সমুদ্রে চীনের সঙ্গে টেক্কা দিতে নিজেদের নৌবাহিনী আরো শক্তিশালী করার দিকে মনযোগ দিয়েছে তাইওয়ান। এজন্য তারা যুক্তরাজ্য থেকে সাবমেরিনের যন্ত্রাংশ এবং প্রযুক্তি আমদানি কয়েকগুণ বাড়াচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, গতবছর তাইওয়ানে সাবমেরিনের যন্ত্রাংশ এবং প্রযুক্তি রপ্তানি একলাফে অনেকটাই বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
যুক্তরাজ্য সরকার গত বছর প্রথম নয় মাসে দেশটির বিভিন্ন কোম্পানিকে তাইওয়ানে সাবমেরিনের যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি রপ্তানির যে অনুমোদন দিয়েছে, অর্থমূল্যে তা রেকর্ড ১৬ কোটি ৭০ লাখ পাউন্ড হবে। যা আগের ছয় বছরে এই খাতে মোট রপ্তানির চেয়েও বেশি।
যুক্তরাজ্য সরকারের রাপ্তানি নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য বিভাগ থেকে রয়টার্স এ তথ্য পেয়েছে। যে কেউ সরকারের কাছ থেকে এই তথ্য পেতে পারে। তবে আগে কখনোও তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের রপ্তানির তথ্য আলাদা ভাবে দেখা হয়নি।
তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করলেও চীন এখনও দ্বীপটিকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ বলে মনে করে এবং চায় পুরো বিশ্ব সেটা মেনে চলুক। আন্তর্জাতিক বিশ্বে যেটি ‘ওয়ান-চায়না পলিসি’ (এক-চীন নীতি) নামে পরিচিত। চীনের বৈদেশিক সম্পর্ক অনেকটাই তাদের এক-চীন নীতির উপর নির্ভরশীল।
চীন চায় না তাদের ডিঙিয়ে কেউ তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলুক। তাই রয়টার্সে যখন তাইওয়ানে যুক্তরাজ্যের রপ্তানি কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার খবর প্রকাশ পায় তখন চীন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়।
এ বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘যদি এটা (রয়টার্সের প্রতিবেদন) সত্য হয় তবে তা এক-চীন নীতির গুরুতর লঙ্ঘন।
এর মাধ্যমে চীনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে এবং এ পদক্ষেপ তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে।
‘‘চীন এ বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন এবং দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করছে।”
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক লিখিত বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যকে তাইওয়ান কর্তৃপক্ষকে সামরিক সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত থাকারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যুক্তরাজ্য তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তবে উভয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে সুসম্পর্ক রয়েছে। তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে যুক্তরাজ্যের একটি অনানুষ্ঠানিক দূতাবাসও আছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাজ্য দীর্ঘদিন ধরেই তাইওয়ানে নির্ধারিত কিছু পণ্য রপ্তানির অনুমোদন দিয়ে আসছে।
‘‘আমরা বিশ্বাস করি তাইওয়ান প্রাণালীর দুই পাড়ের মানুষজন কোনও ধরণের হুমকি-ধামকি, জোরজবরদস্তি বা শক্তির ব্যবহার না করে বরং গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে তাইওয়ান ইস্যুতে একটি সমাধানের পথ বের করবে।”
এদিকে তাইওয়ানে পণ্য রাপ্তানির অনুমোদন দেওয়ার হার বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাজ্য সরকারের দুই কর্মকর্তা বলেন, এটা তাইওয়ানের কাছ থেকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের পণ্য রপ্তানি বিষয়ে জানেন একজন দুইজন আইনপ্রণেতা এবং দুইজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, রপ্তানি অনুমোদন প্রদাণের হার বেড়ে যাওয়ার অর্থ যুক্তরাজ্য সরকারের তাইওয়ানকে সমর্থন করার ইচ্ছা বাড়ছে।
২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে যুক্তরাজ্য সরকার তাইওয়ানে সাবমেরিনের যন্ত্রাংশ এবং এ সম্পর্কিত প্রযুক্তি রাপ্তানির ২৫টি অনুমোদন দিয়েছে। তবে কোন কোন কোম্পানি এই অনুমোদন পেয়েছে এবং ঠিক কী কী যন্ত্রাংশ পাঠানো হচ্ছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাজ্য সরকার নিজেরাও সোমবার তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। বলেছে, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে ‘বাড়তে থাকা নিরাপত্তা হুমকি কিভাবে মোকাবেলা করা যায়’ তার পরিকল্পনা তারা করতে শুরু করেছে।
উত্তেজনার পারদ চরমে:
গত কয়েক দশকের মধ্যে বর্তমানে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশেষ করে গত বছরের শেষ ভাগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের প্রধান ন্যান্সি পেলোসির হঠাৎ করেই তাইওয়ান সফরের পর। ন্যান্সির পর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার তাইপে সফর করেছেন।
যার জবাবে, তাইওয়ান ঘিরে নজিরবিহীন সামরিক মহড়া চালিয়েছে চীন। চীনের উপকূল থেকে সমুদ্রে প্রায় ১০০ মাইল দক্ষিণপূর্বে তাইওয়ান দ্বীপের অবস্থান।
চীনের সঙ্গে সমুদ্রে সামরিক শক্তিতে পাল্লা দিতে তাইওয়ান তাদের নৌ প্রতিরক্ষা জোরদার করছে। এর অংশ হিসেবে তারা সাবমেরিনের বহর তৈরি করছে।
চীনের ক্ষোভের কারণ হতে পারে উদ্বেগ থেকে তাইওয়ান সরকার দশকের পর দশক ধরে অন্য দেশ থেকে প্রচলিত সাবমেরিন কেনা থেকে বিরত ছিল।
কিন্তু ২০১৭ সালে তাইওয়ান সরকার তাদের সাবমেরিন বহর নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। তারপর থেকেই যুক্তরাজ্য তাইওয়ানে সাবমেরিন যন্ত্রাংশ এবং প্রযুক্তি রপ্তানি বাড়ানোর শুরু করে।
২০২০ সালে যুক্তরাজ্য তাইওয়ানে ৮ কোটি ৭০ লাখ পাউন্ড মূল্যের সামমেরিন যন্ত্রাংশ এবং প্রযুক্তি রপ্তানি করে। ২০১৭ সালে যা ছিল মাত্র ৩১ হাজার ৪১৫ পাউন্ড। তার আগের বছর এ খাতে কোনো রপ্তানি হয়নি।