“বিশ্বের আর কোথাও আমরা শিশুদের ওপর নেকড়ের আক্রমণের ঘটনা দেখিনি,” বলেন যাদবেন্দ্রদেব ঝালা।
Published : 06 Sep 2024, 08:45 AM
ভারতের উত্তর প্রদেশে মাটির ঘরের বাইরে ঘুমাচ্ছিল চার বছর বয়সী সন্ধ্যা। সেই ১৭ অগাস্ট রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে গ্রামটি ডুবে যায় অন্ধকারে।
সন্ধ্যার মা সুনীতা বলছিলেন, “আলো নিভে যাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে নেকড়েগুলো আক্রমণ করে। যখন আমরা বুঝতে পারলাম কী ঘটেছে, ততক্ষণে ওরা মেয়েকে নিয়ে গেছে।"
পরদিন বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে আখক্ষেতে পাওয়া যায় সন্ধ্যার মৃতদেহ।
ওই মাসের শুরুতে পাশের একটি গ্রামে মশারির ভেতর ঘুমাচ্ছিল আট বছর বয়সী উৎকর্ষ; এরমধ্যে তার মা একটি নেকড়েকে তাদের কুঁড়েঘরে ঢুকতে দেখেন।
তিনি বলছিলেন, “জন্তুটা ছায়া থেকে লাফিয়ে উঠল। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘আমার ছেলেকে শান্তিতে থাকতে দাও!’ আমার প্রতিবেশীরা ছুটে এল, নেকড়েটা তখন পালিয়ে গেল।"
মাঝ এপ্রিল থেকে নেকড়ের আক্রমণ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নেপাল সীমান্তের কাছে বাহরাইচ জেলার প্রায় ৩০ গ্রামে। এরইমধ্যে ৯ শিশু এবং এক প্রাপ্তবয়স্ককে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে নেকড়েরা।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী ছিল এক বছর বয়সী একটি ছেলে, আর সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি ৪৫ বছর বয়সী এক নারী। এছাড়া আহত হয়েছে অন্তত ৩৪ জন।
এ পরিস্থিতিতে আক্রান্ত গ্রামগুলোকে গ্রাস করেছে আতঙ্ক আর উন্মাদনা। গ্রামের অনেক বাড়িতে তালা না থাকায় শিশুদের ঘরের ভেতরে রাখা হচ্ছে; আর রাতের আঁধারে আলো জ্বালিয়ে সড়কে টহল দিচ্ছেন পুরুষরা।
এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ড্রোন ও ক্যামেরা ব্যবহার করেছে, পেতেছে ফাঁদ। নেকড়েদের ভয় দেখানোর জন্য ফাটানো হচ্ছে পটকা। এখন পর্যন্ত তিনটি নেকড়েকে ধরে চিড়িয়াখানায় দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, মানুষের ওপর নেকড়েদের এমন আক্রমণ খুবই বিরল। এমন আক্রমণের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ নেকড়ে জলাতঙ্ক সংক্রমিত, ভাইরাসজনিত এ রোগটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে। এমন নেকড়ে সাধারণত শিকারকে না খেয়ে একাধিকবার আক্রমণ করে।
নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট ফর নেচার রিসার্চের একটি প্রতিবেদনে ২০০২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতসহ ২১টি দেশে নেকড়ের আক্রমণের ৪৮৯টি ঘটনা স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি ঘটনা ছিল প্রাণঘাতী। আর 'উন্মত্ত আক্রমণের' শিকার হয়েছে ৩৮০ জন।
নেকড়ের আচরণ নিয়ে কাজ করা খ্যাতিমান মার্কিন জীববিজ্ঞানী ডেভ মেচ বিবিসিকে বলেন, গত ৫০ বছরে উত্তর আমেরিকায় নেকড়ের হামলায় মাত্র দুজনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অথচ ওই অঞ্চলে প্রায় ৭০ হাজার নেকড়ের বাস।
তাহলে বাহরাইচে কেন মানুষকে আক্রমণ করছে নেকড়ে?
ওই অঞ্চলের একটি নদী ও বনের মধ্যবর্তী এলাকা দীর্ঘকাল ধরে নেকড়ের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। ঘাঘাড়া নদীর প্লাবনভূমিতে অবস্থিত এই জেলায় ৩৫ লাখ মানুষের বসবাস, যেখানে মৌসুমি বন্যা প্রায় নিয়মিত ঘটনা।
বিবিসি লিখেছে, বর্ষাকালে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যা এ এলাকার প্রতিবেশকে মারাত্মকভাবে বদলে দিয়েছে। ফুলে ফেঁপে ওঠা নদী বনাঞ্চলকে প্লাবিত করছে; তাতে নেকড়েদের খাদ্য ও পানির সন্ধানে বাইরে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
ভারতীয় নেকড়েরা সাধারণত কৃষ্ণসার, চিনকারা (ভারতীয় গজেল) ও খরগোশ শিকার করে।
লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ওয়াইল্ডলাইফ সায়েন্সেসের অমিতা কানৌজিয়া বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, কিন্তু বন্যার কারণে নেকড়েদের থাকার জায়গা নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে, খাদ্যের সন্ধানে তারা জনবসতিতে যেতে বাধ্য হতে পারে।”
কিন্তু খাবার সন্ধানী নেকড়ের নিশানা কেন শিশু হবে?
১৯৯৬ সালে উত্তর প্রদেশের গ্রামগুলোতে নেকড়ের আক্রমণে বিপুল সংখ্যক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা দেখতে পান, ওইসব এলাকায় শিশুদের দেখভাল করা হয় যৎসামান্য। কারণ বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই দরিদ্র একক পরিবারের, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব পরিবারের নেতৃত্বে থাকেন মায়েরা।
বিবিসি লিখেছে, ভারতের দরিদ্র এই গ্রামগুলোতে সাধারণত শিশুদের চাইতে গবাদি পশুকে বেশি সুরক্ষা দেওয়া হয়। এমন অরক্ষিত শিশুরা ক্ষুধার্ত নেকড়ের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। নেকড়েরা যখন নিজেদের আবাসভূমিতে শিকার পায় না এবং লোকালয়ে গবাদি পশুও শিকার করতে পারে না, তখন তারা শিশুদের নিশানা করে।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ও সংরক্ষণবিদ যাদবেন্দ্রদেব ঝালা বলেন, “বিশ্বের আর কোথাও আমরা শিশুদের ওপর নেকড়ের আক্রমণের এমন ঘটনা দেখিনি।”
বিবিসি লিখেছে, উত্তর প্রদেশে নেকড়ের এই আক্রমণ সম্ভবত চার দশকের মধ্যে এই জাতীয় আক্রমণের চতুর্থ ঢেউ। ১৯৮১-৮২ সালে বিহারে নেকড়ের আক্রমণে অন্তত ১৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে হাজারীবাগ জেলায় ৮০ শিশু আক্রমণের শিকার হয়েছিল। পাঁচটি নেকড়ের দল এসব ঘটনায় জড়িত বলে ধারণা করা হয়।
১৯৯৬ সালে পরিস্থিতি সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে উঠেছিল। উত্তর প্রদেশে আট মাসের মধ্যে ৫০টির বেশি গ্রামে কমপক্ষে ৭৬ জন শিশু আক্রমণের শিকার হয়েছিল, যাদের মধ্যে মারা যায় ৩৮ জন।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ১১টি নেকড়েকে মেরে ফেলার পর নেকড়ের আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত পশুগুলোকে সে সময় ‘মানুষখেকো' নেকড়ে হিসেবে বর্ণনা করেছিল সংবাদমাধ্যম।
১৯৯৬ সালের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করেছিলেন বিজ্ঞানী ঝালা ও তার সহকর্মী দীনেশ কুমার শর্মা। দেহাবশেষ, নেকড়ের চুল, গ্রামীণ কুঁড়েঘর, জনসংখ্যার ঘনত্ব, গবাদিপশু ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখেন তারা। উত্তর প্রদেশের বর্তমান হামলাগুলোর সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর আগের অনুসন্ধানের অদ্ভূত মিল রয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, উভয় ক্ষেত্রেই শিশুরা হত্যার শিকার হয়েছে, তাদের শরীরের অংশবিশেষ খেয়ে ফেলা হয়েছে; গলায় কামড় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে খোঁচা দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ আক্রমণ রাতে ঘটেছে, গ্রামের কেন্দ্রস্থলে ঘরের বাইরে ঘুমন্ত শিশুদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগের লাশ সাধারণত খোলা জায়গায় যেমন খামার বা তৃণভূমিতে পাওয়া গেছে।
বাহরাইচের বর্তমান ঘটনার মত ১৯৯৬ সালে নেকড়ের আক্রমণ হত নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে, যেগুলো ধান ও আখের খামার এবং জলাভূমি বেষ্টিত ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই জনবহুল গ্রাম এবং দরিদ্র কৃষক পরিবারের অরক্ষিত বিপুল সংখ্যক শিশু আক্রমণের শিকার হয়েছে।
চলমান হামলাগুলোতে একাকী কোনো নেকড়ে নাকি নেকড়ের দল জড়িত তা এখনো স্পষ্ট নয়। ৩০ বছর ধরে নেকড়েদের ওপর গবেষণা চালিয়ে আসা ঝালা মনে করেন, ১৯৯৬ সালের মত একক নেকড়েই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী।
বেঁচে যাওয়া আট বছর বয়সী উৎকর্ষের মা দেখেছিলেন কেবল একটি নেকড়ে তার বাড়িতে প্রবেশ করেছে এবং তার ছেলেকে আক্রমণ করেছে।
অন্যদিকে ওইদিন ক্ষেতে পাঁচ থেকে ছয়টি নেকড়ে দেখতে পাওয়ার কথা বলেছেন গ্রামবাসীরা।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশুপালকদের ঐতিহ্যগত সহনশীলতার কারণে শত শত বছর ধরে ভারতে মানুষ ও নেকড়ে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। এই দীর্ঘস্থায়ী সহাবস্থানের মধ্যে গবাদিপশুর সঙ্গে ঘন ঘন দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে নেকড়ে। তবে সময় বদলেছে, সম্প্রতি আক্রমণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
ঝালার মত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে শিশুদের ঘরের ভেতরে রাখা উচিত। তেমন সুবিধা অপর্যাপ্ত হলে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে ঘুমানো উচিত। রাতে টয়লেটে যেতে একজন প্রাপ্তবয়স্ককে সঙ্গে নেওয়া উচিৎ।
গ্রামবাসীর উচিত, নেকড়েরা লুকিয়ে থাকতে পারে– এমন জায়গায় শিশুদের একা যেতে না দেওয়া এবং টহল দেওয়ার জন্য নৈশপ্রহরী রাখা।
নেকড়ে বিশেষজ্ঞ ঝালা বলেন, “এই ধরনের আক্রমণের পেছনের সঠিক কারণ জানতে না পারা পর্যন্ত লোকজনকে নিরাপদ রাখতে এসব সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”