এক মহারাজা আর তার রহস্যময় উইল

তিন দশক ধরে এক রাজার ২০ হাজার কোটি রুপির সম্পদের মালিকানা নিয়ে যে বিরোধ চলছিল, তার অবসান ঘটিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2022, 06:12 PM
Updated : 3 Oct 2022, 06:12 PM

এক রাজার ছিল অঢেল সম্পদ, কিন্তু সেই সম্পদ তার চার সন্তানের মধ্যে কাকে কতটুকু দেবেন, জীবদ্দশায় তা নিয়েই রাজার চিন্তার শেষ ছিল না। মৃত্যুর আগে সেই রাজা বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি উইল করে যান, আর তা নিয়ে বিপাকে পড়ে যান সন্তানরা।

গল্পটি রূপকথার মনে হলেও বাস্তবেই ঘটেছে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের ফরিদকোটের সর্বশেষ সামন্ত শাসক হরিন্দর সিং ব্রারের মৃত্যুর পর।

তিন দশক ধরে তার ২০ হাজার কোটি রুপির সম্পদের মালিকানা নিয়ে যে বিরোধ চলছিল, গত সেপ্টেম্বরে তা অবসান ঘটিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

১৯৮৯ সালে হরিন্দর সিং ব্রারের মৃত্যুর পরই সেই কোন্দল শুরু হয়েছিল। তার বড় মেয়ে রাজার একটি উইল নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন; তার দাবি ছিল, বাবার অঢেল সম্পদের কোনো অংশই তিনি পাননি।

পরবর্তীতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বলে, ওই উইলটি ‘কাল্পনিক, বানোয়াট এবং সন্দেহজনক’, যেটি অনুযায়ী হরিন্দর সিংয়ের দুই মেয়েকেই কেবল সম্পত্তির বড় অংশ পায়।

রাজার বিতর্কিত এই উইলসহ মোট তিনটি উইল নিয়ে তিন দশক ধরে চলেছে আইন লড়াই। আর বিচিত্র এই ঘটনা উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

বিতর্কিত উইল

ভারত স্বাধীন হলে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন শাসকদের মতো হরিন্দর সিং সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছান; চুক্তি অনুযায়ী তিনি তার কিছু সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণের অধিকার পান।

তার সম্পদের মধ্যে ছিল শত শত একর জমি, দুর্গ, ভবন, উড়োজাহাজ, ভিনটেজ গাড়ি, ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা অর্থ; যেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা ও দিল্লিতে।

জীবদ্দশায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজও করেছিলেন হরিন্দর সিং। ইতিহাসবিদ হরজেশ্বর পাল সিং বলেছেন, “ফরিদকোটের শাসক অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। রেলওয়ে ও হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন।”

ব্রিটিশদের সঙ্গে হরিন্দর ও তার পূর্বপুরুষদের ভালো সম্পর্ক ছিল বলে জানান হরজেশ্বর পাল।

হরিন্দর ও তার স্ত্রীর চার সন্তান ছিল, এর মধ্যে এক ছেলে ও তিন মেয়ে। একমাত্র বড় মেয়ে অমৃত কাউর এখন বেঁচে আছেন। হরিন্দরের দুই সন্তান টিক্কা হরমোহিন্দর সিং এবং মাহিপিন্দর কাউর কোনো উত্তরাধিকারী না রেখেই মারা যান।

১৯৫০ সালে হরিন্দর সিং তার প্রথম উইল রচনা করেন। সেখানে উল্লেখ করেন, সম্পদের মধ্যে চারটি ফ্ল্যাট ও কয়েকটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্টে রাখা টাকা তার তিন মেয়ের মধ্যে সমানভাবে ভাগ বণ্টন হবে।

দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় উইল তৈরি করেন এই রাজা। সেখানে বড় মেয়ে অমৃত কাউরকে কোনো সম্পদ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেননি, বরং ওই সম্পদগুলো তার অন্য দুই মেয়ের মধ্যে বণ্টনের কথা বলেছেন।

সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বলা হয়েছে, এর পেছনের কারণ বলে মনে হয়েছে, বড় মেয়ে অমৃত বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন।

তিন বছর পর রাজা হরিন্দর লন্ডনে আরেকটি আইনি দলিল নিবন্ধন করেন, সেখানে আবার অমৃত কাউরকে বঞ্চিত করা হয়নি।

ওই নথি অনুযায়ী, অমৃত তখনই সম্পদের ভাগ পাবেন, যখন তার বয়স ২৫ বছর হবে অথবা আইনগতভাবে স্বামীকে ছেড়ে আসেন। এর মধ্যে যেটিই আগে ঘটুক, তিনি সম্পদের ভাগ পাবেন।

এরই মধ্যে অমৃত তার বাবা হরিন্দরের কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর বিশাল ধাক্কা খান অমৃত, যখন তার হাতে তৃতীয় উইল এসে পৌঁছায়।

ওই উইলটি ১ জুন ১৯৮২ সালের। সড়ক দুর্ঘটনায় অমৃতের ভাই টিক্কা হরমোহিন্দরের মৃত্যুর কয়েক মাস পরই তাদের বাবা উইলটি করেছিলেন।

সেই উইলে বলা হয়, রাজা হরিন্দরের সিদ্ধান্ত, সকল সম্পদ একটি ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হবে, যেখানে ট্রাস্টি হিসাবে থাকবেন অমৃতের দুই বোন এবং হরিন্দরের মায়ের পক্ষের এক আত্মীয়।

আদালতের যুদ্ধ

১৯৯১ সালে অমৃত কাউর ওই উইলকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন। সম্পদের এক- তৃতীয়াংশ দাবি করেন তিনি। তার বোন দিপিন্দর কাউর ও মাহিপিন্দর কাউর এবং অন্যান্য ট্রাস্টিদের মামলায় বিবাদী করেন।

এখানেই শেষ নয়, হরিন্দর সিংয়ের ছোট ভাই কানওয়ার মনজিৎ ইন্দর সিংও একটি মামলা করেন। তিনি যুক্তি দেখান, রাজার ছেলে যেহেতু মারা গেছেন, সেহেতু সব থেকে নিকট পুরুষ আত্মীয় হিসাবে তিনি ওই সম্পদের অধিকারী।

২০১৩ সালে ভারতের একটি আদালত উভয় মামলায় রুল জারি করেন। তাতে বলা হয়, তৃতীয় উইলটি আসল নয় এবং বোন দিপিন্দর কাউরের পাশাপাশি ওই সম্পদের অর্ধেক পাবেন অমৃত। অন্যদিকে ২০০১ সালে আরেক বোন মহিপিন্দর কাউর মারা যাওয়ায় সেই সম্পদে তাকে যুক্ত করা হয়নি।

অমৃত নিযুক্ত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জসি আনন্দ বিবিসিকে বলেন, তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করে দেখেছেন, তৃতীয় উইলটি রাজা হরিন্দর সিং করে যাননি।

“রাজা শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তার হাতের লেখাও চমৎকার ছিল। কিন্তু কথিত সেই উইলে তা ফুটে ওঠেনি। উইলে অনেক বানান ভুল রয়েছে এবং তার সইও নকল করা হয়েছে।”

“উইল তৈরিতে বিভিন্ন টাইপরাইটারও ব্যবহার করা হয়েছিল,” যোগ করেন তিনি।

বিচারিক আদালত রাজা হরিন্দর সিংয়ের ভাই কানওয়ার মনজিৎ ইন্দর সিংয়ের দাবিও প্রত্যাখ্যান করে দেয়।

ট্রাস্টের সদস্য দিপিন্দর ও ভারত ইন্দর সিং (কানওয়ার মনজিতের ছেলে) ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন।

২০২০ সালে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার হাই কোর্ট বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে তৃতীয় উইলটিকে বানোয়াট বলে রায় দেয়।

হাই কোর্ট হরিন্দর সিংয়ের ভাই কানওয়ার মনজিতের করা মামলাও বাতিল করে; কিন্তু সম্পদের ২৫ শতাংশ ভাগ কানওয়ারকে দেওয়ার আদেশ দেয় আদালত, কারণ তাদের মা মারা যান ১৯৯১ সালে অর্থাৎ রাজা হরিন্দর সিংয়ের মৃত্যুর দুই বছর পর।

গত সেপ্টেম্বরে হাই কোর্টের ওই আদেশ স্থগিত করে সুপ্রিম কোর্ট অবিলম্বে রাজার সম্পদ পরিচালনাকারী ট্রাস্ট বাতিলের আদেশ দেয়। রায়ে বাকি সম্পদ অমৃত কাউর এবং দিপিন্দর কাউরের (২০১৮ সালে মারা যান) পরিবারের মধ্যে বণ্টনের আদেশ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে রাজার নামে ভুয়া তৃতীয় যে উইলটি করা হয়েছিল, সেটি তদন্ত করছে পুলিশ।

এখন তাহলে কী?

আদালতের আদেশ অনুযায়ী এখন ওই সম্পদ ভাগ করতে হবে অমৃত কাউর ও তার বোনের পরিবারকে। এজন্য একটা উপায় হলো, বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কে কোন সম্পদ পাবেন।

অন্য উপায় হলো- আদালতেই ভাগ-বাটোয়ারা করা। কিন্তু এটি সময়সাপেক্ষ বিষয় হবে বলে মনে করেন কানওয়ার মনজিতের নাতি অমরিন্দর সিং।

তবে তিনি হাঁফ ছেড়ে বলেন, “পারিবারিক কোন্দলটা অন্তত শেষ হয়েছে।”

“কিন্তু মামলাটি চলতেই থাকবে, যেহেতু আমাদের অনেক সম্পত্তি আছে, যার অনেকগুলো দূরবর্তী এলাকায়”, বলেন তিনি।