খোদ ইসরায়েলি চিকিৎসাকর্মীরা দিয়েছেন এসব তথ্য।
Published : 21 May 2024, 09:38 PM
ইসরায়েলে হাসপাতালের বেডে গাজার ফিলিস্তিনি বন্দিদের শেকল পরিয়ে, চোখ বেঁধে রাখা হয়। কখনও কখনও তাদেরকে নগ্ন করে রাখা হয় এবং ন্যাপি পরতে বাধ্য করা হয়। বিবিসি-কে এ তথ্য জানিয়েছেন খোদ ইসরায়েলি চিকিৎসাকর্মীরা।
ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এমন আচরণ নির্যাতনেরই সামিল বলে বর্ণনা করেছেন এক চিকিৎসক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চিকিৎসক আরও জানিয়েছেন, কীভাবে একটি সামরিক হাসপাতালে ব্যথানাশক দেওয়া ছাড়াই ‘নিয়মিতভাবে’ ফিলিস্তিনি বন্দিদের অস্ত্রোপচার করা হয়। এভাবে অস্ত্রোপচারের কারণে তাদেরকে অসহনীয় ব্যথা সহ্য করতে হয়।
আরেকজন চিকিৎসকও জানান, একটি সরকারি হাসপাতালে গাজার ফিলিস্তিনি বন্দিদের অস্ত্রোপচারের সময় ‘খুব সীমিতভাবে’ ব্যথানাশক ব্যবহার করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরও জানান, অস্থায়ী সামরিক স্থাপনায় আটক গুরুতর অসুস্থ রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা করা থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে। কারণ সরকারি হাসপাতালগুলো তাদেরকে সেখানে নিয়ে যাওয়া এবং চিকিৎসা দিতে ইচ্ছুক নয়।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর তুলে নিয়ে যাওয়া এক বন্দি জানান, তার পায়ের একটি ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করতে দেওয়া হয়নি। সেকারণে শেষে তার পা-ই কেটে ফেলতে হয়েছিল।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী অবশ্য বন্দি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে হাসপাতালে এমন আচরণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, সেখানে রোগীদের যথাযথভাবে এবং সতর্কতার সঙ্গে চিকিৎসা করা হয়।
ইসরায়েলের একটি সামরিক হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন এক চিকিৎসক রোগীদের চিকিৎসা বঞ্চিত রাখার কারণে হাত কিংবা পা কেটে ফেলতে হওয়ার মতো ঘটনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে গার্ডদের রোগীদেরকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা কিংবা অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকে অমানবিক বলে তিনি অভিহিত করেছেন।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বন্দিদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে বিবিসি দুইজন তথ্যদাতার (হুইসেল ব্লোয়ার) সঙ্গে কথা বলেছে। এই দুইজনের কেউই তাদের নাম প্রকাশ করেননি।
তারা যে তথ্য দিয়েছেন তা গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় ইসরায়েলে ‘ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস’ এর একটি প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়, ইসরায়েলের নাগরিক এবং সামরিক বন্দিশালাগুলো ‘প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে’। বন্দিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে- বিশেষ করে তাদের স্বাস্থ্যের অধিকার।
ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে সেডি তেমান সামরিক ঘাঁটির ফিল্ড হাসপাতালে অসুস্থ ও আহত বন্দিদের চিকিৎসা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। গতবছর অক্টোবরে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাস হামলা চালানোর পর ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওই ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে।
বিশেষত গাজার বন্দিদের চিকিৎসার জন্যই ওই হাপাতাল স্থাপন করা হয়। কারণ, সরকারি কিছু হাসপাতাল এবং চিকিৎসাকর্মীরা হামাসের হামলার দিন আটক হওয়া যোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে ইচ্ছুক ছিল না।তখন থেকেই ইসরায়েলি বাহিনী গাজা থেকে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাকড়াও করে তাদেরকে দক্ষিণাঞ্চলের সেডি তেমান সামরিক ঘাঁটির মতো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
হামাসের সঙ্গে মিলে লড়াই করার সন্দেহভাজন এইসব বন্দিকে ইসরায়েল বন্দিশিবিরগুলোতে পাঠায়। আবার অনেককে অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়। বন্দিদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে না ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।
হাতকড়া পরিয়ে, চোঁখ বেঁধে রাখা হচ্ছে রোগীদের
সেডি তেমান হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত কয়েকজন চিকিৎসক বলেছেন, সেখানে রোগীদেরকে চার হাত পা বিছানার সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে এবং চোখও বেঁধে রাখা হচ্ছে। টয়লেট ব্যবহার করতে না দিয়ে তাদেরকে ডায়পার পরিয়ে রাখা হচ্ছে।
ইসরায়েলের এসব বিষয়ে বলেছেন, বন্দিদের নিরাপত্তায় ঝুঁকির ক্ষেত্রে তাদেরকে হাতকড়া পরানো হচ্ছে। আর যেসব রোগীর অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং একারণে নড়াচড়া করা অসুবিধা তাদেরকেই ডায়পার পরানো হচ্ছে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা এবং হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন এক অ্যানেশথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ইয়োল ডনচিন বলেছেন, হাসপাতাল ওয়ার্ডে সর্বজনীনভাবেই ডায়পার এবং হাতকড়া পরানো হচ্ছে।
তার কথায়, সেনারা একজন রোগীকে একশতভাগ নির্ভরশীল করে রাখছে। ঠিক একজন শিশুর মতো। হাতকড়া, ডায়পার পরিয়ে রাখা মানে একজন রোগীর প্রয়োজনীয় কোনওকিছুই সে নিজে করতে পারবে না। এটি অমানবিক।
ইয়োল ডনচিন আরও বলেন, কারও ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিবেচনা করে আচরণ করা হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, এমনকি যে রোগী পা কেটে ফেলার কারণে হাঁটতে অক্ষম, তার হাতও শেকল দিয়ে বিছানার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে, যার কোনও মানে হয় না।
দুইজন প্রত্যক্ষদর্শী এর আগে গাজায় যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরায়েলের এই হাসপাতালটিতে রোগীদেরকে কম্বলের নিচে নগ্ন করে রাখার কথা জানিয়েছিলেন।
আবার গতবছর অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলার পরপরই সেডি তেমান ফিল্ড হাসপাতালে কাজ করা একজন রোগীদেরকে ব্যাথানাশক এবং চেতনানাশক ছাড়াই অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন।