থাইল্যান্ডের মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নেতা লিমজারোয়েনরাত, কে তিনি?

থাইল্যান্ডের নির্বাচনে সবাইকে তাক লাগিয়ে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে পিটা লিমজারোয়েনরাতের মধ্য-বামপন্থি ‍মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2023, 12:01 PM
Updated : 16 May 2023, 12:01 PM

থাইল্যান্ডে চার বছর পর হওয়া সাধারণ নির্বাচনে সামরিক বাহিনীপন্থিদের যে ভরাডুবি হবে, জনমত জরিপেই তার ইঙ্গিত মিলছিল।

এ কারণেই সবার চোখ ছিল পেতোংতার্ন সিনাওয়াত্রার পার্টির দিকে। ধারণা করা হচ্ছিল, ১৭ বছর আগে ক্ষমতাচ্যুত থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ের নেতৃত্বে পুয়ে থাই সবচেয়ে বেশি আসনে জিতে সরকার গঠনের দাবিদার হবে।

কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে রোববারের নির্বাচন পরবর্তী ভোট গণনায় সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে গেল পিটা লিমজারোয়েনরাতের মধ্য-বামপন্থি ‍মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি।

“আজ নতুন একটি দিন, আশা করছি এটি উজ্জ্বল সূর্যালোক ও আশায় পূর্ণ থাকবে,” থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন এটি স্পষ্ট হওয়ার পর পিটা (৪২) এমনটাই বলেছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

পিটার দল মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি থাইল্যান্ডের নাগরিকদের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তনের স্বপ্ন সঞ্চার করেছে, যা তুলনামূলক নবীন দলটিকে এনে দিয়েছে চোখ ধাঁধানো জয়।

রোববারের নির্বাচনে ভোটাররা প্রায় এক দশক ধরে চলা সামরিক বাহিনী মদদপুষ্ট শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে মুভ ফরোয়ার্ডের হাতে অন্য যে কোনো দলের চেয়ে বেশি আসন তুলে দিয়েছে। ডজনখানেক সফল অভ্যুত্থান দেখা একটি দেশে তুলনামূলক নবীন একটি দলের এমন অর্জন মোটেও ফেলনা নয়।

“যুগের মনোভাব বদলে গেছে। বদলেছে সঠিক সময়ে,” ব্যাংককে দলের সদরদপ্তরে দেওয়া ভাষণে পিটা এমনটাই বলেছেন।

থাইল্যান্ডের এই রাজধানী শহরের ৩৩টি আসনের ৩২টি-ই পেয়েছে মুভ ফরোয়ার্ড।

ভোট শেষ হলেও, নতুন সরকার গঠন করতে আরও বেশ কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। জটিলতা বেঁধে যেতে পারে, হতে পারে রক্তক্ষয়ও, কেননা থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী এখনও সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবেই রয়ে গেছে।

তবে এরপরও রোববারের জয় বেশ কয়েক বছরের সামরিক শাসনে তিতিবিরক্ত ও পরিবর্তনের জন্য ক্ষুধার্ত তরুণদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় মুভ ফরোয়ার্ড ও তার নেতা পিটাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে।  

২০১৯ সালে ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টির এমপি হিসেবে পার্লামেন্টে যাওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল পিটার। বিলিয়নেয়ার ও সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক থানাথর্ন জুয়ানগ্রুনগ্রুয়াংকির প্রতিষ্ঠিত এই দলটি সেবারের নির্বাচনে বেশ ভালো ফল করেছিল; পরিবর্তনের দাবি তুলে নাড়িয়ে দিয়েছিল থাই রাজনৈতিক অঙ্গনকে।

বিতর্কিত সব অভিযোগে পরের বছর বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টিকে; থানাথর্নকে এমপি পদে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এর পরপরই মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি গঠিত হয়, যার নতুন নেতা হন পিটা।

ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পর হাজার হাজার তরুণ সে বছর থাইল্যান্ডের সড়কগুলোতে নেমে এসেছিল’ দাবি জানিয়েছিল, সংবিধান সংশোধন, নতুন নির্বাচন এবং মানবাধিকার কর্মী ও রাষ্ট্রের সমালোচকদের হয়রানি বন্ধের।

মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নির্বাচনী প্রচারে এবার ২০২০ সালের ওই আন্দোলনের অনেক দাবিই স্থান পেয়েছে, আন্দোলনের অনেক নেতাকে প্রার্থীও বানিয়েছে তারা।

বিরোধী এমপি থাকাকালে পার্লামেন্টে দেওয়া ক্ষুরধার বক্তব্যের জন্য আগেই থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে ‘উদীয়মান তারকা’ খ্যাতি পেয়েছিলেন পিটা। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমানো এবং রাজতন্ত্র সংশ্লিষ্ট আইনের সংস্কারের মতো তার দলের সাহসী সব প্রতিশ্রুতি তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তিনি থাইল্যান্ডের সংবিধান নতুন করে লেখাতে চান; থাইল্যান্ডকে তার ভাষায় সামরিক শাসনের অধীনে থাকা ‘হারানো দশক’ থেকে বের করে আনারও অঙ্গীকার আছে তার।

নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে এপ্রিলে ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিটা বলেছিলেন, থাইল্যান্ডের ‘নিরস্ত্রীকরণ, একচেটিয়া ক্ষমতার পথ রূদ্ধ ও বিকেন্দ্রীকরণ’ তার অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে।

রাজপরিবারের সদস্যদের সমালোচনা নিষিদ্ধ করে করা আইনের বিলুপ্তিতে চাপ দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও আছে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির।

“আমরা এ সংক্রান্ত আইন পার্লামেন্টে পাস করবো। রাজতন্ত্র ও জনগণের সম্পর্ক নিয়ে কী করে আমরা অগ্রসর হতে পারি, তা নিয়ে পরিপক্কতার সঙ্গে, স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা যেন হয় তা নিশ্চিতে পার্লামেন্টকে ব্যবহার করবো আমরা,” সোমবার এমনটা বলেছেন দলটির নেতা পিটা।

রাজনীতি জড়িত, ধনী এক থাই পরিবারে জন্ম পিটার। তার বাবা ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা, চাচা ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার উপদেষ্টা। 

নিউ জিল্যান্ডে পড়তে পাঠানো হয় তাকে, সেখানেই রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন পিটা।

“আমাকে নিউ জিল্যান্ডের এমন এক জায়গায় পাঠানো হয়েছিল, যেখানে সেসময় টিভির চ্যানেল ছিল তিনটা। হয় আপনাকে অস্ট্রেলিয়ার সোপ অপেরা দেখতে হবে, না হলে পার্লামেন্টে বিতর্ক,” ফেব্রুয়ারিতে থাই ইউটিউব প্রোগ্রাম এইম আওয়ারে এমনটাই বলেছিলেন তিনি।

ব্যাংককের থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্সে অনার্স করা পিটা মাস্টার্স করেন হার্ভার্ডে, পাবলিক পলিসিতে। তিনি পরে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এমবিএ-ও করেন।

‘পাবলিক পলিসি স্কুলের আমেরিকান পণ্য’ এভাবেই নিজের পরিচয় দেন তিনি।

ব্যবসায়ী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা পিটা প্রথমে তার প্রয়াত পিতার ধানের তুষ থেকে তেল বানানোর কোম্পানির হাল ধরেন, পরে হন রাইড-হেইলিং কোম্পানি গ্র্যাব থাইল্যান্ডের নির্বাহী পরিচালক।

তিনি বিয়ে করেছিলেন থাই অভিনেত্রী-মডেল চুতিমা টিনপানার্টকে, যদিও ২০১৯ সালে ওই সংসার ভেঙে যায়। ৭ বছর বয়সী সন্তান পিপিম এখন তার সঙ্গেই থাকে। মুভ ফরোয়ার্ডের অনেক সমাবেশ, শোভাযাত্রায় পিটার সঙ্গে প্রায়ই তার মেয়েকে দেখা যায়।

রোববারের নির্বাচনে মুভ ফরোয়ার্ড ভালো ফল করলেও, এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, পিটা লিমজারোয়েনরাতই থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, কেননা এই সিদ্ধান্ত কেবল ভোটে নির্বাচিত নিম্নকক্ষই নেবে না, সামরিক বাহিনীর নিয়োগ দেওয়া উচ্চকক্ষ সেনেটের সদস্যদেরও এখানে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকছে।

ক্ষমতাসীন প্রশাসন ভোটের ফল বদলে দিতে পারে, এমন অনিশ্চয়তা নিয়ে সোমবার করা এক প্রশ্নের জবাবে পিটা বলেন, তিনি উদ্বিগ্ন, তবে অসতর্ক নন।

“নির্বাচনে যে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে, তাতে নির্বাচনের ফল বাতিলের চিন্তা করা যে কাউকে চড়া মূল্যও দেওয়া লাগতে পারে। থাইল্যান্ডের জনগণ এমনটা হতে দেবে না,” বলেছেন তিনি।  

আরও খবর:

Also Read: থাইল্যান্ডের নির্বাচনে বিরোধীদের কাছে পরাস্ত সামরিক দলগুলো