নিজেদের অঞ্চলে মাছ না পেয়ে শ্রীলঙ্কার জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে ২০২৪ সালে গ্রেপ্তারের মুখে পড়েন রেকর্ড সংখ্যক ভারতীয় জেলে।
Published : 04 Jan 2025, 12:42 AM
বুটের শব্দ কানে আসতেই ভয়ে কাঁপতে থাকেন অশোকা (ছদ্মনাম)। ২৩ বছরের এই তরুণ তখন ছিলেন নৌকার ইঞ্জিন কক্ষে।
ভারতের পামবন দ্বীপের বাসিন্দা অশোক নৌকার ডেকে এসেই দেখতে পান, শ্রীলঙ্কার নৌ-কর্মকর্তারা বন্দুক রড ও কাঠের লাঠি দিয়ে আট জেলেকে মারধর করছেন।
এরপর মারধরের শিকার হন অশোকও। তিনি বলেন, “প্রায় এক ঘণ্টা মারধর চলতে থাকে। সাদা পোশাকে থাকা একজন ‘আরও মারেন, আরও মারেন’ বলে চিল্লাতে থাকেন।”
মারধরের শিকার হওয়া সবাই ভারতের নাগরিক। নৌকা থেকে পরে হাতকড়া পরিয়ে, শিকলে বেঁধে তাদের নেওয়া হয় শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় কারাইনগর নৌ-ক্যাম্পে।
শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে তাদের কেউ নড়াচড়া করতে পারতেন না। নড়াচড়া করলে সবাই পড়ে যেতেন।
১৫ দিন পর দুজন ব্যক্তি ওই ক্যাম্পে গিয়ে জেলেদের গামছা ও সাবান দিয়ে আসেন। জেলেরা পরে জানতে পারেন, ওই দুজন ছিলেন শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় দূতাবাসের কর্মী। ওই জেলেরা ছাড়া পান এক মাস পর।
এটা ২০১৯ সালের ঘটনা। শ্রীলঙ্কার কাচচাথিভু দ্বীপ এলাকার জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরায় গ্রেপ্তার করা হয় তাদের।
গত বুধবার আল-জাজিরার বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের পর প্রায়ই এ ধরনের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনা বাড়তে থাকে, যা ২০২৪ সালে এসে ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ে’ চলে যায়।
ভারতের সরকারি নথির উদ্ধৃতি দিয়ে আল-জাজিরা বলছে, ২০২৪ সালে তাদের ৫৩৫ জন জেলেকে শ্রীলঙ্কা গ্রেপ্তার করে, যা ২০২৩ সালের প্রায় দ্বিগুণ। গত ২৯ নভেম্বরও সেখানে ১৪১ জন জেলে বন্দি ছিলেন; মাছ ধরার ট্রলার জব্দ ছিল ১৯৮টি।
শ্রীলঙ্কার জলসীমায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে গত সেপ্টেম্বরে পাঁচ ভারতীয় জেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছেড়ে দেওয়ার আগে সবার মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়।
জেলেদের অভিযোগ, তাদেরকে বড় ধরনের অপরাধী হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। মুক্তি পেতে সবাইকে ৫০ হাজার (১৭০ ডলার) শ্রীলঙ্কান রুপি করে দিতে হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন জেলেরা।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় তামিল নাড়ু রাজ্যে জেলে সম্প্রাদায়ের লোকজন বিক্ষোভও করেছেন। তাদের অভিযোগ, ভারত সরকার তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না।
এর মধ্যে জরিমানার পাশাপাশি তিন ভারতীয় জেলেকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয় শ্রীলঙ্কা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে চেয়েও কোনো সাড়া না পাওয়ার কথা জানিয়েছে আল-জাজিরা।
অশোক বলেন, “আমি চাই, তারা আমাদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করুক।”
‘এটা আমাদের মাছ শিকারের জায়গা’
ভারত ও শ্রালঙ্কার মধ্যে সংযোগ ঘটানো মান্নার উপসাগর জীববৈচিত্র্যে ভরা এবং দুই দেশের জেলেদর জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্থান।
সেখানকার পক প্রণালীর কাচচাথিবু নামের ছোট দ্বীপটির আশপাশে ঐতিহাসিকভাবেই দুই দেশের জেলেরা মাছ শিকার করেন।
১৯৭৪ সালে ভারত দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার কাছে হস্তান্তরের দুই বছর পর সেখানে ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
আল-জাজিরা লিখেছে, বর্তমানে সেটি ‘প্রতিনিয়ত ভারতীয় জেলে গ্রেপ্তারের’ জলসীমা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি সেখানে যাওয়া পামবন দ্বীপের জেলেদের জীবনের ঝুঁকিও রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ওই জলসীমার ভারতীয় অংশে এখন আর খুব একটা মাছ পাওয়া যায় না। কয়েক দশকের প্লাস্টিক দূষণ ও বাণিজ্যিক ট্রলারের অবাধ চলাফেরা সেখানকার মাছ শিকারের এলাকা সংকুচিত করে ফেলেছে।
ভারতের জলসীমার অংশে পাথরও বেশি। এছাড়া পামবনের রামেশ্বরামের মত এলাকা, যেখানে মাছ ধরার এলাকা শুরু, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমার দূরত্ব মাত্র ১২ নটিক্যাল মাইল (২২ কিলোমিটিার)। এত সংকুচিত জায়গায় জেলেরা প্রত্যাশিত মাছ পান না।
তামিল নাড়ুর রামানাথাপুরাম জেলার জেলে সমিতির প্রেসিডেন্ট পি জেসুরাজা বলেন, “ওটাই (কাচচাথিবু দ্বীপের আশপাশ) আমাদের মাছ ধরার স্থান। জেলেরা ভালো করেই জানেন, সেখানে অনুপ্রবেশ করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
“কিন্তু জেলেরা যদি খালি হাতে ফিরে আসেন, তাহলে তাদের টিকে থাকা সম্ভব হবে না।”
তিনি দাবি করেন, “ভারতের জেলেরা সবসময় ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে যায় না। অন্ধকার, বৃষ্টি কিংবা অতিরিক্ত স্রোতের কারণেও অনেক সময় অনুপ্রবেশ ঘটে যায়।”
‘জেলেদের লড়াই’
অনেক জেলে ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই সংকট তৈরি হওয়ার জন্য ভারত সরকারের সাত দশক আগের নীতিও দায়ী।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সেখানে আন্তর্জাতিক তহবিল পাওয়ার পর ট্রলার ব্যবহারে উৎসাহ দেয় ভারত সরকার। এতে জেলেদের আয় বাড়লেও প্রবাল প্রাচীরের গঠন ভেঙে পড়তে থাকে।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার দিকে মাছের আনাগোনা বেশি। সেখানে পানির গভীরতাম কম। তাদের জলসীমায় একটি প্রশস্ত ‘মহাদেশীয় শেলফ’ রয়েছে, যা মাছ শিকারে সহায়ক।
এছাড়া শ্রীলঙ্কার সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ভারতের চেয়ে সমৃদ্ধ। মাছ শিকারে ট্রলার ব্যবহারের অনুমতিও তারা দেয়নি।
শ্রীলঙ্কার জেলেদের ভয়, ভারতীয় জেলেরা ট্রলার নিয়ে শিকারে এলে তাদের জলসীমাতেও সমুদ্রসম্পদ কমে যাবে। শেষমেশ ভারতীয় জেলেদের মত পরিণতি হওয়ার ভয়ও পান না তারা।
পি জেসুরাজা মনে করেন, “এই ব্যাপারটি দুই দেশের জেলেদের মধ্যে লড়াইয়ের মনোভাব তৈরি করছে।”