ইতালিতে নৌকাডুবিতে গুপ্তচরদের মৃত্যু ঘিরে রহস্য

ডুবে যাওয়ার সময় নৌকাটিতে সবমিলিয়ে ২৩ আরোহী ছিল। বাকিরা বেঁচে ফিরতে পারলেও, পারেননি মোসাদের সাবেক এক এজেন্ট, ইতালির দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও এক রুশ নারী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2023, 11:22 AM
Updated : 3 June 2023, 11:22 AM

মাজোরি হ্রদে গত সপ্তাহে হওয়া নৌকাডুবির ঘটনাটি যেন কোনো গোয়েন্দা উপন্যাসেরই চিত্রায়ন।

সুইস আল্পসের দক্ষিণে অবস্থিত, পর্যটকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়, ছবির মতো সুন্দর হ্রদটিতে গত রোববার একটি ছোট নৌকা ডুবে ৪ জন মারা যান।

এরকম দুর্ঘটনা খুব একটা বিরল নয়, ঘটার দুই-একদিনের মধ্যে লোকজন ভুলেও যায়। কিন্তু মাজোরির এই ঘটনাটির ক্ষেত্রে তেমনটা হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ, নিহতদের পরিচয়। ৪ নিহতের তিনজনই যে সাবেক-বর্তমান গুপ্তচর।

সে কারণে ঘটনাটিকে ঘিরে রহস্যের আভাস পাচ্ছেন অনেকেই; ওই নৌকাডুবি নিয়ে অনেক প্রশ্ন নানান জল্পনা-কল্পনাও উসকে দিচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

২৮ মে দুর্ঘটনায় পড়ার সময় নৌকাটিতে ২৩ আরোহী ছিল বলে জানা গেছে। এই ধরনের নৌকাগুলো সাধারণত পর্যটকদের নিয়ে পুরো হ্রদ চক্কর দেয়।

নৌকাডুবির পর বাকিরা বেঁচে ফিরতে পারলেও পারেননি ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সাবেক এক এজেন্ট, ইতালির দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও এক রুশ নারী।

এই মাজোরি হ্রদের আশপাশেই ইতালির লম্বার্দি ও পিয়েদমন্ত এবং সুইজারল্যান্ডের রাজ্য টিসিনোর অবস্থান।

লম্বার্দি সামরিক-বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে সক্ষম একাধিক কোম্পানির আবাসস্থল, আর সুইজারল্যান্ডকে অনেক গোয়েন্দাই তাদের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করেন বলে গুঞ্জন আছে।

নৌকাটির বেশ কয়েকজন আরোহীর মাজোরি হ্রদের আশপাশের এলাকায় বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট আছে।

স্থানীয় অনেক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে পর্যটকবাহী নৌকাডুবির সাধারণ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে ইতালি আর ইসরায়েলের এজেন্টদের মধ্যে একটি গোপন বৈঠক চলছিল বলেও ধারণা ইতালির শীর্ষস্থানীয় অনেক গণমাধ্যমের।

এই নৌকাডুবির ঘটনা লম্বার্দি, পিয়েদমন্ত ও টিসিনোতে বেশ সাড়া ফেলেছে।

যেন গজব নেমে আসে

ইতালির কৌঁসুলি কার্লো নসেরিনোকে কী হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, ডুবে যাওয়ার সময় ওই নৌকাতে ইতালির ১৩ গুপ্তচর ও ইসরায়েলের ৮ গুপ্তচরের সঙ্গে নৌকাটির ক্যাপ্টেন ক্লদিও কারমিনাতি ও তার রুশ স্ত্রী ছিলেন। কারমিনাতি ও তার স্ত্রী কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলেও নিশ্চিত করেছেন নসেরিনো।

ডুবে যাওয়ার সময় যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে এক আরোহীর জন্মদিন উদ্‌যাপনে ১৫ মিটার লম্বা ওই নৌকাটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। কিন্তু আচমকা নৌযানটি ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটারেরও বেশি গতির ঝড়ের মধ্যে পড়ে ডুবে যায়।

“৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের ওপর যেন গজব নেমে আসে। সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটি ডুবে যায়, আমরা পানিতে পড়ে যাই,” ইতালির দৈনিক কুরিয়ের দেলা সেরাকে এমনটাই বলেছেন কারমিনাতি।

ডুবে যাওয়া নৌকাটির এ ক্যাপ্টেন জানান, যে সময়ে নৌকাটির তীরে ফিরে যাওয়ার কথা, তার অনেকক্ষণ পরও সেটি হ্রদের ওপরই ছিল। আর আবহাওয়া খারাপ হতে পারে এমন কোনো পূর্বাভাস ছিল না।

নৌকাডুবির ঘটনায় তার কোনো দায় ছিল কিনা, কর্মকর্তারা এখন তা খতিয়ে দেখছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

কারমিনাতির স্ত্রী আনা বজখোভার বয়স ছিল ৫০; রুশ এ নারীর ইতালিতে বসবাসের অনুমতিপত্র ছিল।

নিহত বাকি তিনজন হচ্ছেন- ইতালির গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ৫৩ বছর বয়সী তিজিয়ানা বার্নবি ও ৬২ বছর বয়সী ক্লদিও আলনজি এবং অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ এজেন্ট ৫০ বছর বয়সী সিমনি এরেজ।

ইসরায়েলি গণমাধ্যমে এরেজের নাম-পরিচয় না দেওয়া হলেও ইতালির গণমাধ্যমগুলো তার নাম প্রকাশ করেছে।

নৌকাটির অন্য আরোহীদের অনেকে সাঁতরে তীরে চলে আসেন, অন্যদের কাছাকাছি থাকা বিভিন্ন নৌযান উদ্ধার করেছে।

পানিতে ডুবে চারজনের মৃত্যু হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। তবে তাদের কারওই ময়নাতদন্ত হয়নি বলে জানিয়েছে ইতালির গণমাধ্যমগুলো।

বেঁচে যাওয়ারা উধাও

যেসব কারণে এই নৌকাডুবিকে রহস্যজনক অ্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তার একটি হচ্ছে- দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের তড়িঘড়ি উধাও হয়ে যাওয়া।

ইতালির গণমাধ্যমগুলো বলছে, বেঁচে যাওয়ারা তাদের হোটেল কক্ষ, আর যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পরপরই নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে গায়েব হয়ে গেছেন।

যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের নাম, ঠিকানা বা তাদের সম্পর্কিত কোনো কাগজও রাখা হয়নি।

ইসরায়েলিরা তাদের ভাড়া নেওয়া গাড়ি ফেলে রেখে সোমবার মিলান থেকে একটি ইসরায়েলি বিমানে চেপে দেশে চলে যান বলে জানা গেছে। তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

কৌঁসুলি নসেরিনো বিবিসিকে বলেছেন, এটাই স্বাভাবিক যে কেবল হতাহতদেরই নাম-পরিচয় জানানো হয়, বেঁচে যাওয়াদের নয়।

নৌকাডুবির ঘটনায় মোসাদের সাবেক এক এজেন্টের মৃত্যুর খবর বুধবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় নিশ্চিত করেছে।

“মোসাদ এক বন্ধু, অনুরাগী ও পেশাদার সদস্যকে হারিয়েছে, যিনি কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সুরক্ষায় কাজ করেছেন। তিনি যেহেতু গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করেছেন, তাই তার বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করা সম্ভব নয়,” বলেছে তারা।

ছোট নৌকায় বেশি লোকই কারণ?

দুর্ঘটনায় পড়া নৌকাটিকে এখনও তীরে আনা হয়নি। অর্থ্যাৎ, তদন্ত এখনও পুরোপুরি শুরুই হয়নি, বলেছেন নসেরিনো।

“এই মুহুর্তে নৌকাটি হ্রদের তলায় আছে, সেটিকে তুলতে ২-৩ দিন লাগতে পারে,” বলেন তিনি।

ডুবে যাওয়ার নৌকাটির ধারণক্ষমতা ছিল ১৫ জন, কিন্তু ডুবে যাওয়ার সময় সেখানে অতিরিক্ত আরও ৮ জন ছিলেন, জানান ইতালির এই কৌঁসলি।

একাধিক গণমাধ্যম বলছে, বেশি লোক থাকায় ক্যাপ্টেনের পক্ষে খারাপ আবহাওয়ায় সেটিকে তীরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

নৌকাটিতে অনুমোদিত ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক তোলা হয়েছিল কিনা, এবং খারাপ আবহাওয়াতেও সেটিকে তীরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল কিনা, কর্মকর্তারা এখন তা খতিয়ে দেখছেন।

তদন্তে নৌযানটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণ, কাগজপত্র ঠিকঠাক ছিল কিনা, বীমা সবই দেখা হবে, বলেছেন নসেরিনো।

অনেক প্রশ্নের উত্তর না মেলায় এই নৌকাডুবির ঘটনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সঙ্গত কারণেই বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইতালির সামরিক পুলিশ কারাবিনিয়েরি তদন্তে সহায়তা করছে।

“নৌকা এবং সেসময় আবহাওয়া পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে নৌকাটিতে কারা ছিলেন, তাদের নিয়ে কোনো তদন্ত হচ্ছে না,” বিবিসিকে বলেছে তারা।