তবে স্থায়ীভাবে নৌ চলাচল বন্ধের কথা এখন ভাবা হচ্ছে না।”
গত ৯ ডিসেম্বর শেলা নদীতে কার্গোর ধাক্কায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলবাহী একটি অয়েল ট্যাংকার ডুবে গেলে তেল ছড়িয়ে পড়ে এই বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে থাকা নদী ও খালগুলোতে।
এতে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করা হলে নৌমন্ত্রণালয় বনের ভেতর দিয়ে শেলা নদীতে নৌযান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।
সুন্দরবনে সব ধরনের বাণিজ্যিক চলাচল বন্ধে জাতিসংঘের আহ্বানের মধ্যে রোববার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় পরিবেশ উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ওই পথে নৌযান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধের সুপারিশ করেন।
শেলা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধে মংলা বন্দর কার্যত অচল হয়ে পড়বে বলে আগেই বলে আসছিলেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান।
আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের পরও তিনি বলেন, শেলা নদীর চ্যানেলটি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকায় জাহাজগুলোকে ১০০ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হচ্ছে।
“বিকল্প হিসেবে জাহাজগুলো নবগঙ্গা, আতাই ও মধুমতি নদী দিয়ে চলাচল করতে পারত, কিন্তু নদীগুলোতে ব্রিজ থাকায় জাহাজ চলাচল সম্ভব নয়। ব্রিজে জাহাজ আটকে যাবে।”
‘ট্যাংকলরিডুবিতে ফার্নেস ওয়েলের কারণে পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে গৃহীত কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং পরবর্তী আশুকরণীয় নির্ধারণ সংক্রান্ত’ ওই আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সভাপতিত্ব করেন শাজাহান খান।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আবুল কালাম আজাদ, নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আবু বকর সিদ্দিক, প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার রাকিবুর রহমান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আ ল ম আব্দুর রহমানও সভায় ছিলেন।
এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং মংলা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, বুয়েটের প্রতিনিধিও ছিলেন এই বৈঠকে।
জলে ভাসমান তেলের দাম বেড়েছে
ট্যাংকারডুবিতে সুন্দরবনের নদী ও খালগুলোর পানিতে ভেসে থাকা প্রতি লিটার তেলের দাম বাড়িয়ে ৪০ টাকা দরে কিনবে রাষ্ট্রায়ত্ত পদ্মা ওয়েল কোম্পানি।
পরিবেশের ক্ষতি কমাতে জলে ভাসমান তেল সংগ্রহে প্রথমে স্থানীয়দের নামানো হয়। আর সেখানে ক্রয়কেন্দ্র খুলে সেই তেল প্রতি লিটার ৩০ টাকা করে কিনছিল পদ্মা অয়েল। এরপর বন বিভাগও ট্রলার ও নৌকায় শ্রমিক নামায় তেল ওঠাতে।
রোববার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তেল কেনার দর বাড়িয়ে ৪০ টাকার সিদ্ধান্ত হয় বলে নৌমন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
“স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত তেল পদ্মা ওয়েল কোম্পানি সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভ্রাম্যমান ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করবে। প্রতি লিটার তেল ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে ক্রয় করবে।”
পরিবেশ উপমন্ত্রী জ্যাকব সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে একশ নৌকা দিয়ে তিনশ কর্মীর মাধ্যমে তেল সংগ্রহ করা হচ্ছে। কমপক্ষে ৫০০ নৌকা দিয়ে লোকজনকে উৎসাহ যুগিয়ে তেল সংগ্রহ করার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া নদী থেকে যারা তেল সংগ্রহ করছে- তাদের চর্মরোগের ঝুঁকি আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে একটি চিকিৎসক দল পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
নৌমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সুন্দরবনের যে গাছগুলোতে তেল লেগে আছে, স্প্রে করে ও ডালপালা কেটে সেগুলো দূষণমুক্ত করা হবে।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর তেল দূষণের ভবিষ্যৎ প্রভাব কেমন হতে পারে- জানতে চাইলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার রাকিবুর রহমান বলেন, তা এখনি বলা যাচ্ছে না।
“পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি হবে, কতটুকু হবে তা এখন নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা বোঝা যাবে।”
এই তেল নিঃসরণের ফলে বন ও জলজ প্রাণীর ‘তেমন ক্ষতি হবে না’ বলে নৌমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সুন্দরবনের পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি হবে।”
তবে শেলা নদীতে ডলফিনের বিচরণ শনিবারও দেখা গেছে বলে জানান তিনি। এলাকায় ট্যাংকারটি ডুবেছে, তার কাছেই ইরাবতী নদীর অভয়াশ্রম হওয়ায় জলজ এই প্রাণীর অস্তিত্ব সঙ্কটের আশঙ্কা করে আসছিলেন পরিবেশবিদরা।
তেল দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ বা বিদেশিদের সহযোগিতা নেওয়ার সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি বলে জানান পরিবেশের অতিরিক্ত সচিব।
তেল ছড়ানো নিয়ে গণমাধ্যমের সব প্রতিবেদনও সঠিক নয় বলে দাবি করেন খন্দকার রকিব।
“আজ একটি মিডিয়ায় এসেছে সাড়ে তিনশ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়েছে, আসলে তা সঠিক নয়। ঢাকা থেকে ওই স্পটের দূরত্বও সাড়ে তিনশ কিলোমিটার না। আমরা যত দূর জেনেছি, ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে তেল ছড়িয়েছে।”
এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কাঁকড়া, ঝিনুক ও মৎস্য আহরণকারীদের এক মাসের আপদকালীন ত্রাণ দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে সভায়।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে আহ্বায়ক করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়েছে।