ভারতের ইতিহাসের ভয়াবহতম ট্রেন দুর্ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে তিন দিন। এখনো স্বজনরা পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রিয়জনকে। জীবিত না হলেও অন্তত মৃতদেহটি খুঁজে পাওয়ার আশা তাদের।
শুক্রবার সন্ধ্যার ওই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৭৫ জন। স্থানীয় হাসপাতালগুলোর মর্গে একসঙ্গে এত মৃতদেহ রাখার জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়েই বেশ কিছু মৃতদেহ উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার একটি বিজনেস পার্কে রাখা হয়।
সাধারণ দিনগুলোতে নানা কাজে দর্শনার্থীরা এনওসিসিআই বিজনেস পার্কে আসেন। কারণ, এখানে রয়েছে কয়েকটি বড় বড় কোম্পানির অফিস, একটি উন্মুক্ত থিয়েটারসহ আরো অনেক কিছু।
কিন্তু রোববার সেখানে গিয়ে বিবিসির এক প্রতিনিধি যা দেখেছেন, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
১০ একর জায়গার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ওই বিজনেস পার্কে ওইদিন শুধু ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্বজনদের ভিড় ছিল। যারা তাদের প্রিয়জনকে খুঁজতে বা তাদের খোঁজ পেতে এসেছেন।
সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, শুক্রবার দুর্ঘটনার পর থেকে রোববার পর্যন্ত দেড়শর বেশি মৃতদেহ ওই বিজনেস সেন্টারে আনা হয়েছে।
বেশ কয়েকজন নিখোঁজ ব্যক্তির সম্পর্কেও সেখান থেকে তথ্য প্রদান করা হয়েছে।
সেন্টারের বাইরে বিবিসির প্রতিনিধির সঙ্গে সীমা চৌধুরি নামে এক নারীর কথা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মালদা শহর থেকে আসা ওই নারী বলেন, তিনি তার স্বামী দীপঙ্করকে খুঁজে পাচ্ছেন না। কয়েকঘণ্টা ধরে খোঁজার পরও কোনো হদিস করতে না পেরে তিনি আশা হারিয়ে ফেলছেন।
তিনি বলেন, ‘‘আমি হাসপাতালেও গিয়েছি, মৃতদেহগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি, কিন্তু আমার স্বামীকে খুঁজে পাইনি।”
উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরের হাসপতালগুলোও খুঁজে এসেছেন বলে জানান এই নারী। ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত বেশ কয়েকটি মৃতদেহ ভুবনেশ্বর নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সীমার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কাঞ্চন চৌধুরি। তিনি তার স্বামীর খোঁজে বিভিন্ন হাসপাতাল ছুটে বেড়িয়েছেন। কিন্তু খুঁজে পাননি।
স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেন, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তার সব ধরনের চেষ্টা করছেন তারা।
কিন্তু এত বড় বিপর্যয়ের কারণে সবকিছু সুশৃঙ্খলভাবে করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিজনেস পার্কে কাচের দরজার ওপাশে বিশাল একটি হল ঘর। যেটিকে পার্টিশন দিয়ে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে।
একদিকে বড় একটি কালো রঙের প্লাস্টিক শিট বিছানো। তার উপর সারি সারি করে রাখা মৃতদেহ। শিটের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে বরফ গলা পানি। মৃতদেহগুলোর দ্রুত পচন রোধে সেগুলোর উপর বরফ চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।
মৃতদেহগুলোর চারপাশে ভাঙা মোবাইল, কাপড়, একটি তামাকের বাক্স আর একটি ওয়ালেট। এগুলোর সবই খুব সম্ভবত নিহতদের সঙ্গে থাকা জিনিস।
হলের অন্য পাশে একটি প্রজেক্টরে মৃতদেহের ছবি দেখানো হচ্ছে। যাতে পরিবারের সদস্যরা তাদের শনাক্ত করতে পারেন। অনেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। তারা একদৃষ্টিতে স্ক্রিনে আসা একটির পর একটি ছবি দেখে যাচ্ছেন। খুঁজে পেতে চেষ্টা করছেন হারানো প্রিয়জনকে।
কাছেই টেবিলের উপর মৃতদেহের আরো ছবি পড়ে রয়েছে। সেগুলো বিজনেস পার্ক থেকে কাছের হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
স্থানীয় একজন বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, হলটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং মৃতদেহগুলো রাখার জন্য যথেষ্ট বড়।
কিন্তু কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, খুব বেশি সময় হয়তো সেখানে মৃতদেহগুলো আর রাখা যাবে না।
বালেশ্বরে এখন প্রচণ্ড গরম। এদিকে মৃতদেহ সংরক্ষণে তেমন ব্যবস্থা না থাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশ সংরক্ষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্বজনরা অনেক দূরদুরান্ত থেকে আসছেন। অনেকেই ভিন্ন রাজ্য থেকে। ফলে তাদের বালেশ্বর পৌঁছাতে এবং মৃতদেহ শনাক্ত করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে।
জেলা কর্মকর্তা নির্লিপ্তা মোহান্তি বিবিসিকে বলেন, ‘‘এইসব কারণে মৃতদেহ দীর্ঘসময় সুরক্ষিত রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।”
তাই তারা এখন মৃতদেহ রাজধানী ভুবনেশ্বর পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানান। যেখানে বড় বড় হাসপাতাল এবং অন্যান্য সুবিধা রয়েছে।
নির্লিপ্তা বলেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে সব রকমভাবে চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সুমিত কুমারের মত স্বজন খুঁজতে আসা ব্যক্তিদের জন্য যথেষ্ট নয়। সুমিত তার স্বজন নিরাজকে খুঁজতে এসেছেন।
তিনি বলেন, ‘‘আমি বহু কষ্টে মৃতদের ছবি থেকে তার ছবি বের করেছি। কিন্তু এখনও তার লাশ খুঁজে পাইনি।”
বিজনেস পার্কে একটি হেল্প ডেস্কে স্বেচ্ছায় কাজ করছেন সমাজকর্মী উদয় কুমার। তিনি বলেন, প্রশাসনের উচিত দূরে কোথাও না গিয়ে কাছের রেলওয়ে স্টেশন বা বাস স্টপে হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা।
এখানে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বিপর্যয়ের ভয়াবহতা তাদের হতবিহ্বল করে দিচ্ছে। সেখানে শনিবার থেকে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন পৌরসভা কর্মী সুব্রত মুখী।
‘‘আমি রীতিমত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। তাদের দেখে আমি মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলছি। আমার বার বার মনে হচ্ছে যদি তাদের মত আমারও কেউ এভাবে হারিয়ে যেত তবে আমার কেমন লাগত।”