নোভা কাখোভকা বাঁধ ধ্বংসে লাভ হল কার?

এই ঘটনা দক্ষিণ ইউক্রেইনকে কেন্দ্র করে থাকা দাবার বোর্ড ওলটপালট করে দিয়েছে। উভয় পক্ষকেই এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন কৌশল নিতে হবে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2023, 11:44 AM
Updated : 7 June 2023, 11:44 AM

রাশিয়ার দখলে থাকা ইউক্রেইনের দক্ষিণাঞ্চলে একটি বিশাল বড় বাঁধ উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় আশপাশের অনেক অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছে।

এ কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি এ ঘটনা প্রায় দেড় বছর ধরে চলা ইউক্রেইন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতেও প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইউক্রেইন বলছে, রাশিয়া তাদের দখলে থাকা বাঁধটি বিস্ফোরণের সাহায্যে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের অনেক মিত্রও একই কথা বলছে, যদিও সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলছে, কে যে বাঁধটি উড়িয়ে দিয়েছে তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি তারা।

রাশিয়া বলছে, ইউক্রেইনই পশ্চিমাদের সরবরাহ করা কামানের গোলা দিয়ে বাঁধটি ধ্বংস করেছে।

পাল্টাপাল্টি এই দোষারোপের মধ্যে বাঁধ ধংসের ঘটনায় কার লাভ, তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

কাখোভকা বাঁধের আগে নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে বিস্ফোরণের ঘটনাতেও প্রায় একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। কারা পাইপলাইনটি ধ্বংস করেছে, তা এখনও অজানা।

কিন্তু ঘটনা সম্বন্ধে জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে পশ্চিমারা রাশিয়াকেই দোষারোপ করা শুরু করেছিল। এখন সেরকমটা দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিমাদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাই পাইপলাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় ইউক্রেইনের হাত আছে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে।

নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন কাণ্ডের মতো কাখোভকা বাঁধের ঘটনার পরও কিইভ ও পশ্চিমাদের দোষারোপের বিপরীতে মস্কোর প্রতিক্রিয়া ছিল প্রায় একই রকমের, “আমরা করিনি। কেন আমরা করবো, যেখানে এই ঘটনায় আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি?”

নোভা কাখোভকা বাঁধের ক্ষেত্রেও রাশিয়া তাদের এরকম দুটি স্বার্থকে দেখাচ্ছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাঁধ ধ্বংস হওয়ার কারণে ধেয়ে আসা পানি বেসামরিকদের পাশাপাশি রুশ সেনাদেরও খেরসন ও বিস্তৃত নিপ্রো নদীর তীর থেকে সরতে হচ্ছে। এটা অবশ্য খেরসনের বাসিন্দাদের সাময়িক স্বস্তিও দেবে, দৈনন্দিন যাদের রাশিয়ার কামান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

দ্বিতীয়ত, এই বাঁধ ধ্বংসের ফলে রাশিয়ার দখলে থাকা ক্রাইমিয়ায় পানি সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের কাছে থাকা একটি খাল থেকে ওই শুষ্ক উপদ্বীপে পানি সরবরাহ করা হয়।

২০১৪ সালে দখল করার পর থেকে রাশিয়া ক্রাইমিয়াকে একটি দুর্গে পরিণত করেছে, ফলে সেখানে পানি সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্য তাদের থাকার কথা না।

অবশ্য এই নোভা কাখোভকা বাঁধ ধ্বংসের ঘটনাকে আরও বিস্তৃত পরিসরে দেখার সুযোগ আছে, বিশেষ করে এর সঙ্গে গ্রীষ্মে ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণের সম্ভাবনাকেও। এই পাল্টা আক্রমণ শুরুর খানিকটা ইঙ্গিত গত কয়েকদিন ধরে কিইভের বাহিনী দিয়েও যাচ্ছে।

ইউক্রেইন যদি জাপোরিজিয়ার দক্ষিণে রুশ প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙে ফেলার পথ বের করতে পারে এবং ওই এলাকাকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলতে পারে, তাহলে তারা ক্রাইমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারবে এবং কৌশলগত বড় ধরনের বিজয় অর্জন করবে।

কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণাঙ্গ সেনা অভিযানে নামা রাশিয়াও এতদিনে অনেক কিছু শিখেছে। তারা মানচিত্র দেখে ইউক্রেইনের আক্রমণের সম্ভাব্য স্থানগুলোতে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলেছে, যেন কিইভবাহিনী আজভ  সাগরের দিকে কোনোমতেই অগ্রসর হতে না পারে।

অবশ্য এর মানে এই নয় যে, ইউক্রেইন আসলে তাদের পাল্টা আক্রমণ জাপোরিজিয়াতেই শুরু করবে, এবং ক্রাইমিয়াই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল।

রাশিয়াকে দ্বিধায় রাখতে কিইভবাহিনীর হাই কমান্ড তাদের পরিকল্পনা আস্তিনেই লুকিয়ে রেখেছে। এখন সেই পরিকল্পনায় যদি জাপোরিজিয়া ও ক্রাইমিয়া থেকেও থাকে, নোভা কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস তা জটিল করে দিল।

নিপ্রো এমনিতেই বেশ বড় নদী; ইউক্রেইনের বাহিনীর পক্ষে রাশিয়ার কামানের গোলা, ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোনের মধ্যে দক্ষিণ ইউক্রেইনে পৌঁছানো এবং সাঁজোয়া যানসমেত সেটি পেরিয়ে যাওয়া ভয়াবহ বিপজ্জনকই হওয়ার কথা।

বাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং খেরসনের ‍উল্টো দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ভেসে যাওয়ায় ইউক্রেইনের সাঁজোয়া গাড়িগুলোর পক্ষে এখন সেদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ‘নেই’ হয়ে গেল।

১৯৪১ সালে সোভিয়েত বাহিনী নাৎসিদের অগ্রযাত্রা রুখতে নিপ্রো নদীর ওপর থাকা একটি বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল, ওই ঘটনায় সৃষ্ট বন্যায় হাজারেরও বেশি সোভিয়েত নাগরিক ভেসে গিয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, যে-ই কাখোভকা বাঁধটি উড়িয়ে দিক না কেন, সে দক্ষিণ ইউক্রেইনকে কেন্দ্র করে থাকা দাবার বোর্ড ওলটপালট করে দিয়েছে। উভয় পক্ষকেই এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন কৌশল নিতে হবে। সঙ্গত কারণেই ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণও পিছিয়ে যেতে পারে বলে অনেকের অনুমান।