যৌন হয়রানি ঠেকাতে যে ছোট্ট ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করেন ভারতীয় নারীরা

১৮৪৯ সালে আবিষ্কারের পর থেকেই সেফটি পিন বিশ্বজুড়ে নারীদের কাছে দারুণ সমাদৃত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2023, 04:34 PM
Updated : 20 March 2023, 04:34 PM

ভারতে প্রায় প্রত্যেক নারীকেই ভিড়ের মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। কখনও ভিড়েঠাসা গণপরিবহনে, কখনও পথের ভিড়ে।

অনেক নারী হেনেস্তাকারীতে পাল্টা জবাব দিতে হাতের কাছে যা থাকে সেটাই ব্যবহার করেন। বিবিসি প্রতিনিধি গীতা পান্ডে নিজের অভিজ্ঞতার উদাহরণ টেনে বলেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার ভিড়েঠাসা বাস বা ট্রামে কলেজে যাতয়াতের সময় আমি ও আমার বন্ধুরা ছাতা ব্যবহার করতাম।

‘‘আমাদের অনেকে হাতের নখ বড় ও ধারাল করে রাখত। যাতে ভিড়ের মধ্যে শরীর হাতড়ে বেড়ানো হাতগুলো খামচে রক্তাক্ত করে ফেলা যায়। কেউ কেউ জুতার হিল দিয়ে হেনেস্তাকারীর পায় জোরে মাড়িয়ে দিত বা লাথি মারত। তবে অনেকের কাছে এর থেকেও কার্যকর অস্ত্র থাকত। সেটা হলো সেফটি পিন।”

১৮৪৯ সালে আবিষ্কারের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে নারীদের কাছে দারুণ সমাদৃত এই সেফটি পিন। কেউ কয়েক পরত কাপড় একসঙ্গে আটকে রাখতে এটিকে ব্যবহার করেন। কেউ কেউ হঠাৎ করে পোশাক ছিঁড়ে, ফেটে বা খুলে গেলে দ্রুত ব্যবস্থা হিসেবে সেফটি পিন লাগিয়ে নেন।

তবে শুধু পোশাকের নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং নারীরা নিজের নিরাপত্তার জন্যও সেফটি পিনকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে নারীরা রাস্তাঘাটে তাদের হেনেস্তাকারীকে পাল্টা জবাব দিতে এ অস্ত্রের ব্যবহার করেন। অনেকক্ষেত্রে রক্তপাতের ঘটনাও ঘটে।

কয়েকমাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টু্ইটারে ‍নানা পোস্টে ভারতীয় নারীরা স্বীকার করতে শুরু করেন, ভিড়ের মধ্যে যৌন হামলার শিকার হলে পাল্টা জবাব দিতে তারা সেফটি পিনকে বেছে নিয়েছেন এবং তারা সব সময় নিজেদের কাছে নিরীহ এই বস্তুটি রাখেন।

দীপিকা শেরগিল নামে এক নারী এ বিষয়ে বিবিসি-কে নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘আমি যে বাসে প্রতিদিন অফিসে যেতাম সেটার মধ্যেই আমার সঙ্গে এমন কাণ্ড হয়। দশক পুরনো আগের ঘটনা হলেও সব কিছু আমার স্পষ্ট মনে আছে।

‘‘আমার বয়স তখন কুড়ির কোটায়। যে লোকটা আমার সঙ্গে অসভ্যতা করেছিল তার বয়স ছিল মধ্য চল্লিশে। তিনি সব সময় ধূসর রঙের সাফারি পরতেন। তিনি প্রতিদিন আমার পাশে এসে দাঁড়াতেন, ঝুঁকে পড়তেন, আমার পিঠে তার কুঁচকি ঘষতেন এবং প্রতিবার বাস চালক ব্রেক কসলে তিনি আমার উপর ঢলে পড়তেন।”

ওই নারী জানান, তিনি ওই সময় ভীতু প্রকৃতির ছিলেন। ভিড়ের মধ্যে সবাই তাকে দেখুক তা তিনি চাইতেন না। তাই মাসের পর মাস ওই নিপীড়ন তিনি মুখবুজে সহ্য করেছেন।

‘‘কিন্তু একদিন ওই লোক বাসের মধ্যেই হস্তমৈথুন শুরু করে এবং আমার ঘাড়ের উপর বীর্যপাত করে। আমার মনে হল, যথেষ্ট হয়েছে।

‘‘আমার নিজেকে খুব নোংরা মনে হচ্ছিল। বাড়িতে ফিরে অনেক্ষণ গোসল করলাম। সেদিন আমার সঙ্গে কি হয়েছে সেটা আমি আমার মাকেও বলতে পারিনি। সে রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। এমনকী, আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছিলাম। তারপরই আমি প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা শুরু করলাম।

‘‘আমি তাকে আঘাত করতে চাইছিলাম, রক্তাক্ত করতে এবং এমন শিক্ষা দিতে যাতে সে পুনরায় আর আমার সঙ্গে এমন করার সাহস না পায়।”

পরদিন তিনি চটি না পরে হিলযুক্ত জুতা পরলেন এবং সেফটি পিন নিয়ে বাসে উঠলেন।

‘‘যখনই সে আমার পাশে এসে দাঁড়াল, আমি আমার আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার পায়ের পাতা আমার জুতার হিল দিয়ে খুব জোরে মাড়িয়ে দিলাম। তাকে ব্যাথায় হা করে চিৎকার করতে শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। এরপর আমি তার বাহুতে জোরে সেফটি পিন ফুটিয়ে দিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়লাম।”

ওই দিনের পর আরো এক বছর দীপিকা ওই বাসে যাতায়াত করেছেন। কিন্তু আর কখনও ওই ব্যক্তিকে দেখেননি।

দীপিকাকে যে নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে তা ভয়াবহ। কিন্তু ভারতে তিনি একমাত্র নারী নন যাকে প্রতিনিয়ত এসব সহ্য করতে হয়।

তারই একজন সহকর্মী তার সঙ্গে ঘটা একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। ৩০ এর কোঠার ওই নারী রাতের বাসে ভারতের দক্ষিণের নগরী কোচি থেকে ব্যাঙ্গালুরু যাচ্ছিলেন। বাসে এক ব্যক্তি বার বার তার হাত ধরার চেষ্টা করছিল।

তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে আমি তার হাত সরিয়ে দেই, ভেবেছিলাম দুর্ঘটনাবশত এটি হয়েছে। কিন্তু যখন আবারও একই কাণ্ড হল, আমি বুঝতে পারলাম সে ইচ্ছা করে এটি করছে। সেদিন আমার হিজাবে থাকা সেফটি পিন আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।

‘‘সে বারবার হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিল, আর আমি হাতে সেফটি পিন দিয়ে খোঁচা দিচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত সে সরে যায়।

আমার কাছে সেফটি পিন ছিল, সেটা ভেবে আমার আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব ছোট লাগছিল। মনে হচ্ছিল, কেনো আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে কসে চড় মারতে পারিনি।

‘‘কিন্তু তখন আমার বয়স কম ছিল। ভেবেছিলাম, আমি ঘুরে দাঁড়লে আশেপাশের লোকজন হয়ত আমাকে সমর্থন দেবে না।”

নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, বেশিরভাগ নারী মনে করেন, ঠিক এই ভয় এবং লজ্জায় নারীরা প্রতিবাদ করতে ভয় পান, আর শ্লীলতাহানিকারীরা উৎসাহিত হয়। এভাবে সমস্যাটি এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

অনলাইনে চালানো একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ভারতের ১৪০টি নগরীর ৫৬ শতাংশ নারী গণপরিবহনে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। অথচ, তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে গেছেন।

বেশিরভাগই বলেছেন, তারা বরং নিজেরাই প্রতিশোধ নিয়েছেন বা পরিস্থিতি আরও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেতে পারে আশঙ্কায় মুখবুজে সহ্য করে গেছেন।

৫২ শতাংশের বেশি নারী বলেছেন, ‘নিরাপত্তাহীনতার কারণে’ তারা লেখাপড়া বা কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

নারীদের জন্য জনসমাগমপূর্ণ স্থান নিরাপদ করতে প্রচার চালানো সামাজিক সংগঠন ‘সেফটিপিন’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা কল্পনা বিশ্বনাথ বলেন, ‘‘যৌন সহিংসতার ভয় নারীদের মনে এবং তাদের তৎপরতায় প্রকৃত সহিংসতার চেয়ে বেশি গভীর প্রভাব ফেলে।

‘‘নারীরা নিজেদের উপরই বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু করেন এবং এর কারণে নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। যৌন নিগৃহের ঘটনাগুলো যেমন ঘটে তার থেকে অনেক ভয়ঙ্কর রূপে নারীদের জীবনে সেগুলো প্রভাব ফেলে।”

যৌন নিগৃহের শিকার শুধু ভারতীয় নারীরাই হন না, বরং এটা পুরো বিশ্বের নারীদের সংকট।

থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, মেক্সিকো সিটি, টোকিও এবং কায়রোর এক হাজার নারীর উপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, ‘গণপরিবহন নেটওয়ার্কগুলি যৌন শিকারীদের জন্য দারুণ আকর্ষনীয়। যেখানে তারা নিজেদের অসভ্য আচরণ লুকাতে এবং ধরা পড়লে একটি অজুহাত দেখাতে ভিড়ের সময়টিকে বেছে নেয়’।

গণপরিবহনে নারীদের যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া প্রতিরোধে দিল্লিতে বাসে প্যানিক বাটন এবং সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। বাস চালক হিসেবে আরো নারীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

নারীদের প্রতি আরো সংবেদশীল হতে চালক ও সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

নারীরা যাতে বিপদে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য চাইতে পারেন সেজন্য পুলিশ নানা ধরনের মোবাইল অ্যাপ এবং হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে।

তবে কল্পনা বিশ্বনাথ মনে করেন, শুধু পুলিশ দিয়ে সব সময় এ সমস্য‍ার সমাধান পাওয়া যাবে না।

‘‘আমার মনে হয়, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হল এ বিষয়ে আমাদের আরো বেশি কথা বলতে হবে। গণমাধ্যমে একটি সমন্বিত প্রচারাভিযান চালাতে হবে। যাতে মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া যায় যে কোনটা সঠিক আচরণ, কোনটি নয়।”

যেটা না হওয়া পর্যন্ত দীপিকা, তার সহকর্মী বা ভারতের লাখ লাখ নারীকে নিজেদের নিরাপত্তায় সব সময় নিজের সঙ্গে সেফটি পিন রাখতে হবে।