শামীমাকে আইএস-এ যোগ দিতে উস্কেছিলেন যে তরুণী

শামীমা বেগমের ‘সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ’ শারমিনা বেগম এখন শামীমাকে অবিশ্বাসী বলে উপহাস করেছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 March 2023, 06:38 PM
Updated : 22 March 2023, 06:38 PM

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগমের ‘সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ’ শারমিনা বেগম, যে তাকে যুক্তরাজ্য ছেড়ে সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছিল। সিরিয়ার একটি বন্দি শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়া সেই তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে বিবিসি।

এই শারমিনাই এখন শামীমাকে অবিশ্বাসী বলে উপহাসও করেছেন। বলেছেন, তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।

বিবিসি-র অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, শারমিনা আইএসের জন্য অনলাইনে তহবিল সংগ্রহ করছেন, যা অবৈধ। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের তহবিল জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যদেরকে পুনরায় একজোট হতে সাহায্য করছে।

সিরিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে আটকে থাকা শামীমা বেগমকে বিশ্বের সামনে তুলে আনা সাংবাদিকদের একজন আইএস এর প্রতি সমবেদনশীল সেজে অনলাইনে শারমিনার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

ওই সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগের আগেই শারমিনা সিরিয়ার ক্যাম্প হোল কারাগার থেকে পালিয়ে যান, যেখানে আইএস এর সঙ্গে থাকা নারী ও ‍তাদের শিশুদের বন্দি করে রাখা হয়েছে।

পালিয়ে গেলেও শারমিনা এখনো সিরিয়াতেই ছদ্ম পরিচয়ে আত্মগোপন করে আছেন বলে জানায় বিবিসি।  শারমিনা আর শামীমা ২০১৪ সালের ডিসেম্বরেও পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন স্কুলে পড়তেন।

 হঠাৎ করেই একদিন শারমিনা উধাও হয়ে যান। পরে জানা যায়, আইএস এ যোগ দিতে তিনি যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে সিরিয়া চলে গেছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযোগ:

দুই মাস পর শামীমা ও তার আরো দুই বান্ধবীও তাদের সাবেক সহপাঠীর পথে হেঁটে সিরিয়া পালিয়ে যায়।

শামীমা সেখানে গিয়ে এক আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেন এবং তিন সন্তানের জন্ম দেন। যদিও ওই শিশুদের কেউ আর বেঁচে নেই।

 ২০১৯ সালে সিরিয়ার একটি শিবিরে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ওই বছরই যুক্তরাজ্য সরকার তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করে।

 শামীমা তার এই দাবিতে অটল আছে যে, শারমিনাই তাকে বুঝিয়ে আইএসে যোগ দিতে রাজি করিয়েছে এবং তার পথ অনুসরণ করেই তিনি সিরিয়া পৌঁছান।

শারমিনা ব্যবহার করেন এমন একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্টে বিবিসি-র প্রতিনিধি তাকে খবর দেওয়ার কথা বলে যোগাযোগ শুরু করে।

তাদের কথপোকথনের বিষয়ে ওই প্রতিনিধি বলেন, ওই কথপোকথনে শারমিনা দাবি করেছিলেন, তার এক সময়ের বান্ধবী ‘যিনি অন্য একজন ব্যক্তির মত শুধু জীবনযাপনের সুযোগসুবিধা গ্রহণ করে সেখানে থাকছিলেন’ যিনি কোনো অবদানই রাখেননি।

তিনি বলেন, ‘‘শামীমা শুধুমাত্র তার বন্ধুদের অনুসরণ করে সিরিয়া চলে গিয়েছিল। যা তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্দশায় পরিণত হয়েছিল।”   

শামীমা বেগম সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের ধর্মীয় পুলিশ দল ‘হিসবা’ তে কাজ করেছেন বলে ধারণা করা হয়। অভিযোগ আছে, তিনি সুইসাইড বেল্টও বানাতেন। এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে শারমিনা বলেন, এ ধরণের জল্পনা-কল্পনা ‘আমাদের খাটোর করার মত’।

তিনি বলেন, ‘‘স্বামী বাড়িতে না থাকলেই কেবল শামীমা বাড়ির বাইরে যেতে পারতেন। কারণ, তার স্বামী তাকে বাইরে একদমই যেতে দিত না।”

শামীমাকে উপহাস করে শারমিনা আরো বলেন, সে একজন ব্যর্থ এবং অবিশ্বাসী ছিল। আইএস এ যোগ দেওয়া নারীদের ভাবমূর্তি সে পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছিল।”

আইএস এর একজন সাবেক সদস্য বিবিসি-কে বলেছেন, শারমিনা পুরোপুরি ধর্মান্ধ। এমনকী আইএসের মানদণ্ডেও।

শারমিনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আইএসে যোগ দেওয়ার কারণে এখন তিনি অনুতপ্ত কিনা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জবাব দেন, একমাত্র তিনিই যে যুক্তরাজ্য ফিরে গিয়ে কারাগারে জীবন কাটাতে চান না।

শারমিনা তার এক কালের স্কুল বান্ধবী শামীমা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, সেটা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত তা নির্ণয় করা কঠিন।

শামীমা এখন যেকোনো মূল্যে যুক্তরাজ্য ফিরতে চান। তিনি সিরিয়া যাওয়ার জন্য অনুতপ্ত বলে জানিয়েছেন। বলেছেন, মানুষের তার প্রতি ক্ষোভের কারণ তিনি বুঝতে পারছেন। তিনি যুক্তরাজ্য সরকারের তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

শামীমার আইনজীবীদের মূল দাবি, ২০১৫ সালে কিশোরী শামীমা আসলে মানবপাচারের শিকার হয়ে সিরিয়া গিয়েছিলেন।

শামীমাও বলেছিলেন, তার এক সময়ের স্কুল বান্ধবীই তাকে বুঝিয়ে সিরিয়া যেতে রাজি করাতে বড় ভূমিকা রেখেছিল।

শামীমা বলেন, ‘‘শারমিনা আইসআইএসে যোগ দেওয়ার বিষয়ে আমাদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলেছিল।

‘‘আমাকে প্রভাবিত করা হয়েছিল, বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে এটাই সঠিক পথ। আমরা কোথায় যাচ্ছি এবং সেখানে কি করতে হবে যে বিষয়ে মিথ্যা বলে আমাকে প্রভাবিত করা হয়। আমি বলতে চাচ্ছি, আমার মনে হয়, যদিও শারমিনা হয়তো এখনো ধর্মান্ধ। তারপরও আমি বলব, সেও আইএসআইএসের শিকার হয়েছে।”

এদিকে, শারমিনা বেগম সিরিয়ায় লুকিয়ে থাকলেও এখনো আইএস এর জন্য তহবিল সংগ্রহ করে যাচ্ছেন। তিনি বন্দিশিবিরের ভেতরের অবস্থার কথা নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করে সাহায্য হিসেবে বিটকয়ন চাইছেন।

অনলাইনে সারাবিশ্বে তার বেশ কিছু অনুসারী রয়েছে এবং তিনি বন্দিশিবিরে আটকে থাকা নারীদের জন্য নগদ অর্থ পাঠানোর অনুরোধ করে যাচ্ছেন।

 বিস্ফোরক বেল্ট:

 শারমিনা এখন পর্যন্ত কত অর্থ সংগ্রহ করেছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে, একটি একাউন্টের কথা জানা গেছে। যেখানে ২৯ বার ট্রানজেকশন হয়ে মোট তিন হাজার মার্কিন ডলার জমা পড়েছে।

তিনি আরো কয়েকটি একাউন্ট এবং কয়েকটি ক্রিপ্টকারেন্সি ব্যবহার করছেন। কেন তিনি জঙ্গি দলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে শারমিনা দাবি করেন, তিনি শুধুমাত্র দরিদ্র নারী ও শিশুদের খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করছেন।

 শারমিনা যে ক্যাম্প থেকে পালিয়েছেন সেই ক্যাম্প হোল এর পাহারার দায়িত্বে থাকা সিরিয়ান ডেমোক্রাটিক ফোর্সেস এর কমান্ডার বলেন, আইএস আবার দলবদ্ধ হচ্ছে এবং ক্যাম্পে অর্থ পাচার করছে। যা অস্ত্র কিনতে, পালিয়ে যেতে এবং হামলা করতে ব্যয় হতে পারে।

 ‘‘যদি আমরা ক্যাম্পের দিকে তাকাই। ছোট্ট ছোট্ট শিশু, যাদের বয়স মাত্র কয়েক বছর। তারা কীভাবে হত্যা করতে হয় সেই মতাদর্শ নিয়ে বড় হচ্ছে।”

 শারমিনারও দাবি, তাদের লোকজনের উপর হামলা হচ্ছে এবং তাদের হত্যা করা হচ্ছে।

 ক্যাম্প হোলে ৫৭টি দেশের ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ রয়েছে। সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, তারা ক্যাম্পের ভেতর গ্রেনেড, বন্দুক এবং বিস্ফোরক বেল্ট পেয়েছেন। যা ক্যাম্পের ভেতর পাচার করা হয়েছে। গত ছয় মাসে সেখানে অর্ধশত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

ইসলামিক স্টেটের জন্য অর্থের যোগান বন্ধ করতে গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক একজোট হয়ে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে।