মানব পাচারে রসদ যোগাচ্ছে ‘সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন আর দুর্নীতি’

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যারা এখন পাচারের শিকার হচ্ছেন, তাদের একটি বড় অংশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2024, 07:27 PM
Updated : 28 March 2024, 07:27 PM

দেড়শ রোহিঙ্গাকে নিয়ে একটি কাঠের নৌকা ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের কাছে সাগরে ডুবে যাওয়ার ঘটনা গত সপ্তাহেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়। সাগরে উল্টে থাকা নৌকায় কয়েক ডজন নারী-পুরুষ শিশুর বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টার সেই ছবি শিহরিত করে পুরো বিশ্বকে।     

সংঘাতে জর্জর মিয়ানমার কিংবা বাংলাদেশের শরণার্থী জীবনের অনিশ্চয়তা পেছনে ফেলে একটু ভালো জীবনের আশায় এই রোহিঙ্গারা চড়ে বসেন কাঠের নৌকা বা ট্রলারে। দালালের হাতে সর্বস্ব তুলে দিয়ে জীবন হাতে নিয়ে কয়েকশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তারা পৌঁছাতে চান ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ায়।    

কেবল রোহিঙ্গারা নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে এরকম হাজারো মানুষ প্রতি বছর পাচারের শিকার হচ্ছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি) বলছে, মানব পাচারের এই কারবারকে রসদ যোগাচ্ছে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন আর দুর্নীতি। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মানব পাচারের আদ্যোপান্ত নিয়ে গত মঙ্গলবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউএনওডিসি। ‘স্মাগলিং অব মাইগ্র্যান্টস’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে অবৈধ অভিবাসনের পেছনে প্রধান তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মত দেশে স্বল্প মজুরির শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু বৈধভাবে বিদেশে গিয়ে সেই চাকরি নেওয়ার সুযোগ সীমিত। আবার বিদেশে গিয়ে বৈধভাবে কাজের জন্য যে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রয়োজন, তা মিলছে না, নিরাপদে পৌঁছানোর নিশ্চয়তাও থাকছে না। আর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ।

ইউএনওডিসি’র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রতিনিধি মাসুদ করিমিপুর বলেন, পাচার হওয়া এই মানুষগুলো সবসময় যে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি তেমন নয়। বরং ক্ষতির ঝুঁকি, নিপীড়ন বা দুর্নীতির কবল থেকে মুক্তি এবং নিরাপত্তা বা সুযোগের আশায় তারা মরিয়া পদক্ষেপ নেয়।

“অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, কখনো একক ব্যক্তি, আবার কখনো স্বল্প সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠী বা সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করে মানব পাচারের পেছনে। যারা নিরাপত্তা আর উন্নত জীবনের আশায় অভিবাসী হচ্ছে, তাদের সুরক্ষার জন্য এই পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

ইউএনওডিসির এই গবেষণার অংশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে মোট ৪ হাজার ৭৮৫ জন অভিবাসী ও শরণার্থীর ওপর জরিপ চালানো হয়। তাদের ৮৩ শতাংশই বলেছেন, তাদের পাচার করা হয়েছে।

এই জরিপের পাশাপাশি ৬০ জন অভিবাসী ও শরণার্থী এবং ৩৫ জন তথ্যদাতার বিস্তারিত সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আল জাজিরা।

প্রাণ হাতে করে সমুদ্রযাত্রা

মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে ২০১৭ সালে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ অঞ্চলে যারা এখন পাচারের শিকার হচ্ছে, তাদের একটি বড় অংশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা।

ইউএনওডিসির এ প্রতিবেদন প্রকাশের মাত্র কয়েকদিন আগে গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উপকূলে যে নৌকাটি ডুবেছিল, তাতে অন্তত দেড়শ রোহিঙ্গা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ওই ঘটনায় ৬৯ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে ৪৪ জন পুরুষ, ২২ জন নারী এবং নয়জন শিশু। তিনজনের মৃতদেহও উদ্ধার করা হয় সাগর থেকে।

জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বলছে, ওই ঘটনায় অন্তত ৭৫ জন নিখোঁজ বা মৃত। ধারণ করা হচ্ছে, ওই অঞ্চলের সাগরে নৌযান ডুবে প্রাণহানির সবচেয়ে বড় ঘটনা এটাই।

নৌকাডুবির ওই ঘটনার উদ্ধার হওয়া আকরাম ‍উল্লাহ নামের ৩০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা যুবক বলেছেন, ৯ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ওই নৌকায় পড়ে রওনা হয়েছিলেন তারা।

চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে ইউএনএইচসিআর জানায়, ২০২৩ সালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্র যাত্রায় আন্দামান সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে নৌকা ডুবে ৫৬৯ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে বা তারা নিখোঁজ হয়েছেন। এই সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় ২০০ জনেরও বেশি।  

গত বছর ৪৫০০ জনের মত রোহিঙ্গা এভাবে ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে নতুন ঠিকানায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। সে হিসেবে প্রতি আটজনের মধ্যে একজন হয় মারা গেছেন, নয়ত নিখোঁজ হয়েছেন।

এর আগে ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৭৩০ জনের মৃত্যু বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। যারা বেঁচে গেছেন, সমুদ্রযাত্রার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। যাত্রাপথে নির্যাতন এবং যৌন সহিংসতার শিকারও হয়েছেন অনেকে।

কেন এই পথে?

ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার (বিশেষ করে রোহিঙ্গারা), আফগানিস্তান ও সোমালিয়ার মত দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে বৈধ পাসপোর্ট বা ভ্রমণ নথি থাকে না। তারা যেসব দেশে প্রথমে পৌঁছায় (যেমন- বাংলাদেশ, ইরান বা ইথিওপিয়া) সেখানে স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ও শিক্ষার সুযোগের অভাব বোধ করে।

এমন ব্যক্তিরাই আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ও স্থায়ী সমাধানের খোঁজে নতুন করে ঝূঁকি নেয়। তাদের জন্য পাচারকারীরা হল তুলনামুলক ‘কম খারাপ’ বিকল্প।

মিয়ানমার, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্য অংশ এবং এর বাইরে থেকেও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে মানব পাচারের ঘটনা ঘটে। এই তিন দেশের মধ্যে দিয়ে অন্য গন্তব্যেও পাচার হয় অভিবাসীরা।

শরণার্থী এবং অভিবাসীরা বৈধ উপায়ে অভিবাসনের সুযোগ বঞ্চিত হবে– এমন ধারণা তাদের পাচার হওয়া ত্বরান্বিত করে বলে প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অভিবাসীদের মনে এমন ধারণা জন্মানোর নেপথ্যের কারণেগুলোও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সংঘাত, সহিংসতা ও নিপীড়ন, রাষ্ট্রহীনতা এবং ভ্রমণ ও পরিচয় সংক্রান্ত পর্যাপ্ত নথি হাতে না থাকা, বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় আবেদনের সীমিত সুযোগ এবং দুর্নীতি- এসব কারণে অভিবাসী ও শরণার্থীদের ধারণা হয়, বৈধ অভিবাসনের সুযোগ তারা নাও পেতে পারেন।

জরিপে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই বলেছেন, তারা নিজেরাই দালালদের কাছে গেছেন, কারণ তাদের মনে হয়েছিল, বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ার চেয়ে এটা তাদের জন্য সহজ হবে।

জরিপে পাচার হওয়াদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ বলেছেন, তারা কী করতে যাচ্ছেন তা জেনে বুঝেই ঝুঁকিপূর্ণ এ যাত্রা বেছে নিয়েছেন। ৪০ শতাংশ বলেছেন, পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না। আর বাকি ১২ শতাংশ বলেছেন, তারা দ্বিধান্বিত ছিলেন।

দুর্নীতি

অভিবাসীদের পাচারের ক্ষেত্রে দুর্নীতি একটি ‘প্রধান নিয়ামক’ বলে ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পাচার হওয়াদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন কর্মকর্তাদের উপঢৌকন বা টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন।

এক্ষেত্রে দুই রকমের প্রবণতা দেখা গেছে। হয় পাচারকারী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগসাজোশ থাকে, নয়ত পাচারকারী বা পাচার হওয়া ব্যক্তিরা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে অবৈধ অভিবাসনের পথে এগোয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচারের পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যেও দুর্নীতি সহায়ক ভূমিকা রাখে। যারা অবৈধ অভিবাসনের পথ বেছে নিচ্ছেন, তারা অনুভব করেন যে, এই প্রক্রিয়া বৈধ না হলেও দুর্নীতিগ্রস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে দেনদরবারের জন্য তাদের দালালের সহায়তা প্রয়োজন।

জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ২৮ শতাংশ বলেছেন, কর্মকর্তাদের হাত করতে তাদের সহযোগিতা করেছে দালালরা।

যোগাযোগ ও খরচ

পাচার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই পাচারকারী হিসেবে শুধু কোন একজন ব্যক্তিকে চিনতেন। ১৩ শতাংশ বলেছেন, তারা পাচারকারীদের ছোটখাটো গ্রুপের বিষয়ে জানতেন। আর মাত্র ৮ শতাংশ পাচারকারীদের সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর উপরের স্তরের বিষয়ে ইঙ্গিত পেয়েছিলেন, বিশেষ করে যে পাচারকারীরা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় মানব পাচারে জড়িত।

জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ (৬৯ শতাংশ) ক্ষেত্রে পাচার হওয়া ব্যক্তি, তার পরিবার বা বন্ধুরা প্রথমে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছিল। বাকি ৩১ শতাংশের ক্ষেত্রে পাচারকারীরাই শুরুতে যোগাযোগ করে।

পাচার হওয়াদের মধ্যে ৮৭ শতাংশই টেলিফোনে বা সামনা সামনি পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ১৩ শতাংশের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটেছে।

অবশ্য পাচারকারীদের দিক থেকে এই অবৈধ পথ বেছে নিতে চাপ প্রয়োগের ঘটনা কম। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ বলেছেন, পাচারকারীরা তাদের মাধ্যমে অভিবাসনের জন্য চাপ দিয়েছিল।

অবৈধ অভিবাসনে সহযোগিতার জন্য ১৯ ডলার থেকে ৬৬৫০ ডলার পর্যন্ত সমপরিমাণ অর্থ দালালদের দেওয়ার তথ্য এসেছে জরিপে। গড়ে প্রায় ২৩৮০ ডলার দালালদের দিয়েছেন তারা। এর মধ্যে কেউ নগদে, কেউ ব্যাংকের মাধ্যমে এবং আফগানিস্তানের নাগরিকরা কেউ কেউ হাওলার মাধ্যমে এই টাকা দিয়েছেন।

ইউএনওডিসি বলছে, প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে অবৈধ অভিবাসনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে যারা দালাল ধরে দেশান্তরী হন, তাদের ক্ষেত্রে এটা ‘খুবই প্রাসঙ্গিক’।

জলবায়ু-সম্পর্কিত সমস্যার মধ্যে- বন্যা, ঝড়, খরা, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, গবাদি পশু ও ফসলের রোগের কথা বলেছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা।

নির্যাতন, শ্রম দিতে বাধ্য করা

ইউএনওডিসির জরিপে অংশ নেওয়া চারজনের মধ্যে তিনজনই পাচার হওয়ার সময় বিভিন্ন অপরাধের শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে সোমালিয়া, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারের থেকে পাচার হওয়া লোকজনকে এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

২০১৫ সালে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী এলাকায় মানব পাচারের দুই ডজন ক্যাম্প এবং পাচারের শিকারদের গণকবরের সন্ধান মিলেছিল। স্থানীয় পুলিশ সেখানে ১৩৯টি কবর খুঁজে পায়। পাশাপাশি পাচারের জন্য নিয়ে যাওয়াদের আটকে রেখে নির্যাতনের প্রমাণ পায়।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঘটনায় থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া যৌথভাবে একটি তদন্ত করে। রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের পাচার ও মৃত্যুর ঘটনায় নয়জন সরকারি কর্মকর্তাসহ ৬২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে থাইল্যান্ড।

সবশেষ গত বছরের জুনে মালয়েশিয়া ব্যাংকক থেকে প্রত্যাপর্ণের পর চারজন থাই নাগরিককে ওই ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়।

এর আগের এক তদন্তে মালয়েশিয়ার কোনো সরকারি কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা কর্মকর্তা বা স্থানীয় নাগরিকের পাচার সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া না গেলেও সীমান্তরক্ষীদের ‘গুরুতর অবহেলা’ পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

ইউএনওডিসির প্রতিবেদন বলা হয়, পাচার হওয়া অভিবাসী ও শরণার্থীদের ধারণা, দালাল, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, কিছু সীমান্তরক্ষী এবং অপরাধী চক্রের সদস্য মিলেমিশে পাচারের এই চক্র কাজ করে। পাচারের এই প্রক্রিয়ায় শারীরিক নির্যাতন, ঘুষ আদায়, চাঁদাবাজি, যৌন সহিংসতা এবং হত্যাকাণ্ডও ঘটে।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এবং এ অঞ্চল থেকে বাইরের দেশগুলোতে পাচার হওয়া ব্যক্তিরা পাচারের পর জোরপূর্বক শ্রমের শিকারে পরিণত হন বলে জানিয়েছে ইউএনওডিসি।

এক্ষেত্রে পাচারকারী ও চাকরিদাতাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাচারকারীদের কোনো যোগাযোগ থাকে না, এমন ঘটনাও আছে।

যেসব ক্ষেত্রে ঋণের ঝুঁকি বেশি এবং মানব পাচার খুব বেশি সংখ্যায় ঘটে যেমন- মিয়ানামারের রোহিঙ্গা ও চিন জনগোষ্ঠী, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া এবং লাওসের নাগরিকদের ক্ষেত্রে মানব পাচারের সঙ্গে শ্রমের দালালিও যুক্ত বলে প্রতিবেদনের ভাষ্য।

নেপথ্যে ‘হতাশা’, ফেরাতে ‘প্রচারণা’

ইউএনওডিসি বলছে, পাচার হওয়ার পথ বেছে নেওয়াটা অভিবাসী ও শরণার্থীদের ‘মরিয়া পদক্ষেপ’।

রোহিঙ্গাদের মরিয়া মনোভাবের একটা চিত্র পাওয়া যায়, সমুদ্রযাত্রায় প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গী হওয়া শিশুদের সংখ্যার দিকে তাকালে।

সবশেষ গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়া উপকূলে নৌকাডুবির ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সংস্থা সেইভ দ্যা চিলড্রেন এক বার্তায় বলে, রোহিঙ্গাদের অব্যাহত সমুদ্রযাত্রা বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোর ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রতিফলন। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছানো রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২৫০ জন শিশু ছিল।

ইন্দোনেশিয়ার সেইভ দ্যা চিলড্রেনের অস্থায়ী পরিচালক ডেসি কুরোয়েনি উকার বলেন, “আচেহ প্রদেশে সঙ্গীহীন শিশুদের উপস্থিতি উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গা পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের উন্নত জীবনের আশায় এতটা দূরে পাঠাতেও মরিয়া।”

মরিয়া রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ তৃতীয় দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য মিয়ানমারেও ফিরে যান।

ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সমুদ্রপথে সরাসরি মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়, অথবা সাগর পথে শুরুতে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখান থেকে আবার সাগরপথে বা স্থলপথে তাদের মালয়েশিয়া পাচার করা হয়। কখনো কখনো বাংলাদেশিদেরও এভাবে মালয়েশিয়া পাচার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সমুদ্রপথে এই যাত্রায় সবাই যে কক্সবাজার থেকে যায় বিষয়টা এমন নয়। কেউ কেউ এখান থেকে যায়। আবার অনেক রোহিঙ্গা স্থলপথে মিয়ানমার গিয়ে সেখান থেকে সমুদ্রপথে নৌকায় করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশে যায়।

“বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে সাত বছর ধরে আছে। তারা নিজেদের দেশেও ফিরতে পারছে না। তাই চোখের সামনে যে পথ দেখছে, সেটাই হয়ত কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে। সাগর পথে হলেও ঝুঁকি নিয়ে যে কোনো দেশে চলে যাওয়ার মত পদক্ষেপ নিচ্ছে।”

পাচার বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মানব পাচার সংক্রান্ত যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে টেকনাফ ও উখিয়ায়। অনেক দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার বিচারকাজও চলমান।

“পাশাপাশি আমাদের পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড সবসময় পাচার প্রতিরোধে সক্রিয় আছে। এছাড়া পাচারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের সচেতন করতে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা প্রচার চালাই। সঙ্গে আইওএম, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো কাজ করে।”

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারও মনে করেন, মূলত ভবিষ্যত নিয়ে হতাশার কারণেই রোহিঙ্গারা এ পথ বেছে নেয়।

“দীর্ঘদিন ধরে নিজ দেশে ফিরতে না পারা এবং মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে তারা খুবই হতাশ। তাছাড়া তারা এখন ক্যাম্পে খাবারের অভাবও অনুভব করছে। কারণ জাতিসংঘ যে খাবার দেয়, তা অপ্রতুল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও ক্যাম্পে সমস্যা আছে। এ কারণে সাগর পাড়ি দিয়ে হলেও তাদের কেউ কেউ অন্য কোনো দেশে চলে যেতে চায়।”