রাজমুকুট মাথায় দীর্ঘ সাত দশক শাসনের পর গত হয়েছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, শোকে মুহ্যমান ব্রিটেনে এখন তার চূড়ান্ত বিদায়ের আয়োজন চলছে।
সেই সঙ্গে রানির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ১৫টি রাষ্ট্রে নতুন এক যুগের সুচনা হয়েছে, যাদের রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে সিংহাসনে বসতে যাচ্ছেন রানির ছেলে তৃতীয় চার্লস।
স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে বৃহস্পতিবার রানির মৃত্যু হলে পরদিন শুক্রবার থেকে সাত দিনের রাজকীয় শোক ঘোষণা করেন রাজা তৃতীয় চার্লস।
নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে রানিকে বিদায় জানানো হচ্ছে। তবে শেষকৃত্যের চূড়ান্ত তারিখ জানা না গেলেও ‘যথাযথ সময়ে’ তা ঘোষণার কথা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে বাকিংহাম প্যালেস।
রয়টার্স জানিয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে, সেই পর্যন্ত চলবে শোক পালন।
রানির মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিকতা কী হবে, জীবদ্দশায় সেই পরিকল্পনা নিজেই সেরে গেছেন তিনি। তবে সেসব আনুষ্ঠানিকতার অনেক কিছুই সামনে আসেনি। তবে সামনের দিনগুলোতে কী কী ঘটতে চলেছে সেই সম্ভাবনার কথা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে সিএনএন।
রানির কফিন লন্ডনে যাবে কীভাবে
রানি মারা গেছেন স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে। সেখান থেকে কফিন লন্ডনে নিয়ে আসার প্রস্তুতি চলছে। কফিনটি প্রথমে বালমোরাল প্রাসাদ থেকে এডিনবার্গের প্যালেস অব হলিরুডহাউসে নেওয়া হবে। এই প্যালেসটি স্কটল্যান্ডে ব্রিটিশ রাজার সরকারি বাসভবন।
তারপর এটি সম্ভবত এডিনবার্গের সেন্ট জাইলস ক্যাথেড্রালে নেওয়া হবে। লন্ডনে নেওয়ার আগে সেখানে রানিকে শেষ বিদায় জানানো হবে।
সিএনএন জানিয়েছে, এরপর তার কফিন কীভাবে স্কটল্যান্ডের দক্ষিণে লন্ডনে নেওয়া হবে সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। স্থানান্তরের জন্য আকাশ ও রেল উভয় পথই রয়েছে।
কীভাবে সম্মান জানানো হবে
ঐতিহাসিক পরিক্রমা অনুযায়ী বলা যায়, রানি সম্ভবত লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার প্রাসাদের প্রাচীনতম অংশ ওয়েস্টমিনস্টার হলে বিশ্রামে থাকবেন।
আগের রাজা-রানিদের সেই হলের ভেতরের মাঝখানে উচু প্লাটফর্মে রাখা হয়েছিল। সেই সময়ে সার্বভৌম দেহরক্ষী, পদাতিক গার্ড ও অশ্বারোহী সেনা ইউনিট চব্বিশ ঘণ্টা সেখানে পাহারা দিয়ে থাকে।
১১ শতকের প্রাচীন সেই হলে পিতলের ফলকগুলো দেখাচ্ছে, সেখানে ১৯১০ সালে সপ্তম এডওয়ার্ড, ১৯৩৬ সালে পঞ্চম জর্জ, ১৯৫২ সালে ষষ্ঠ জর্জ এবং তার এক বছর পরে কুইন মেরিকে রাখা হয়েছিল।
১ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এই হলে ব্রিটেনের দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকেও ১৯৬৫ সালে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হয়েছিল।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা রাজপরিবারের সর্বশেষ সদস্য ছিলেন, যাকে ২০০২ সালে ওয়েস্টমিনস্টার হলে নেওয়া হয়েছিল। তার শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে তার নাতি প্রিন্স চার্লস, প্রিন্স অ্যান্ড্রু, প্রিন্স এডওয়ার্ড ও ভিসকাউন্ট লিনলি (প্রিন্সেস মার্গারেটের ছেলে) গার্ডে অংশ নিয়েছিলেন, যাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘দ্য ভিজিল অফ দ্য প্রিন্সেস’ বলা হয়।
রাজা পঞ্চম জর্জকে শায়িত করার সময়ও তার ছেলেরা তাকে গার্ড দিয়েছিল। তবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে কে গার্ড দেবেন, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
রানির কফিন সম্ভবত সেখানে কয়েকদিন রাখা হবে, যেখানে মানুষ সারিবদ্ধভাবে তাকে শ্রদ্ধা জানাবে এবং তার কফিন একপলক দেখবে। হাজারো মানুষ তাকে শ্রদ্ধার মাধ্যমে শেষ বিদায় জানাবে, এজন্য অনেকের নির্ঘুম রাতও কাটতে পারে।
শেষকৃত্য কেমন হবে
নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি অর্থায়নে রানির শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে আগামী দুই সপ্তাহের কোনো এক সময়ে সেই অনুষ্ঠান হবে। এখন পর্যন্ত সেই ক্ষণ না জানালেও ‘যথাযথ’ সময়ে জানাবে বাকিংহাম প্যালেস।
৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বেনেডিক্টাইন সন্ন্যাসীরা এই অ্যাবি প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা লন্ডনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপনার একটি। বছরজুড়ে প্রায়ই সেখানে রাজ্যাভিষেক, বিয়ে ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
রানির শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে অতিথি কারা থাকবেন, সেই তালিকার আরও কয়েকদিন পরে জানা যাবে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সম্ভবত রানিকে শেষ বিদায় জানাতে লন্ডনে যাবেন।
পরিচিত অন্যান্য মুখগুলোর মধ্যে রানির শাসনামলের সাবেক ১৫ প্রধানমন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন আইন প্রণেতাদের মধ্যে কেউ কেউ থাকবেন।
উচ্চ সামরিক পদে অধিষ্ঠিত ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য, রাজা বা রানির সঙ্গী এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের সাধারণত আনুষ্ঠানিক রাজকীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মঞ্জুর করা হয়, যেমনটি ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রিন্স ফিলিপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছিল।
২০১৩ সালে হাউস অফ কমন্সের ব্রিফিং নোট অনুসারে, রাষ্ট্রীয় এবং আনুষ্ঠানিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল, রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে এবং শবাধার বা কফিন বহনে ব্যবহৃত বন্দুকের গাড়িটি ঘোড়ার পরিবর্তে ব্রিটিশ রাজকীয় নাবিকরা টেনে নিয়ে যায়।
নাবিকদের দিয়ে এই শবাধার বা কফিন বহনে ব্যবহৃত গাড়ি টানার রীতি ১৯০১ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার সময়ে শুরু হয়।
রাজপরিবারের সরকারি ওয়েবসাইট অনুযায়ী, দুই চাকার সেই টানা গাড়ি বহনে ঘোড়াগুলো ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিল, সেসময় নাবিকদের একটি দল সেই গাড়ি টেনে সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে নেওয়ার দায়িত্ব নেয়।
রাজ পরিবারের বাইরে আইজ্যাক নিউটন, হোরেশিও নেলসন, প্রথম ডিউক অব ওয়েলিংটন ও চার্চিলসহ গুটিকয়েক কয়েকজনকে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সম্মান দেওয়া হয়েছে।
১৯৬৫ সালে চার্চিলের মৃত্যুর পর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পার্লামেন্টে একটি নোট দিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল, “যুদ্ধকালীন নেতা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার দেশকে অবিচ্ছিন্নভাবে সেবা করেছেন। সবচেয়ে বড় বিপদের সময়ে এ প্রেরণাদায়ক নেতা আমাদের শক্তিশালী ও সহায়তা করেছিলেন।”
শায়িত হবেন কোথায়
রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার পরে তার কফিন লন্ডন থেকে উইন্ডসরের দিকে শেষ যাত্রা করবে। তাকে উইন্ডসর ক্যাসেলের মাঠে সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে নেওয়া হবে।
প্রিন্স ফিলিপের স্মারক অনুষ্ঠান সেখানে হয়েছিল। একইসঙ্গে রানির নাতি-নাতনির বিয়ের মতো অনুষ্ঠানগুলো হয়েছিল।
২০২১ সালে ডিউক অব এডিনবার্গ ফিলিপের কফিনটি চ্যাপেলের রয়্যাল ভল্টে রাখা হয়, যেখানে রাজপরিবারের অনেক সদস্যকে রাখা হয়েছিল।
রানির মৃত্যুতে তাকে রয়্যাল ভল্ট থেকে সরিয়ে এই জুটিকে একসঙ্গে পঞ্চম জর্জ চ্যাপেলে শায়িত করা হবে।